আচরণ
বিনা মেঘে বজ্রপাত প্রবাদটি আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটলে বলা হয়ে থাকে। বস্তুত সব মেঘেই বিদ্যুৎ থাকতে পারে। মেঘের কণার আয়তন অনুযায়ী এগুলি বিভিন্ন উচ্চতায় থাকে এবং মেঘের নামকরণ হয়ে থাকে। যে মেঘকণার আয়তন বড় সেগুলি মাটির কাছাকাছি থাকে। দিনের বেলায় সূর্যের আলো এই মেঘে বিক্ষিপ্ত হওয়ার পরিবর্তে মেঘ কণাগুলির মধ্যে প্রবেশ করে সূর্যের আলোর অভ্যন্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলন হয়ে আবার আকাশের দিকেই চলে যায়। তাই মাটি থাকে এই মেঘকে কালো দেখায়। চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়। আবার এরোপ্লেনে থেকে এই মেঘের ওপর দিয়ে গেলে একদম চোখ ধাঁধানো ঝলমলে লাগবে। মাটি একদম দেখা যাবে না। কালবৈশাখী বা ঘূর্ণিঝড়ের সময় মেঘের গতি যুগপৎ ভাবে ঊর্ধ্বমুখী ও নিম্নমুখী হওয়াতে এই মেঘের কণাগুলির আয়তন ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে মাটির কাছে চলে আসে আর ওই স্থানে বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টিপাত হয়।
আরও পড়ুন-রাজ্যে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ কমেছে ৫৮ শতাংশ, সংসদে বকেয়া আদায়ের নোটিশ তৃণমূলের
গঠন
পৃথিবীর মুক্তিবেগ ১১.২ কিমি প্রতি ঘণ্টা, অর্থাৎ পৃথিবীতে কোনও মহাকাশযানের উলম্ব গতি ১১.২ কিমি প্রতি ঘণ্টার বেশি হলেই পৃথিবীর আকর্ষণ ত্যাগ করে একেবারে মহাশূন্যে চলে যেতে পারবে, নতুবা আবার পৃথিবীতে ফিরে আসবে। তেমনি বৃষ্টিপাত-সহ বজ্রপাতের ঘটনা, বায়ুর ২ কিমি থেকে সাত কিমি পর্যন্ত ঊর্ধ্বমুখী গতির মানের উপর এবং বাতাসে উপস্থিত জলীয় বাষ্প, তাপমাত্রা এবং দূষণ কণার ওপর নির্ভরশীল। এটি একটি জলীয় বাষ্পের জটিল ঘটনা। বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকলেও বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টিপাত না হতে পারে। বায়ুমণ্ডলের উলম্ব দিকে জলীয় বাষ্প ও তাপমাত্রা বাদে, বাতাসের অন্য সমস্ত রাশিগুলি এখনও পর্যন্ত নিয়মিত বেলুন পর্যবেক্ষণ দ্বারা নির্ণয় সম্ভব হয়নি। তাই পূর্বানুমান খুব জটিল। কিন্তু রাডারের সাহায্যে বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টিপাতের ঘটনার বর্তমান অবস্থা বিশদ ভাবে জানা যায়। সেজন্য উন্নত দেশগুলিতে বায়ুমণ্ডল পর্যবেক্ষণের জন্য নানা ধরনের ওয়েদার রাডার ব্যবহার করা হয়।
আরও পড়ুন-জেলার ৩ হাজার মাছচাষিকে চারা বিলি করবে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েরা
ভয়ের কারণ
আমরা রাস্তায় বা দূর-দূরান্তে বিদ্যুৎ পোলের তারের ওপর পাখিদের বসে থাকতে দেখতে পাই। তখন ওদের কিছু হয় না, কারণ বিদ্যুৎ পরিবাহিত হচ্ছে না। কিন্তু মানুষ মাটিতে দাঁড়িয়ে বিদ্যুতের তার স্পর্শ করলেই বিপদ ঘটে। কারণ, মাটি বা পৃথিবী হচ্ছে ভয়ানক বিদ্যুৎ(ঋণাত্মক) গ্রহণকারী পদার্থ। এক্ষেত্রে, বিদ্যুতের তারের বিদ্যুৎ মানুষের দেহের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পৃথিবীতে চলে যায়। মানুষ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়। রাবারের হাতমোজা পরে স্পর্শ করলে কিছু হবে না, কারণ রবার বিদ্যুৎ পরিবহণ করতে পারে না। তবে কোনওমতেই ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়। মেইন সুইচ অফ করেই বিদ্যুতের কাজ করা উচিত।
বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন ঘুড়ির সাহায্যে প্রমাণ করেছিলেন ঘরের বিদ্যুৎ আর মেঘের বিদ্যুৎ একই। ঘরের বিদ্যুৎ সাধারণত ২২০ ভোল্টের হয়। পৃথিবীর তুলনায় মেঘের বিদ্যুতের বিভব কয়েক লক্ষ ভোল্ট হতে পারে। আকাশে ঘন কালো (ভারী) মেঘের বিদ্যুৎ কোনও উঁচু বাড়ির ওপর, গাছের ওপর বা ফাঁকা জায়গায় মাটি স্পর্শ করলেই সেখানে বজ্রপাতের সম্ভাবনা।
কেন বাড়ছে
বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন আরও দেখিয়েছেন, কীভাবে লাইটনিং রড (ধাতব দণ্ড) মেঘের বিদ্যুৎ (ঋণাত্মক তড়িৎ) কে বিতাড়িত করে বজ্রপাত হতে দেয় না, বাড়ি-ঘর নিরাপদে থাকে। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ভারতে টেলিগ্রাম যন্ত্রের সাহায্যে খবর পাঠানোর জন্য ধাতব তার লাগিয়ে লোহার দণ্ড (পোল) মাটিতে পোঁতা শুরু হয়। এগুলি শহর গ্রাম অতিক্রম করে বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিন্যস্ত ছিল। কিন্তু বর্তমানে মোবাইল ফোন আসার পর আর কোনও টেলিগ্রাফ লাইন-সহ কোনও ধাতব দণ্ড ফাঁকা জায়গায় মাটিতে দাঁড়িয়ে নেই। এগুলি সবই মেঘের ঋণাত্মক বিদ্যুৎকে ধীরে ধীরে তাড়িয়ে দিত। মানুষের প্রয়োজনে নির্বিচারে ছোট-বড় গাছ কেটে ফেলা, কৃষিক্ষেত্রে বেশি ফলনের জন্য ও কীটনাশক হিসাবে ব্যাপক ভাবে মানুষের ক্ষতিকারক রাসায়ানিক পর্দাথের ব্যবহার, জলাভূমি বুজিয়ে ব্যাপক ভাবে আবাসন, সমুদ্রে জাহাজ চলাচলে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে পেট্রোলিয়ামজাত তেলের ব্যবহার, উপরন্তু মোটরগাড়ি ও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র-সহ শিল্পায়নের জন্য বায়ুতে প্রচুর ধূলিকণা মিশে যাওয়ায় জলীয় বাষ্পকে জমতে সাহায্য করছে। অর্থাৎ এই ঘটনায় বায়ুর উলম্ব গতির মান বেড়ে গিয়ে বজ্রবিদ্যুতের সম্ভাবনাকে ভীষণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের জলবায়ুকে চক্রব্যূহের মতো ঘিরে ফেলেছে। জলবায়ুর এই গতিধারার প্রভাব সারা পৃথিবীতে বিস্তারিত হওয়ার সম্ভাবনাও দেখছেন পরিবেশবিদরা। তথ্য অনুযায়ী গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বজ্রপাত-সহ বৃষ্টিপাত অনেক গুণ বেড়ে গেছে, তাই গঙ্গাদূষণকেও এই ঘটনার জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়।
প্রতিকার
বিশ্ব উষ্ণায়ন থেকে সমুদ্র সমতলের উচ্চতা বৃদ্ধিতে বিষুবরেখা অঞ্চলে প্রথম প্রভাব পড়বে ঝড়-বৃষ্টির মাধ্যমে। তবে খরা কবলিত বা বন্যা কবলিত অবস্থা নিরুপণ করবে কোথায় কখন ও কতটা বৃষ্টিপাত হল তার ওপর নির্ভর করে। তাই বিশ্ব উষ্ণায়ন কমানোর জন্য প্রচুর গাছ লাগিয়ে তার যত্ন নেওয়া দরকার। শহরগুলিতে জনসংখ্যার একটি ঊর্ধ্বসীমা বা সীমাবদ্ধতা রাখতে হবে। শহরাঞ্চলে নির্বিচারে জলাশয় বুজিয়ে বাসস্থান নির্মাণে নিষেধে আরও কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিটি আবাসনে লাইটনিং রড (ধাতব দণ্ড) বিশেষ যত্ন সহকারে লাগানো এবং কার্যকারিতা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। স্কুলের পাঠক্রমে বিজ্ঞান মানসিকতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সৌরশক্তির ব্যবহার হাতে-কলমে শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামাঞ্চলের প্রত্যেকে ছাত্রছাত্রীকে অষ্টম শ্রেণি থেকেই সাইকেলের সঙ্গে ১২ ভোল্টের সৌরশক্তির আলোর সরঞ্জাম সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দিতে হবে। এবং ক্লাসে হাতে-কলমে সরঞ্জামগুলির অবস্থা নিরুপণ ও রক্ষণাবেক্ষণ শেখাতে হবে। কে সৌরকোষকে আরও কী কী ভাবে ব্যবহার করতে পারছে তার ওপর নম্বর রাখতে হবে। প্রত্যেক বাড়ি যেন সৌর আস্তানাতে পরিণত হয়। বিশুদ্ধ খাবারের সঙ্গে বিশুদ্ধ বাতাসেরও নজর রাখতে হবে।
সাবধানতা
ঘন কালো মেঘে যদি আকাশ অন্ধকার হয়ে থাকে তবে ভীষণ দরকার ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়া উচিত না। মনে রাখতে হবে, বজ্রবিদুৎ মহাশক্তিমান, তাই সাবধানতা অবলম্বন ছাড়া উপায় নেই। ঝড়বৃষ্টির পর জমে থাকা জলের ওপর দিয়ে চলাচল একেবারেই নিষিদ্ধ।