১৯৬৮-তে শংকরের বিখ্যাত উপন্যাস চৌরঙ্গীর ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছিল পিনাকিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের হিট ছবি ‘চৌরঙ্গী’।
এই ছবিতে স্যাটা বোস উত্তমের বিপরীতে এয়ার হোস্টেস সুজাতা মিত্রের চরিত্রটা প্রথমে সুপ্রিয়া দেবীরই করার কথা ছিল। কিন্তু মহানায়ক চেয়েছিলেন এই চরিত্রটা অঞ্জনাই করুন, মানে অভিনেত্রী অঞ্জনা ভৌমিক। কারণ মহানায়কের মনে হয়েছিল এই রোলটা তাঁকেই বেশি মানাবে।
একদিন বেণুদি অঞ্জনাকে বললেন, তুই কি উত্তমের অপোজিটে সুজাতার রোলটা করবি? আপত্তি থাকলে বল। বেণুদির কথা শুনে অঞ্জনা ভৌমিকের মন নেচে উঠেছিল এক অজানা আনন্দে। হোক ছোট রোল কিন্তু উত্তমকুমারের বিপরীতেই তো। রাজি হয়ে গিয়েছিলেন এককথায়। সেই ছবিতে করবী গুহর রোলটা করেছিলেন স্বয়ং সুপ্রিয়া দেবী। ছবি সুপারহিট। উত্তমকুমারের সঙ্গে আরও বেশ কিছু ছবিতে কাজ করেছিলেন অঞ্জনা ভৌমিক।
আরও পড়ুন-স্মৃতিদের নিয়ে নাচলেন ‘পাঠান’
উত্তমকুমারের সঙ্গে অঞ্জনার রসায়ন ছিল অসাধারণ। বন্ধুত্বও ছিল খুব গাঢ়। অথচ সেটে দু’জনেই ভীষণ গম্ভীর থাকতেন। কাজের সময় দু’জনেই অন্য মানুষ। কিন্তু শট না থাকলেই নাকি একে অন্যের প্রচণ্ড পিছনে লাগতেন।
একদিন অনেক রাতে উত্তমকুমারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন অঞ্জনা। নিছকই বন্ধুত্বের প্রগাঢ়তায়। সেটের সকলে সেদিন খুব রসিকতা করেছিল অঞ্জনার সঙ্গে। ‘চৌরঙ্গী’ ছবির প্রযোজক অসীমা চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অঞ্জনার দারুণ বন্ধু। তিনি রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘‘গভীর রাতে তুমি দেখা করতে এসেছ! কী কাণ্ড।’’ অঞ্জনা একটুও রাগ করেননি। উল্টে তাঁদের সঙ্গে হাসিঠাট্টায় মেতেছিলেন।
ষাটের দশকে বাঙালির হার্টথ্রব, দমকা হাওয়ার মতো টালিগঞ্জ পাড়ায় এসেছিলেন অঞ্জনা ভৌমিক। সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়াদেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের ঠিক পরের দশক। স্মার্ট, ঝকঝকে, অঞ্জনা ডানা কাটা পরী ছিলেন না। কিন্তু আলগা সৌন্দর্য, মায়াবী চাহনি, মিষ্টি কণ্ঠস্বর, হাসি আর অভিনয়গুণে খুব কম সময়ে পেয়েছিলেন সাফল্য, উঠে এসেছিলেন শিরোনামে। মাত্র ১৬টি বাংলা ছবি করেছেন অঞ্জনা তার মধ্যে ৭টি ছবিতেই বিপরীতে ছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার। উত্তম-অঞ্জনা জুটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল তখন এবং অঞ্জনা রাতারাতি হয়ে উঠেছিলেন প্রথম সারির নায়িকা। চৌরঙ্গীতে অভিনয় করতে গিয়ে অভিনেতা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায় মিশুকে অঞ্জনার। পর্দা ছাড়াও বিশ্বজিৎ-অঞ্জনা জুটি বেঁধেছিলেন মঞ্চেও। কলকাতায় টালা ব্রিজের কাছে শ্যামাপ্রসাদ মঞ্চে বিকাশ রায়ের সঙ্গে ‘বিষ’ নামে একটি নাটকে অভিনয় করতেন অঞ্জনা। সম্ভবত অসুস্থতার কারণে বিকাশ সরে যেতে নাটকটি বন্ধ হয়ে যায়। মঞ্চও উঠে যাওয়ার উপক্রম। সেই সময় উদ্যোক্তারা বিশ্বজিতের কাছে অভিনয়ের অনুরোধ জানান। নায়ক না করতে পারেননি। মুম্বই থেকে উড়ে এসে মহড়া দিয়ে চুটিয়ে অভিনয় করেন অঞ্জনার বিপরীতে। নাটক সুপারহিট হয়েছিল। মঞ্চটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায়। মঞ্চে বিশ্বজিতের সঙ্গে আলাদা রসায়ন তৈরি হয় অঞ্জনার।
আরও পড়ুন-চাকরি দেওয়ার নাম করে ভারতীয়দের যুদ্ধে, নামাচ্ছে রাশিয়া! অভিযোগ স্বীকার কেন্দ্রের
কোচবিহারের বিভূতিভূষণ ভৌমিকের মেয়ে আরতি ভৌমিক বাংলা ছবির অঞ্জনা ভৌমিক। ১৯৬৪ সালে পীযূষ বসুর পরিচালনায় ‘অনুষ্টুপ ছন্দে’ তাঁর প্রথম অভিনয়। তখন মাত্র ২০ বছর বয়স তাঁর। এরপর একে একে ‘থানা থেকে আসছি’, ‘রাজদ্রোহী’, ‘নায়িকা সংবাদ’, ‘কখনও মেঘ’, চৌরঙ্গী, ‘শুকসারি’, ‘রৌদ্রছায়া’ প্রতিটা ছবিতে রেখেছিলেন নিজস্বতার ছাপ ।
‘থানা থেকে আসছি’ ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে প্রথম উত্তমকুমারের সঙ্গে কাজ করেন অঞ্জনা। সেই ছবিতেই উত্তমকুমারের নজরে পড়ে যান তিনি। ‘রাজদ্রোহী’ ছবির প্রযোজকের সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল অঞ্জনার। সেই ছবিটাও বেশ প্রশংসা পায়। এদিকে তখন অগ্রদূতের বিভূতি লাহা ‘নায়িকা সংবাদ’ ছবি করবেন বলে ঠিক করেছেন। অগ্রদূতের নায়িকা মানেই ম্যাডাম সেন। একের পর এক হিট ছবি সুচিত্রা সেন করেছেন অগ্রদূতের ব্যানারে। সুচিত্রাকে ভেবেই ‘নায়িকা সংবাদ’ ছবির গানগুলোও লেখা হয়েছিল। সেই বিখ্যাত গান ‘কেন এ হৃদয় চঞ্চল হলো কে যেন ডাকে বারে বারে কেন, বলো কেন।’ সন্ধ্যার কণ্ঠে এই গান সুচিত্রার লিপে ছাড়া কেউ ভাবতেই পারত না। কিন্তু তখন সুচিত্রা সেনের মুম্বইয়ে যথেষ্ট খ্যাতি। ওদিকে মন দিয়েছেন তিনি। এদিকে উত্তমের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। দুই স্টারের মাঝে চলছে এক ঠান্ডা লড়াই। ১৯৬৩ সালে ‘সাতপাকে বাঁধা’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেলেন সুচিত্রা সেন। ফলে সুচিত্রার স্টারডামকে জল-হাওয়া দিয়ে লালন করতে মহানায়কের কোথাও বাধছিল। তিনি সুচিত্রার বদলে অঞ্জনাকে নিলেন ‘নায়িকা সংবাদ’-এ তাঁর জুটি হিসেবে। উত্তম-অঞ্জনা জুটি হল সুপারহিট। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সুচিত্রা সেনের লিপের ম্যাজিক ভেঙে নতুন রসায়ন তৈরি হল অঞ্জনার লিপে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে অঞ্জনা ভৌমিকের লিপে এই ছবিতে গাওয়া সন্ধ্যার দুটি গান আইকনিক হয়ে উঠল।
আরও পড়ুন-অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, কার, কোন উদ্দেশ্যপূরণে আনা হল?
‘নায়িকা সংবাদ’ ছবির বিখ্যাত সেই লাস্ট সিকোয়েন্স। উত্তম-অঞ্জনার মিলন দৃশ্য। সেই সিকোয়েন্স নিয়ে অঞ্জনা বেশ অস্বস্তিতে। উত্তমকুমারকে জড়িয়ে ধরতে হবে তাঁকে। অমন একজন নায়কের কাছে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তখন মহানায়কই বিষয়টা হালকা করে দিলেন। উনি নিজেই সেই শটটার আগে বলে দিলেন, ‘‘তুমি আমাকে আলগা করেই ধরো। আমি ম্যানেজ করে নেব।’’ কিন্তু ওটা তো দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরার সিকোয়েন্স। জাপটে ধরতে হবে তো। অঞ্জনা ভৌমিক বেশ টেনশনে। উত্তমকুমার আবার বললেন, ‘‘বলছি তো অত ভাবার কিছু নেই। তুমি আলগা করেই ধোরো।’’ এমনভাবেই সহজ করে দিয়েছিলেন সহ-অভিনেত্রীকে।
এরপর কখনও মেঘ, রাজদ্রোহী, শুকসারি ইত্যাদি ছবিতে উত্তমের সঙ্গে অভিনয় করেছেন অঞ্জনা। একটা সময় জীবনের পড়ন্তবেলায় সাক্ষাৎকারে দিতে গিয়ে একথা নিজে মুখে স্বীকার করেছিলেন যে মহানায়কের প্রতি একটা টান অনুভব করতেন তিনি। কিন্তু উত্তমের জীবনে তখন শত নায়িকার ভিড়। সবার ভিড়ে হারিয়ে যেতে চাননি অঞ্জনা তাই নিজেকে প্রকাশ করেননি কখনও।
আরও পড়ুন-ভাষা রক্ষায় নারীরা
একটা সময় রটে গিয়েছিল উত্তমকুমার ছাড়া অঞ্জনা ভৌমিক নাকি কারও সঙ্গে অভিনয় করতেই পারবেন না। অনেকেই বলেছিলেন তাঁর ছবি হিট হওয়ার পিছনে আসল কারণ হল উত্তমের উপস্থিতি। সেই কটাক্ষকে তুড়ি মেরে তা যে ভুল সেটা প্রমাণ করেন অঞ্জনা ভৌমিক। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘মহাশ্বেতা’ ও বসন্ত চৌধুরীর সঙ্গে ‘দিবা-রাত্রির কাব্য’-র মতো বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।
বিয়ের পর অঞ্জনা ক্রমশ বাংলা ছবির জগৎকে বিদায় জানান। ১৯৮৭ তে অঞ্জনার শেষ ছবি ‘নিশিবাসর’ রিলিজ করে। তারপর একেবারেই নিজেকে গ্ল্যামার জগৎ থেকে আড়ালে নিয়ে চলে যান। অঞ্জনা নৌবাহিনীর কর্মকর্তা অনিল কুমার শর্মাকে বিয়ে করেছিলেন। খুব সুখী দাম্পত্য ছিল তাঁদের। অনিল-অঞ্জনার দুই কন্যা নীলাঞ্জনা ও চন্দনা। অঞ্জনা ছবির জগৎ থেকে সরে গেলেও পরে তাঁর মেয়েরা গ্ল্যামার জগতেই ফিরে আসেন। অভিনয় জীবন শুরু করেন। নীলাঞ্জনা শর্মা বাংলা ছবিতে ডেবিউ করলেন। সুব্রত সেনের ছবি ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’র নায়িকা হন তিনি। নীলাঞ্জনার বিপরীতে ছিলেন সুব্রত দত্ত ও বাংলাদেশের নায়ক ফিরদৌস। ২০০২ সালে রিলিজ করে ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’। তখন আবার মেয়ের জন্য ছবির প্রচারে মাঝেমধ্যেই দেখা গিয়েছিল মা অঞ্জনাকে। আবার তিনি সর্বসমক্ষে আসেন। ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’ বিএফজে পুরস্কার পায় নীলাঞ্জনাও সেরা উদীয়মান অভিনেত্রীর পুরস্কার পান।
আরও পড়ুন-কুটির শিল্পে বাংলার মহিলারা
এরপর টলিউডে কিছু ছবি করার পর নীলাঞ্জনা মুম্বই চলে যান। এই মুহূর্তে নীলাঞ্জনা কিন্তু সফল প্রযোজক। তিনি গাঁটছড়া বাঁধেন অভিনেতা যিশু সেনগুপ্তর সঙ্গে। অঞ্জনা শেষের দিনগুলোয় মেয়েদের কাছেই থাকতেন। বয়সোজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ৭৯ বছর বয়সে চলে গেলেন অঞ্জনা ভৌমিক।