কোথায় যেন পড়েছিলাম, ‘এদিকে পৃথিবী বদলে যায়, বদলায় তার সব জীবন,/ শুধু আমি যা, তা-ই হয়ে থাকি, এক শঙ্কিত কচ্ছপ যেন,/ সুপারফাস্ট বিশ্বে ধীর পায়ে গা বাঁচিয়ে চলি সকল কিছুর থেকে,/ সমূহ বিপদ দেখে ভয় ও আতঙ্কে খোলসে লুকাই মাথা,/ বড় স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে দেই বড় ধীর— অতি দীর্ঘ জীবন এক,/ আমি হয়ে উঠি সর্বদর্শী এক প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী।’— এক নিরীহ ছোট্ট প্রাণী কচ্ছপের কথা। বড় ভয় হয় বাস্তুতন্ত্রের এই গুরুত্বপূর্ণ সদস্যটির সমূহ বিপদের কথা ভেবে। এই ঘোড়দৌড়ের বিশ্বে পরিবেশে দূষণ ও মন্দলোকের অনাচার যেভাবে বেড়েই চলেছে…।
আরও পড়ুন-মানিকতলা উপনির্বাচন : শীর্ষ আদালতে রিপোর্ট পেশ কমিশনের
পরিচিতি
কচ্ছপ প্রাণীটি বেশ নিরীহ ও ভদ্র হওয়ায় মানুষ এদেরকে অনেকসময়ই শৌখিনভাবে গৃহে পালন করেন। গোটা পৃথিবীতে প্রায় ৩০০টিরও বেশি প্রজাতির কচ্ছপ দেখা যায়। এরা সরীসৃপ জাতীয় মেরুদণ্ডী প্রাণী। কচ্ছপ অ্যানিমালিয়া রাজ্যের, কর্ডাটা পর্বের, রেপ্টিলিয়া শ্রেণির, টেস্টিডাইন ক্রমের, ক্রিপ্টোডাইরা উপক্রমের এবং টেস্টিডিনাইড পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত স্থলে, স্বচ্ছ জলে, কখনও বা মরুভূমিতে, ক্রান্তীয় অরণ্যে, ঝোপে ঝাড়ে, হ্রদে, এমনকী নালাতেও এদের দেখা যায়। গোটা পৃথিবীর মধ্যে উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্তে, ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকা অঞ্চলে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ইউরাসিয়া, আফ্রিকার উপ-সাহারা অঞ্চল থেকে মাদাগাস্কার এবং প্যাসিফিক দ্বীপের কিছু অংশে বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ দেখা যায়।
ভারতবর্ষেরও বিভিন্ন জায়গায় বেশ যথেষ্ট পরিমাণে এদের উপস্থিতি লক্ষণীয়; যে কারণে ভারতবর্ষ পৃথিবীর প্রথম তিনটি হটস্পটের মধ্যে একটি। বিশেষ করে উত্তর ভারত ও উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রায় ৩০টিরও বেশি প্রজাতির কচ্ছপ দেখা যায়। তবে সবুজাভ ধূসর বর্ণের এই শান্তিপ্রিয় ধীর স্বভাবের প্রাণীটির আজ সমূহ বিপদ। ওদের নিয়ে চলছে অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য, ধ্বংস করা হচ্ছে ওদের অনুকূল বাসযোগ্য পরিবেশ ও বাসস্থান। তাই ওরা আজ আইইউসিএন-এর লালতথ্য পুস্তিকাতে ভীতিপ্রদ ও বিপদাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত!
আরও পড়ুন-জিটিএ-র উদ্যোগে মিরিক লেকে হচ্ছে ডান্সিং ফাউন্টেন
বৈশিষ্ট্য
এই নিরীহ প্রাণীটি সবসময় নিজের মুখ তার খোলের ভিতর লুকিয়ে রাখে। কচ্ছপের দেহের খোলটি ৬০টি বিভিন্ন ধরনের হাড় দিয়ে তৈরি, যাদের নাম স্কুটাস। এরা পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে থাকে। সাধারণত পুরুষ কচ্ছপগুলো নারী কচ্ছপদের চেয়ে ছোট হলেও এদের চেনার সবচেয়ে ভাল উপায় হল লেজের দৈর্ঘ্য— পুরুষদের লেজ মোটা ও বড় হয় নারীদের তুলনায়। এরা গড়ে প্রায় ৮০-১০০ বছর বাঁচে। এরা ডিম পাড়ে রাতে একসঙ্গে প্রায় ২০-৩০টি এবং এদের অণ্ডস্ফুটন সময়কাল হল ১০০-১৬০ দিন। চাইলে এরা রাতে দেখতেও পায়। কচ্ছপের শাবককে বলা হয় হ্যাচলিং। এরা তৃণভোজী ও মাংসাশী উভয়ই হয়ে থাকে। সচরাচর এরা কলা, সবুজ পাতা, ঘাস, ব্রকোলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শসা, গাজর, আপেল, আঙুর, তরমুজ ইত্যাদি খেয়ে থাকে। তবে অনেক প্রজাতি শুধুমাত্র গুগলি ও শামুক খেয়েও বেঁচে থাকে।
মজার বিষয় হল যে, কচ্ছপের মস্তিষ্ক ভীষণ ছোট হয়। তার উপর মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার কচ্ছপগুলোর মস্তিষ্কে হিপ্পোক্যাম্পাস বলে একটি স্থান অনুপস্থিত— ফলে ওই এলাকার কচ্ছপগুলো আবেগ, শিক্ষা, স্মৃতি এবং জায়গা চিহ্নিতকরণের মতো উত্তেজনায় সাড়া দিতে সমর্থ নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন আকারের কচ্ছপ দেখা যায়। যেমন— অ্যালডেবরা দানব কচ্ছপ পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম আবার চেরসেবিয়াস সিগনেটাস বলে একধরনের কচ্ছপ পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম কচ্ছপ হিসেবে পরিচিত।
সমূহ বিপদ
তবে এমতাবস্থায় দুঃখের বিষয় হল এই যে, সারা পৃথিবী জুড়ে ক্রমশ দূষণের মাত্রা বাড়ছে; নগরায়নের নামে নির্বিচারে প্রাকৃতিক সম্পদের নিধন হচ্ছে যার চরম পরিণতি আজ এই কচ্ছপের অস্তিত্ব-সঙ্কট! পৃথিবীর মধ্যে প্রায় অর্ধেক প্রজাতির কচ্ছপই হয় ভীতিপ্রদ নয় বিপদাপন্ন! ভারতবর্ষের ইন্ডিয়ান স্টার টর্টয়েজ, ওড়িশার গহিরমাথা সামুদ্রিক অভয়ারণ্যের অলিভ রিডলে কচ্ছপ আজ লালতথ্য পুস্তিকাভুক্ত।
অস্বাস্থ্যকর বসবাসের পরিবেশ, অপর্যাপ্ত খাবার, নিম্নমানের পথ্য, উৎপীড়ন, আঘাত ও সংক্রমণের কারণে আজ কচ্ছপ মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। তার উপর আছে চোরাচালান। কচ্ছপকে কালো বাজারে অবৈধভাবে বিক্রি করে প্রচুর অর্থ উপার্জনের ঘৃণ্য প্রচেষ্টা এই প্রজাতির অবলুপ্তির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন-সুনীলকে জয় উপহার দিতে চান শুভাশিস
কচ্ছপ নাকি পোষ মানে; বিক্রিও হয় বাইরে! শোনা যায় আলিপুর চিড়িয়াখানার বিখ্যাত অ্যালডাবরা দানব কচ্ছপটিকে লর্ড ওয়েলেসলি ভারতে নিয়ে আসেন এবং ওকে রবার্ট ক্লাইভ পোষ্য বানিয়েছিলেন। চোরাচালানকারীরা এই কচ্ছপের খোল বাজারে খুব চড়া দামে বিক্রি করে। কচ্ছপের খোল ওষুধ, অলঙ্কার, অনুমানসিদ্ধ সুচতুর ভবিষ্যৎ-কথন কর্মে এবং অলঙ্করণ শিল্পে ব্যবহৃত হয়। কচ্ছপের মাংসে কোনওপ্রকার কার্বোহাইড্রেট থাকে না বললেই চলে, সবটাই প্রোটিন এবং ফ্যাট; সাথে আবার পুষ্টিকর সেলেনিয়াম, ভিটামিন বি১২, লোহা, পটাশিয়াম, থিয়ামিন, রাইবোফ্লাভিন ও জিঙ্ক প্রভৃতি থাকে। বাজারে কচ্ছপের মাংসের চাহিদাও খুব বেশি। লোভী ও স্বার্থলোলুপ ব্যক্তিরা এইসব কারণেই কচ্ছপকে অবৈধভাবে বিক্রি করে। ফলস্বরূপ এই মহামূল্যবান প্রাণীটির অস্তিত্ব শেষ হতে চলেছে!
আরও পড়ুন-তাজ এক্সপ্রেসে ভয়াবহ আগুন, হতাহতের খবর নেই
আমাদের ভূমিকা
কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে, এর ফলে আমরা নিজেরাই আমাদের পরিবেশের বাস্তুতন্ত্রকে নষ্ট করছি। পরিবেশে সাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে। খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ছে। পুষ্টিতন্ত্রে সকল শ্রেণির উপাদানের খাবারের অভাব দেখা দিচ্ছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ উভয়ই ক্রমশ বিশৃঙ্খলার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাই মানুষকে সচেতন ও শিক্ষিত করতে আবালবৃদ্ধবনিতার অঙ্গীকার হয়ে উঠুক কচ্ছপের দোকানদারি নয়, লালন-পালন হোক। এই নিরীহ প্রাণীদের সংরক্ষণ ও সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে দিই তেনিসি অ্যাকুয়ারিয়াম ও বিভিন্ন প্রাণী সংরক্ষণ বিভাগীয় সংস্থার সৌজন্যে ২০২০ সালকে কচ্ছপ বর্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর ২৩ মে দিনটিতে বিশেষভাবে ‘বিশ্ব কচ্ছপ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এবছরেও প্রকৃতিতে ওদের সহাবস্থানের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখেই দিনটি উদযাপিত হয়েছে।
মনে পড়ে কচ্ছপ ও খরগোশের দৌড়, নিজ লক্ষ্যে অনড় থেকে ধীর-স্থিরভাবে সেই পথে এগিয়ে গেলে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকা যায়— আর আজ কিনা সেই প্রাণীটির অস্তিত্ব-সঙ্কট! পৃথিবী বদলে গেছে— আমরা মনে করি এই বিশ্বের সকল ঐশ্বর্য শুধু আমাদের। এই পরিবেশ, প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিক, সমুদ্র, মাটি, রাস্তাঘাট, বাতাস, জল, পৃথিবী— এসব আমাদের নয়! শুধু কলের মতো অর্থের পিছনে ছুটতে গিয়ে আমরা কচ্ছপের মতো নিরীহ প্রাণীকেও আমাদের কুবুদ্ধির শিকার বানাতে পিছপা হচ্ছি না। তাই অবিলম্বে আমাদের অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এই পৃথিবীর সকল প্রাণকে রক্ষা করতে হবে।