ফানুসের হারানো সুর ক্র্যাকারের গন্ধে

আধুনিকতার মোড়কে আমদানিকৃত আতশবাজি শব্দবাজির বিকট শব্দে থেমে গেছে মাটির পটকার নিঃশব্দ গল্প। তখন আনন্দ ছিল প্রদীপের আলোয়, আজ সেখানে বাজারের বারুদে উড়ে যায় নস্টালজিয়ার ফানুস! উৎসব যেন আজ সুর–গন্ধ, আলো–শব্দ, কিংবা স্মৃতি বনাম অত্যাধুনিকতার সংঘাত। তবুও মনে হয়, ভুলে যাওয়া অতীতের পাতাতেই হয়তো লুকিয়ে আছে উৎসবের আসল মানে। তারই খোঁজ নিলেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

উৎসবের আঁচে
আতশবাজি ফুটে ওঠে উৎসবের নীল গগনে, শব্দবাজি হাসে সঙ্গে, রঙ্গ ছড়ায় আপন মনে! খুব স্বাভাবিক, উৎসব মানেই আনন্দ, আলো, আতশবাজি, আর শব্দের উল্লাস। কিন্তু কবে থেকে আমাদের আনন্দের এই রীতি শব্দের অত্যাচার আর ধোঁয়ার চোখরাঙানিতে ঢেকে যাচ্ছে, তা ভাবা জরুরি। এককালে উৎসব বলতে ছিল এক ধরনের নিস্তরঙ্গ আনন্দ— মাটির প্রদীপের আলো, পটকা ফাটানোর মৃদু গর্জন, আর ফানুসের শান্ত উড়ান। ছোটরা ঘরে বসে হাতে বানানো ছোট-ছোট পটকা নিয়ে খেলত এবং পুরো পরিবেশটা যেন হয়ে উঠত এক আনন্দময় আলোর দৃশ্যপট।
কিন্তু আজ সেই চক্ষু ও মনের শান্তি কোথায়? আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের আতশবাজি হয়েছে বিশালাকার, হাইটেক এবং মারাত্মক শব্দপূর্ণ। চিনা ক্র্যাকারের বিকট গর্জন, আকাশে ছুটে ওঠা রকেট, বিস্ফোরণের ধোঁয়া—সব মিলিয়ে উৎসবের আনন্দ এখন যেন শব্দদূষণ আর মানসিক পীড়ার এক নতুন সংজ্ঞা। একদিকে আমাদের আনন্দের প্রয়োজন, অন্যদিকে প্রকৃতি, প্রাণী, আর মানুষের স্বাস্থ্য— সবই যেন স্তব্ধপ্রায়। উৎসব কেমন যেন ক্রমে ক্রমে সভ্যতার সংকটে রূপান্তরিত হচ্ছে!
বর্তমানের হাওয়ায়
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আতশবাজি কিংবা শব্দবাজি কেবল আর আনন্দের মাধ্যম নয়, এটি একটি শিল্প এবং জোরদার বাণিজ্যও বটে। বাজারে সহজেই পাওয়া যায়, দামের দিক থেকে সস্তা, কিন্তু আকারে ও শব্দে জোরালো ক্র্যাকারের সম্ভার। শিশু, কিশোর, বড় সবাই— সবার চোখেই আকর্ষণ, মুখে উৎসবের আমেজ, মনে উদ্দীপনা, আর কানে আগ্রহ। কিন্তু এর কুপ্রভাবও কম নয়। উচ্চশব্দের ক্র্যাকার কানে অস্থায়ী বা স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। শোনার সংবেদনশীল প্রাণীরা যেমন পাখি, কুকুর, এবং বিড়াল— তাদের জীবনেও বিপর্যয় আসে।
এ-কথা একেবারেই সত্যি, প্রযুক্তির এই অগ্রগতি আমাদের উৎসবের আনন্দকে বৈচিত্র্যময় করেছে। আকাশভরা রকেট, ধোঁয়ার মেঘে ছুটে যাওয়া আলোর ঝলকানি, নতুন রঙের ফানুস— সবই আমাদের দৃষ্টিকে মুগ্ধ করে। কিন্তু একাল এবং সেকালের মাঝে বড় পার্থক্য হল মাত্রা এবং প্রভাব। অতীতে আনন্দের কেন্দ্রে ছিল মানুষ, সম্পর্ক এবং পারস্পরিক উৎসবের ভাবনা। কিন্তু এখন আনন্দের কেন্দ্র হয়েছে তাবড় তোড় ‘ভিজ্যুয়াল অ্যান্ড সাউন্ড এফেক্ট’।

আরও পড়ুন-চুরি করা ‘খুকি মা’ বদলে দিয়েছিল দয়ালের জীবন

আতশবাজির আবহে শব্দবাজির আক্রমণ
সাধারণত উৎসব, অনুষ্ঠান কিংবা কোনও কোনও উদযাপনে আনন্দ ও বিনোদনের জন্য ব্যবহার করা হয় আতশবাজি; মূলত কিছু বিস্ফোরক রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থ, সঙ্গে নানা ধরনের রঙের প্রভাবের জন্য বেরিয়াম, স্ট্রনটিয়াম, কপার, লিথিয়াম, সোডিয়াম প্রভৃতি ধাতু সহযোগে তৈরি হয়। বাজারে তার নানা রূপ, কখনও শব্দ, কখনও আলো, আবার কখনও ধোঁয়া তো কখনও ভাসমান; জ্বলে উঠলে নানা রঙের আলোর রোশনাই ফুটে ওঠে।
সেকালের আতশবাজিগুলো ছিল সব স্থানীয় মানুষের হাতে গড়া। উৎসবের আকাশে তখন খেলত চকোলেট পটকা, ছোট্ট বাচ্চারাও নিরাপদে ফাটাত ওই পটকা। সঙ্গে থাকত রকেট পটকা– বাঁশের নলভর্তি বারুদ, আকাশে উঠে আলোক ঝিলিক ছড়াত। মাটিতে ঘুরে ঘুরে আলো রঙে খেলত দুরন্ত আনর বা চাকি। পাড়া মাত করে ফেলত ফুলঝুরি। বড়দের মধ্যে অবশ্য জনপ্রিয় ছিল আলোকিত সৌন্দর্যের প্রতীক আলোর ফোয়ারা রঙিন ফাউন্টেন। তবে পরিবেশ মাতিয়ে তুলত যখন আগুনের গরম হাওয়ায় ভেসে উঠত উৎসবের প্রতীকী সৌন্দর্য ফানুস!
এসব এই তো কয়েক বছর আগের কথা। অল্প সময়ের ব্যবধানেই মনুষ্যকেন্দ্রিক আতশবাজির পরিবর্তে আজকে মানুষের হাতে এসে পৌঁছেছে বাজারকেন্দ্রিক ও প্রদর্শনমুখী আতশবাজি। ছাই, মাটি ও সামান্য পরিমাণ বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি করা আতশবাজি আর আজ বাজারে এসেছে দানবীয় শব্দবাজির রূপ ধারণ করে। তখনকার আতশবাজির সবটাই ছিল মৃদু আলোর খেলা, শব্দ কানে লাগত না; আজকে উৎসবের আলো যেন শব্দে ডুবে যায়!
এখন বাজারে এসেছে তীব্র শব্দের বিস্ফোরক, শব্দবাজির প্রতীক বুলেট বম্ব। স্কাই শটস কিংবা মাল্টিশটসের একসঙ্গে আকাশে বহু আলোর ফোয়ারার চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য সকলের মন কেড়েছে। আন্তর্জাতিক মানের আতশবাজি কালারফুল এরিয়েল শেলস বা পিওনি আজ শহর কিংবা গ্রামের উৎসবের আভিজাত্য বাড়িয়ে তুলেছে। প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ সম্পূর্ণ আলো-নির্ভর আধুনিক আতশবাজি লেজার ফায়ার ওয়ার্কস বা এলইডি ফায়ার ডিসপ্লের প্রদর্শনী আজ অত্যন্ত জনপ্রিয়। আলো ও শব্দের যুগলবন্দিতে সঙ্গীতের তালে তালে নেচে ওঠা ইলেকট্রিক্যাল স্পার্কলারস বা মিউজিক্যাল ফায়ার ওয়ার্কস কিংবা ধোঁয়া সৃষ্টি করে রঙিন পরিবেশের মাদকতা এনে দেওয়া স্মোক ক্র্যাকার্স— সবই আজ হট কেক! হ্যাঁ হয়তো সভ্যতা ও পরিবেশের দারুণ ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাধারণ মানুষের যেন কুছ পরোয়া নেহি!

আরও পড়ুন-বিনা অনুমতিতে ৪৫ লক্ষ টাকার বেশি প্রকল্পে কাজ নয়, সতর্কবার্তা নবান্নের

নিস্তরঙ্গ আনন্দে বিপদের সংকেত
সেকালে আতশবাজি ছিল সরল, নিরাপদ, এবং পরিবেশবান্ধব। পটকা, ছোট ফানুস, মাটির প্রদীপ— সবই সীমিত শব্দ ও ধোঁয়ার সৃষ্টি করত। শিশুরা হাতের ছোট ছোট পটকা ফাটিয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হত। প্রতিবেশীরা গন্ধ বা ধোঁয়ায় অপ্রস্তুত হত না। প্রকৃতিই যেন আমাদের আনন্দের সহযাত্রী। উৎসবের রাতে আকাশের তারা আর মাটির প্রদীপ— এই দৃশ্যের সৌন্দর্যই ছিল প্রাকৃতিক আনন্দ।
সেকালের আতশবাজিতে স্বাস্থ্যঝুঁকি ছিল সীমিত। উচ্চ শব্দ, বিষাক্ত ধোঁয়া বা দুর্ঘটনার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। তবে আনন্দের মাত্রা কখনও কম ছিল না— কারণ আনন্দের উৎস ছিল পারস্পরিক সৌহার্দ্য, পরিবারের সংহতি এবং সমাজের মিলন। আজকের একালের আতশবাজি এই সবকিছুকে প্রায় অদৃশ্য করে দিয়েছে।
মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশ
উচ্চ শব্দ ও ধোঁয়া শুধু যে আমাদের শ্রবণশক্তির ক্ষতি করে তা নয়, মানসিক চাপও তৈরি করে। শিশুদের ঘুম বিঘ্নিত হয়, বয়স্কদের হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পায় এবং এমনকী প্রাণীর আচরণেও পরিবর্তন আসে। পাখি, বিড়াল, কুকুর— সবাই আতঙ্কিত হয়। এছাড়া বায়ুদূষণও বাড়ে। রকেট ও ক্র্যাকারের ধোঁয়ায় মিশে থাকা কার্বনকণা, রাসায়নিক উপাদান ও সীসামুক্ত বাতাসে মিশে মারাত্মক পর্যায়ে পরিবেশ দূষণ ঘটায়। বলা ভাল, অত্যাধুনিক আতশবাজি বা শব্দবাজি মানবসভ্যতা ও পরিবেশ উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক। শব্দদূষণ আর মানসিক চাপের মধ্যে সামাজিক প্রভাবও রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর বিরোধ বৃদ্ধি পায়। ছোট গ্রামে বা শহরের সংলগ্ন এলাকায়, যেখানে ঘনবসতি রয়েছে, সেকালের নিস্তরঙ্গ আনন্দের পরিবর্তে একালের অতিভারী শব্দ এখন মানসিক অসুবিধার কারণ। ফলত বাড়ছে সামাজিক ও মানবিক সংকট!
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে
বিজ্ঞান বলছে, কোনও বস্তু বা প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, তার প্রভাবকে বিবেচনা করা আবশ্যক। মানুষের কানে নিরাপদ শব্দের মাত্রা সীমিত। ক্র্যাকারের উচ্চশব্দ এই সীমার অনেক উপরে। ধোঁয়া ও রাসায়নিকের মুক্তি পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই একালের আতশবাজির উন্নতির ফলে যে মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে, সেটা বিবেচনা না করলে সামাজিক দায়বদ্ধতা পূর্ণতা পায় না।
সংস্কৃতি বনাম প্রযুক্তি
উৎসবের মূল ভাবনা ছিল আনন্দ ভাগাভাগি করা, একে অপরের সঙ্গে মিলন ঘটানো। কিন্তু আজ তা প্রযুক্তির কবলে বিকলাঙ্গ হতে বসেছে। আমরা ভুলে গিয়েছি, আনন্দের জন্য শব্দ বা ধোঁয়া অপরিহার্য নয়। আলোর সৌন্দর্য, হাসি, গল্প— এই সবই আনন্দের উৎস হতে পারে। সেকালের আতশবাজি আমাদের শেখায়, কীভাবে সীমিত সম্পদে নিরাপদ আনন্দ উদযাপন করা যায়। একালের আতশবাজি আমাদের দেখায়, প্রযুক্তি কীভাবে আনন্দের মাত্রা বাড়াতে পারে, কিন্তু তার প্রভাবও কত বড়। এই দ্বৈত বাস্তবতা আমাদেরকে সচেতন করে। একাল ও সেকালের বিস্তর প্রাযুক্তিক বিপ্লবের হাত ধরে সাংস্কৃতিক বিভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সমাধানসূত্রের খোঁজে
সমাধান সহজ নয়, তবে সম্ভব। পরিবেশবান্ধব ক্র্যাকার, নীরব ফানুস, এবং আলোভিত্তিক উৎসব— এসব বিকল্প মানুষের আনন্দকে সীমাবদ্ধ না-করে প্রাকৃতিক ও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে। শিশুদের জন্য ছোট ছোট পটকা, এলইডি লাইটের ফানুস, পরিবার ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দ— এই সবই একালের আতশবাজিকে নীরব, নিরাপদ ও সুন্দর করে তুলতে পারে। আমাদের উৎসবের আনন্দ শব্দে নয়, আলোতে, হাসি-মুখে, আর পারস্পরিক মিলনে। সেকালের নিস্তরঙ্গ আনন্দের মতো, আমরা চাই শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব উৎসব।
প্রযুক্তি আমাদের হাতিয়ার হতে পারে, কিন্তু আনন্দের মূল উৎস আমাদের মানসিক ও সামাজিক সংহতি। ঠিক এখানেই আবির্ভাব ঘটেছে গ্রিন ক্র্যাকার বা সবুজ আতশবাজির, সরকারের পক্ষে উৎসবের মরশুমে জারি করা হয়েছে কড়া নির্দেশিকা। পরিবেশের কথা মাথায় রেখে সকলের উচিত গ্রিন ক্র্যাকার ব্যবহার করা। গ্রিন ক্র্যাকার হল পরিবেশবান্ধব আতশবাজি যা ঐতিহ্যবাহী বাজির তুলনায় কম ক্ষতিকর। এতে পটাশিয়াম নাইট্রেট, অ্যালুমিনিয়াম ও সালফারের পরিবর্তে নাইট্রোজেনভিত্তিক যৌগ, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক অক্সাইড এবং জলীয় বাষ্প সৃষ্টিকারী রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এর ফলে কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের নিঃসরণ ৩০-৪০% পর্যন্ত কমে যায়। আলোর রঙ ও তেজ বজায় রেখেও বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
উৎসবে মনের আলো
আতশবাজি কেবল শব্দের খেলা নয়। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, আনন্দের প্রকাশ এবং পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতীক। একালের অতিভারী, উচ্চ শব্দপূর্ণ আতশবাজি আমাদের এই মূল ভাবনাকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। তাই আমাদের দায়িত্ব হল— প্রযুক্তি ব্যবহার করে আনন্দ উদযাপন করা, কিন্তু সীমা ও প্রভাব বিবেচনা করা। নিস্তরঙ্গ, শান্তিপূর্ণ আর পরিবেশবান্ধব উৎসব ফিরিয়ে আনাই হবে আমাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্তব্য। আনন্দের উৎসব শব্দে নয়, আলোয়— উচ্ছ্বাসে নয়, সহানুভূতিতে। পটকা হয়তো ছোট, কিন্তু মানুষের হৃদয় বড়। সেকালের আতশবাজির সেই নিস্তরঙ্গ আনন্দ আজকের দিনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব, যদি আমরা সচেতন হই এবং প্রযুক্তির ব্যবহারকে সঠিক সীমায় রাখি। কবি হয়তো ঠিকই বলেছেন, দীপাবলির মহোৎসব হোক আনন্দময়…, আলোয় জগৎ ভরে উঠুক/ শব্দ-বাজি নয়। দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়ুক আলোর রোশনাই…, সবার মুখে হাসি ফুটুক/ উৎসবের আঙিনায়।

Latest article