সম্মোহনের জাদু

সম্মোহন শব্দটা শুনলে একটা রোমাঞ্চ অনুভব হয়— এই বিদ্যা কিন্তু কোনও তন্ত্রমন্ত্রের ফল না, কোনও ঈশ্বরের আশীর্বাদ নয়, কোনও জাদুটোনারও অংশ নয়, এ হল নিখাদ বিজ্ঞান। এই বিদ্যার সঠিক প্রয়োগ না জানলে কিন্তু সম্মোহিত ব্যক্তি পড়তে পারেন বিপদে। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

‘সম্মোহন’ কথাটি শুনলেই কেমন যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে সোনার কেল্লার নকল ডাক্তার হাজরা ও মুকুলের কথা, মুকুল জাতিস্মর জেনে আর মুকুলের মুখে দামি পাথরের কথা শুনে সে ভেবেছিল মুকুলের পূর্বজন্মের কথা জানতে পারলেই সে পাবে সব দামি পাথরের সন্ধান, আর তা জানতে হলে মুকুলকে সম্মোহন করাই হল একমাত্র পথ, তাই সে সেই পথই বেছে নেয়। তাহলে কি কোনও মানুষকে সম্মোহিত করলেই তার পেট থেকে বলতে না চাওয়া কথাগুলি হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসবে? হ্যাঁ সম্মোহনে ঠিক এরকমটাই ঘটে থাকে। এক্ষেত্রে মানুষ তার চেতনা হারায় মানুষের মন তখন অবচেতন হয়ে পড়ে তাই মানুষ যা তার সচেতন অবস্থায় করতে সঙ্কোচ বোধ করে অবচেতন মনে সে তাই করে বসে আর এই অবচেতন মন যে ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে সে তার ইচ্ছামতো অবচেতনে থাকা সেই মানুষটিকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নিতে পারে। তবে সম্মোহনের এই বিদ্যা কিন্তু খুব সহজ নয়, এই বিদ্যার সঠিক প্রয়োগ না জানলে কিন্তু সম্মোহিত ব্যক্তির বড়সড় ক্ষতি হতে পারে। বলা বাহুল্য এই বিদ্যা কোনও তন্ত্রমন্ত্রের ফল নয়, কোনও ঈশ্বরের আশীর্বাদ নয়, কোনও জাদুটোনারও অংশ নয়, এ হল নিখাদ বিজ্ঞান।

আরও পড়ুন-মুঘল আমল থেকে ভুপালপুর রাজবাড়িতে পূজিতা দেবী

প্রাথমিক ধারণা
তীব্র আবেগ ও কল্পনাশক্তি দ্বারা অন্যের মনকে প্রভাবিত করা এবং পরিচালনা করার নামই হল হিপনোসিস বা সম্মোহন। অতি-প্রাচীন কাল থেকেই সম্মোহনবিদ্যার প্রচলন রয়েছে আমাদের এই মানবসমাজে। সেকালে মানুষ এই বিদ্যাকে জাদুবিদ্যা বা অলৌকিক ক্ষমতা বলে বিশ্বাস করত। অষ্টাদশ শতকে সম্মোহনবিদ্যার নামকরণ হয় ‘মেসমেরিজম’ হিসেবে । অষ্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরের ড. ফ্রান্ডস অ্যান্টন মেজমার সর্বপ্রথম সম্মোহনবিদ্যার চর্চা শুরু করেন। এরপর থেকেই এর ব্যাপক প্রচার শুরু হয় এবং ডাক্তারবাবুর নামানুসারেই সবাই এই বিদ্যাকে ‘মেসমেরিজম’ বলতে থাকে। এরও বেশ কিছুকাল পরে ১৮৪০ সালে স্কটল্যান্ডের একজন ডাক্তার ড. জেমস ব্রেড এই ‘মেসমেরিজম’-এর এক নতুন নামকরণ করেন। আসলে গ্রিক শব্দে ঘুমের দেবতার নাম ‘হুপ্নস’ আর এই শব্দের অর্থ হল ঘুম। সম্মোহিত ব্যক্তি যেহেতু এক প্রকার ঘুমের ঘোরেই সমস্ত কাজকর্ম করে থাকে তাই ড. ব্রেড এই বিদ্যার নাম দেন ‘হিপনোটিজম’। যা আজও ওই একই নামে পরিচিত।
সম্মোহনের কৌশল
বাম হাতের বুড়ো আঙুল, তর্জনী এবং মধ্যমার মধ্যে যেকোনও একটি উজ্জ্বল বস্তু রাখতে হয়। সাধারণত চোখ থেকে এই আলোটিকে প্রায় আট থেকে পনেরো ইঞ্চি দূরত্ব পর্যন্ত রাখা হয়, কপালের ওপরে এমন অবস্থানেই এই আলোটিকে রাখা হয় যাতে সেটি চোখ এবং চোখের পাতার ওপর সর্বাধিক সম্ভাব্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং যাকে সম্মোহন করা হবে তাকে সেই বস্তুর দিকে স্থির দৃষ্টি রাখতে বাধ্য করে।
এরপর সেই ব্যক্তিকে সেই বস্তুর ওপর অবিচলিতভাবে দৃষ্টি স্থির রাখতে বলা হয় এবং মন সেই একটি বস্তুর ওপরেই নিবদ্ধ করতে বলা হয়। এরপর এটি পর্যবেক্ষণ করা হয় যে, তারারন্ধ্র প্রাথমিকভাবে সঙ্কুচিত হয়, আবার শীঘ্রই সেটি প্রসারিত হতে শুরু করে এবং বেশ কয়েকবার এরকম হওয়ার পরে, চোখে একটি তরঙ্গায়িত গতি লক্ষ করা যায়, যদি ডান হাতের সামনের এবং মাঝের আঙুলগুলি, প্রসারিত এবং কিছুটা আলাদা করে বস্তু থেকে চোখের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়, সম্ভবত চোখের পাতাগুলি তখনই অনিচ্ছাকৃতভাবে একটি কম্পন গতির সাথে বন্ধ হয়ে যায়। আর যদি এটি না হয়, বা ব্যক্তির অক্ষিগোলকগুলি নড়াচড়া করতে থাকে, তবে পুনরায় এই পদ্ধতিটি অনুসরণ করা হয়। এক্ষেত্রে এটি মাথায় রাখতে হয় যে এই পদ্ধতিতে যেন চোখের অক্ষিগোলক অবশ্যই একই স্থানে স্থির থাকে এবং মন চোখের সামনে রাখা বস্তুর ওপরেই যেন নিবদ্ধ থাকে। সাধারণভাবে, এটি দেখা যায় যে এই প্রক্রিয়া চলাকালীন চোখের পাতাগুলি একটি কম্পন গতির সাথে বন্ধ হয়ে যায় বা স্প্যাসমোডিকলি বন্ধ হয়ে যায়।

আরও পড়ুন-ফের এনআরসি-তাস বিজেপির, তীব্র সমালোচনা তৃণমূলের

আসলে সম্মোহন হল একটি ‘হিপনোটিক ইন্ডাকশন’ কৌশল। সাধারণত, এই পদ্ধতিতে ব্যক্তির মধ্যে একটি ‘সম্মোহনী ট্রান্স’ দশা স্থাপিত হয়। এই ইন্ডাকশন কৌশল এবং পদ্ধতিগুলি সম্মোহনী ট্রান্স স্তরের গভীরতা ও পর্যায়ের ওপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন ইন্ডাকশন কৌশল থাকা সত্ত্বেও সবচেয়ে প্রভাবশালী পদ্ধতি হল ব্রেইডের এই ‘আই-ফিক্সেশন’ কৌশল, যা ‘ব্রেইডিজম’ নামেও পরিচিত। সম্মোহনের এই কৌশলে ‘সাজেশন’ বা পরামর্শ কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত সচেতন অবস্থায় করা কোনও বিষয়বস্তুতে পরিবর্তনের জন্য পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে এবং এর দ্বারা উপলব্ধি, সংবেদন, জ্ঞান, আবেগ বা আচরণকে পরিবর্তন করা যেতে পারে। এটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে সম্মোহনের সাথে সম্পর্কিত অনেক আকর্ষণীয় প্রভাব আসলে পরামর্শ বা সাজেশন-এর মাধ্যমেই আনা হয়।

আরও পড়ুন-ফের এনআরসি-তাস বিজেপির, তীব্র সমালোচনা তৃণমূলের

ব্যবহার
ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক নিযুক্ত একটি কমিটি বিস্তর অনুসন্ধানের পর রায় দেয় হিপনোটিজম হল একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। এরপর যত দিন এগিয়েছে তাবড়-তাবড় চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা এই বিদ্যাটির বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আর সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে নিত্যনতুন গবেষণা। সম্মোহন সবাইকেই করানো সম্ভব। অনেকে মনে করেন, প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানুষকে হিপনোটাইজ করা যায় না। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। দেখা গেছে, মোটামুটিভাবে কোনও জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মানুষকে হিপনোটাইজ করা যায়। বাকিদের ক্রমশ উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হিপনোথেরাপিতে অভ্যস্ত করে তোলা যায়। হিপনোথেরাপি পদ্ধতি খুবই সহজ। অবশ্য হিপনোথেরাপির আসল জোর মোটেই তার পদ্ধতিতে নয়, বরং তার সাজেশনে। হিপনোথেরাপির উদ্দেশ্য শুধু কাউকে হিপনোটাইজ করা নয়, তাকে তাঁর সমস্যা থেকে উদ্ধার করা। হিপনোথেরাপি হল ‘প্রোগ্রামিং অফ সাবকনসিয়াস মাইন্ড’। এটি অনেক দ্রুত পদ্ধতি, যা কিনা সরাসরি সমস্যার মূলে গিয়ে পৌঁছোতে পারে। তবে সাজেশন ঠিকঠাক না-হলে মনের প্রোগ্রামিংয়ে গরমিল হয়ে যেতে বেশি সময় লাগে না। কারও কারও ক্ষেত্রে একটা-দুটো অতিরিক্ত শব্দ গ্রহণ বা বর্জন সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। অতএব যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত হিপনোথেরাপিস্ট ছাড়া অন্য কারও কাছে থেরাপি নেওয়া উচিত নয়। হিপনোথেরাপির মাধ্যমে বহুরকমের অসুখ এক্কেবারে গোড়া থেকে নির্মূল করা যায়, তাও আবার বিনা ওষুধে। যেমন— মেনোপোজ, ইরিটেবল বাওল সিন্ড্রোম, বিভিন্ন ধরনের ব্যথা-বেদনা এমনকী ক্যানসার রোগীর যন্ত্রণা উপশমেও এর জুড়ি মেলা ভার।

Latest article