বাজার আগুন অথচ নিষ্ক্রিয় মোদি সরকার

জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। মোদি সরকার চুপচাপ। বেকার বাড়ছে রোজ। মোদি সরকার ঘুমোচ্ছে। কেন্দ্রের শাসক দলের কোনও মুসলিম এমপি নেই। নারী সংরক্ষণ বিল পাশ করালেও তারা এক-তৃতীয়াংশ মহিলা প্রার্থী দাঁড় করায়নি। অষ্টাদশ সংসদীয় অধিবেশনে মোট নির্বাচিত মহিলা এমপির সংখ্যা ৭৮ থেকে কমে ৭৪ হয়ে গিয়েছে। এরপরেও এদের গদিতে থাকার অধিকার আছে? প্রশ্ন তুলছেন দেবলীনা মুখোপাধ্যায়

Must read

মূল্যবৃদ্ধি আর নতুন কথা নয়। প্রায় সারা বছর মূল্যবৃদ্ধির আঁচে সাধারণ মানুষের হাত পুড়েই চলে। প্রান্তিক মানুষদের কথা বাদই দিলাম, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারেও আজ নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা। সাধারণ বাড়িতে তেল দিয়ে মেখে আলুসিদ্ধ ভাত খাওয়াও যেন আজ বিলাসিতা মনে হয়। বহু মানুষেরই হয় চাকরি নেই, অথবা কর্মক্ষেত্রে কাজের সঙ্কোচন ঘটেছে। ফলে উপার্জন প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। এই অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে সংসার চালানোই সমস্যার। বেশ কিছু বছর ধরেই চুপিসারে গ্যাসে ভরতুকির অঙ্ক কমিয়ে আনছে কেন্দ্র। কারণ, প্রতিবারে সিলিন্ডারের দাম কতটা বাড়বে, সেটা জানানো হচ্ছে, কিন্তু ভরতুকির অঙ্ক কতটা বাড়বে, সেই বিষয়টি গোপন থাকছে। ফলে ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি কেরোসিনের দামও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই সাধারণ মানুষের কাছে রান্না করার জন্য দুটো ভাত ফোটানো সাধ্যাতীত হয়ে পড়েছে। ক্রমান্বয়ে রান্নার গ্যাস, পেট্রোল-ডিজ়েল, কেরোসিনের দাম বাড়ানো প্রকৃতপক্ষে জনবিরোধী নীতি। কেন্দ্রীয় সরকার দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে কাজের সুযোগ কমেছে, বেকারত্ব বেড়েছে। সরকার প্রায়ই বলে থাকে যে, পেট্রোপণ্যের দাম নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজারের দামের উপর। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে এ দেশে দাম বাড়ে। কিন্তু দাম কমলে আমাদের পেট্রোল, ডিজ়েলের দাম কমে না। করোনা কালে আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোপণ্যের দাম একেবারে তলানিতে ঠেকেছিল। কিন্তু সরকার আরও বেশি কর, সেস বসাল। ফলে দাম কমল না, একই থাকল। সেই ট্রেন্ড অব্যাহত। জিনিসপত্রের দামে লাগামহীন বৃদ্ধি। সরকার যেন ভুলে গিয়েছে, অনেক প্রবীণ নাগরিক আছেন, যাঁরা পেনশন পান না। কেউ হয়তো বা ১০০০ টাকা পরিবার পেনশন পান, কেউ তা-ও পান না। কারও অবসরের সময় প্রাপ্ত টাকা ব্যাঙ্কে রেখে সুদের টাকায় সংসার চলে। সুদও ক্রমহ্রাসমান। ওষুধের খরচ আছে। মূল্যবৃদ্ধির মুখে এঁদের সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসে না।

আরও পড়ুন: প্যাকেটবন্দি খাবারে চিনি, নুন, ফ্যাটের মাত্রা স্পষ্ট করার নির্দেশ

মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া গত দু’সপ্তাহের সংসদীয় অধিবেশনে দেশ কী পেল? হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গণতন্ত্রের সবচেয়ে খরচসাপেক্ষ নির্বাচন। ১ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকা শুধু ভোটের ব্যয়। আর প্রচার? সব মিলিয়ে দু’লক্ষ কোটি টাকার ধাক্কা। তারপর অষ্টাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন। সেই অধিবেশনে জিনিসপত্রের বেলাগাম দাম বৃদ্ধি ছাড়া দেশের লোক আর একটা জিনিসই পেয়েছে। মোদি সরকারের নিষ্ক্রিয়তার বাইরে আর একটা জিনিস হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে দেশবাসী। ইলেক্টোরাল বন্ড, নিট, নেট, অগ্নিবীর, দুর্নীতির তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে ক্রমাগত।
৪ জুন ফল বেরল। একসঙ্গে নির্বাচন ও নিটের। ভোটে চারশো দূরঅস্ত, ৬৩ আসন কমে ২৪০-এ এসে দাঁড়াল বিজেপি। উত্তরপ্রদেশের মাটিতে ভরাডুবি হল গেরুয়া স্বপ্নের। দলিতরা মোদির চাপিয়ে দেওয়া পাঁচশো বছর পর রামকে ঘর দেওয়ার স্পর্ধা ও আস্ফালনকে আঘাত করল সজোরে। কিন্তু সেই রাতেই অন্য যে ঝড় শত শত প্রতিভাবান তরুণ-তরুণীর ভবিষ্যৎকে ধাক্কা দিয়েছিল, তার খোঁজ আমরা ক’জন নিয়েছি। যাঁরা আগামী দিনে দেশের নাগরিকদের চিকিৎসা করবেন, প্রাণ ফিরিয়ে দেবেন, হাতের নাড়ি সচল রাখার মন্ত্র শিখবেন, তাঁদের নিয়ে সরকার ছিনিমিনি খেলল! প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তো আছেই, সঙ্গে জুড়েছে ১,৫৬৩ জনকে দেওয়া রহস্যজনক গ্রেস মার্ক। এতবড় দুর্নীতি সরকারের যোগসাজশ ছাড়া সম্ভব? কীসের ভিত্তিতে ওই ছাত্রছাত্রীরা গ্রেস পেয়েছিল, তা আজও জানাতে পারেনি ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, গ্রেস পাওয়ারা সবাই রিটেস্টেও অংশ নেয়নি। গত দু’সপ্তাহে প্রত্যাশিতভাবেই সংসদে উঠল স্বাধীন ভারতের অন্যতম পরীক্ষা দুর্নীতির কথা। কিন্তু দায়সারা সাফাই ছাড়া সরকার আর কী করেছে। এতকিছুর পর দায় মাথায় নিয়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর ইস্তফা দেওয়া কি উচিত ছিল না? তিনি তো সেটা দেননি। পুরীতে বসে বসে রথ দেখেছেন। তাঁর ধর্মপ্রাণ আচরণে দিন আনা দিন খাওয়াদের কী যায়-আসে? নিত্যদিন বেকারত্বের নয়া রেকর্ড। পেট্রোল, ডিজেলের দাম কমার কোনও লক্ষণ নেই। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে খোদ রিজার্ভ ব্যাঙ্কও উদ্বিগ্ন। অথচ বিজেপির নেতানেত্রীদের তাতে কিছু যায় আসে না, ভাষণে মগ্ন থাকতে পারলেই তাদের দুনিয়া গেরুয়া।

দশবছর মোদি রাজত্বে প্রায় প্রতিটা অধিবেশনই ছিল একপেশে। চোখের পলক পড়ার আগেই পাশ হয়ে গিয়েছে বিল। আইন প্রণয়ন এমনকী বিরোধী নেতা-নেত্রীদের বক্তব্য রাখার সময় প্রধানমন্ত্রী নিজের অহংকে চরিতার্থ করতে বহু ক্ষেত্রেই কক্ষে হাজির পর্যন্ত হননি। সংসদ ভবনে নিজের অফিসে বসেই নজর রেখেছেন। তখন লোকসভায় তাঁর শুধু একক গরিষ্ঠতাই ছিল না, ৩০৩ আসন জেতার মধ্যে কাউকে পাত্তা না দেওয়ার একটা আশ্চর্য গরম ছিল। এবার ৬৩টি আসন কমে তা হয়েছে ২৪০। তাতেই সরকার টলমলে, শীতল। নতুন নতুন ক্রাচের খোঁজে মরিয়া শাসক। চেঁচামেচি, বাদানুবাদ, টানাপোড়েনও চরমে পৌঁছেছে। ২৮০ জন নতুন এমপি এসেছেন ঠিকই, কিন্তু নারী সংরক্ষণ বিল পাশ করালেও শাসক দল নিজেও এক-তৃতীয়াংশ মহিলা প্রার্থী দাঁড় করায়নি। অষ্টাদশ সংসদীয় অধিবেশনে মোট নির্বাচিত মহিলা এমপির সংখ্যা ৭৮ থেকে কমে ৭৪ হয়ে গিয়েছে। শতাংশের হিসেব ছেড়ে দিন, শাসক দলের কোনও মুসলিম এমপিই নেই। এতেই বোঝা যায়, মোদি সরকার আসলে কী চায়। আসলে তারা কী করছে।

Latest article