হারানো দিনের স্মরণীয় নায়িকা,অতল জলের আহ্বান ছবির তন্দ্রা বর্মন

বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের নায়িকাদের তালিকা অন্তহীন। যে-যুগের আর এক উল্লেখযোগ্য শিল্পী হলেন অভিনেত্রী তন্দ্রা বর্মন। তাঁর কেরিয়ার ছিল স্বল্পদিনের। তবুও তার মধ্য দিয়ে তিনি মেলে ধরেছিলেন নিজের অসামান্য অভিনয় প্রতিভা। তাঁকে নানা কথায লিখলেন ড. শঙ্কর ঘোষ

Must read

কথামুখ
জজ সাহেব বসন্ত সান্যালের এজলাসে একটি ডাকাতি মামলার কেস চলছে। আসামি শশাঙ্ক মণ্ডল নির্দোষ এ কথা জানত শশাঙ্কের স্ত্রী রাধা। আইনের চোখে শশাঙ্ক দোষী সাব্যস্ত হলেন। বহু বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড। রাধা আত্মঘাতী হলেন। সনাতন নিয়ে এল শশাঙ্কের মা-মরা মেয়েকে জজসাহেবের কাছে। শিশুটিকে বুকে তুলে নিলেন জজসাহেবের পুত্রবধূ জয়ন্তী। নাম রাখলেন মায়া। মায়া বড় হয়ে উঠলেন। প্রেমিক হয়ে তাঁর জীবনে এসেছেন সুবিমল। দুজনের মধ্যে মাঝেমধ্যেই ডিবেট হয় মানুষের জন্ম-পরিচয় বড়, না মানুষ হিসেবে তার পরিচয়— এই নিয়ে। মায়া বোঝাতে চান জন্মের পরিচয়টাই বড়। সুবিমল সেটা মানেন না। ভাগ্যের পরিহাস যে মায়া জানেন না যে তাঁর জন্ম পরিচয় অন্ধকারে ঢাকা। এক অপরাধীর কন্যা সে। মায়া যখন তাঁর প্রকৃত জন্মপরিচয় জানলেন তখন সুবিমলকে সবকিছু খুলে বললেন। মায়া তাকে ভুলে যেতে বললেন। আড়াল থেকে সব শুনলেন শশাঙ্ক। ছাড়া পাওয়ার পর আজই শশাঙ্ক এসেছিলেন বসন্ত সান্যালের কাছে মেয়েকে নিয়ে যাবেন বলে।

আরও পড়ুন-রূপচর্চার রানিরা

আজ মেয়ে বাবাকে কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করলেন। বাবা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে তাঁর স্নেহের ঝর্না বইয়ে দেন। জয়ন্তী ঠিক করলেন মায়াকে শশাঙ্কের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু শশাঙ্ক মেয়েকে চিঠি লিখে রেখে নিরুদ্দেশ হলেন। জানালেন মেয়ের ভবিষ্যৎ-সুখের জীবন নষ্ট করার কোনও অধিকার তাঁর নেই। মায়ার কাছে তখন সত্যিকারের জন্মপরিচয় আর বর্তমানের এই পরিচয় একাকার হয়ে গেছে। এমন মর্মস্পর্শী গল্পটি লিখেছেন জরাসন্ধ। নাম ‘ন্যায়দণ্ড’। পরিচালক মঙ্গল চক্রবর্তী। বহু নামীদামি শিল্পীই রয়েছেন এ ছবিতে। অরুন্ধতী দেবী, রাধামোহন ভট্টাচার্য, অসিতবরণ, ছায়াদেবী, তরুণকুমার, রবি ঘোষ অভিনীত এই ছবিতে মায়ার চরিত্রের রূপকার তন্দ্রা বর্মন। নামীদামি শিল্পীদের মাঝে হারিয়ে গেলেন না তন্দ্রা। ফুটিয়ে তুললেন মায়া চরিত্রকে। যে মুহূর্তে মায়া জানালেন তাঁর প্রকৃত পরিচয় সেই মুহূর্তে তন্দ্রা বর্মন সত্যই তুলনাহীন। তন্দ্রার অভিনয়ে সমৃদ্ধ হয়ে আছে ন্যায়দণ্ড ছবিটি।

আরও পড়ুন-যে লেখিকা ম্যাজিক জানেন, জোয়্যান রোওলিং

জন্মকথা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
তন্দ্রা বর্মনের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর হুগলির সিঙ্গুরে। পিতার নাম নরেন্দ্রনাথ বর্মন। মায়ের নাম যমুনাদেবী। চেতলা গার্লস স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলেন। পারিবারিক কারণে আর পড়াশোনা হয়নি। চলচ্চিত্রে প্রথম সুযোগ পান বাবার বন্ধু হেমেন্দ্র মিত্রর ছবি ‘দুই তীরে’ কিন্তু মহরতের পরেই ছবির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর প্রযোজক গোবিন্দ বর্মন সুযোগ দেন ‘ভিজে বিড়াল’ ছবিতে। তিনি আশিস কুমারের বিপরীতে। এ-ছাড়া অনুপ কুমার সহ অনেক শিল্পী ছিলেন। সেই ছবিটিও নানান কারণে মুক্তি লাভ করেনি। তবে ইতিমধ্যে তিনি কাজ করেছেন ‘স্বপ্নপুরী’ ছবিতে এবং পরিচালক নীরেন লাহিড়ীর ‘তানসেন’ ছবিতে। তিনি নাচ শিখেছিলেন।

আরও পড়ুন-তিন কবির গান

প্রথম বড় সুযোগ
বাংলা ছবির প্রখ্যাত প্রচারবিদ ফণীন্দ্র পাল তন্দ্রা বর্মনকে নিয়ে গেলেন বিকাশ রায়ের কাছে। বিকাশ হয় তখন প্রমথনাথ বিশীর কাহিনি অবলম্বনে ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ ছবিটি নির্মাণ করতে চলেছেন। বিকাশ রায় নিজে মুন্সি রামরাম বসুর চরিত্রে, কেরী সাহেবের চরিত্রে ছবি বিশ্বাস। এ-ছাড়া পাহাড়ী সান্যাল, নীতীশ মুখোপাধ্যায়, মঞ্জু দে-সহ অসংখ্য শিল্পী। উপন্যাসটির একটি স্মরণীয় চরিত্রের নাম রেশমি। বিধবা হলে তাকে যেতে হবে সহমরণে। সব আয়োজন সম্পন্ন। দৈবক্রমে তাঁকে উদ্ধার করেন ইংরেজ যুবক জন। পাশ্চাত্য রীতিতে দীক্ষিত হয়ে ওঠেন রেশমি। রেশমি ও জন দুজনে দুজনের কাছাকাছি এলেন কিন্তু রেশমির জীবনে সুখ নেই। তিনি অপহৃতা হন। মতি রায়ের বাগানবাড়িতে বন্দিনী রেশমি। মুক্তির পথ তাঁর জানা ছিল। নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে পুড়ে মরলেন রেশমি। এমন জটিল চরিত্রের জন্য বিকাশ রায় খুঁজছিলেন একজন নতুন শিল্পী। সেই সময় যোগাযোগ হল তন্দ্রা বর্মনের সঙ্গে। স্ক্রিন টেস্ট নেওয়া হল। উত্তীর্ণ হলেন। রেশমির চরিত্রে তাঁর অভিনয় দর্শকের মনে দাগ কাটল।

আরও পড়ুন-সেরা লিস্টন-কিয়ান, মঞ্চে অমর একাদশের পরিবার

সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজ করেও বাদ
এই সময় একটি অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। সত্যজিৎ রায় ‘অপরাজিত’ ছবির জন্য তন্দ্রা বর্মনকে নিলেন। পুরো শুটিং করেছেন সত্যজিৎ রায়। কিশোর অপুর প্রেমিকার চরিত্রটি। নাম মিলি। সেই চরিত্রের ফাইনাল এডিটিংয়ের সময় পুরো চরিত্রটা বাদ দিলেন সত্যজিৎ রায়। একমাত্র সর্বজয়া ছাড়া কোনও ফিমেল ক্যারেক্টার ছবিতে রাখবেন না বলে ‘অপরাজিত’ ছবিতে তাঁর অভিনীত দৃশ্যগুলি বাদ দেওয়া হয়।
সাফল্যের সোপান
অজয় কর তন্দ্রা বর্মনকে ডাকলেন তাঁর নির্মীয়মাণ ‘অতল জলের আহ্বান’ ছবির জন্য। প্রতিভা বসুর গল্প। এক অভাগিনীর গল্প। সেই অভাগিনী আশ্রয় পেয়েছিলেন ডাক্তার জয়ন্ত চৌধুরির (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) বাড়িতে। জয়ন্তের বাবা সীমন্ত চৌধুরি (ছবি বিশ্বাস)। ঘটনাচক্রে জয়ন্ত জানলেন যে সীমন্ত চৌধুরির প্রাক্তন প্রেমিকা অনুরাধা (ছায়াদেবী)। অনেক নাটক। অনেক শিল্পী। সবাই তুখোড়। তবু অভাগিনী নায়িকার চরিত্রে নীরব অভিব্যক্তি এবং অল্প সংলাপের মধ্য দিয়ে চরিত্রটির প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলেন তন্দ্রা বর্মন। এই ছবিতে তন্দ্রা বর্মনের লিপে ব্যবহৃত গান ‘ভুল সবই ভুল এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা— সে ভুল’ (গায়িকা সুজাতা চক্রবর্তী), শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রেখেছে আজও। ‘অতল জলের আহ্বান’ তন্দ্রা বর্মনের শ্রেষ্ঠ ছবি ।

আরও পড়ুন-আন্তর্জাতিক বাঘ দিবসে শুভেচ্ছা বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর

অন্যান্য কাজ
বিশ্বজিৎ-এর বিপরীতে তন্দ্রা এলেন ‘এক টুকরো আগুন’ ছবিতে। পরিচালক বিনু বর্ধন। সেখানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান ‘ওগো মোর প্রিয় বন্ধু’ আজও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রেখেছে। অনিল চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে তন্দ্রা বর্মন নায়িকা হলেন ‘দুই বাড়ি’ ছবিতে। পরিচালক অসীম পাল। ইতিমধ্যে আশিস কুমারের বিপরীতে ন্যায়দণ্ড ছবিতে তিনি নায়িকা। মঙ্গল চক্রবর্তী পরিচালক। ‘আমি রতন’ ছবিতেও তন্দ্রা বর্মনের বিপরীতে আশিস কুমার নায়ক। পরিচালক অজিত বন্দোপাধ্যায়। অসিতবরণের বিপরীতে ‘সেবা’ ছবিতে তন্দ্রা বর্মন। উত্তমকুমারের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘মঞ্জরী অপেরা’ ছবিতে। পরিচালক অগ্রদূত। কাহিনিকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। সন্দেহপ্রবণ স্ত্রীর চরিত্রে বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছিলেন। তাঁর কাজ ষাটের দশক জুড়ে। চরিত্র পছন্দ না হলে সেই চরিত্রে তিনি অভিনয় কখনই করতেন না। তপন সিংহ যখন ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ করছেন তখন ডেকেছিলেন তন্দ্রা বর্মনকে ‘পাখি’ চরিত্রের জন্য। পাখি চরিত্রটি পছন্দ হয়নি বলে তিনি গ্রহণ করলেন না। সেই চরিত্রটি অবশেষে করলেন ‘অতল জলের আহ্বান’ ছবির সহ-নায়িকা রঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন-সেরা লিস্টন-কিয়ান, মঞ্চে অমর একাদশের পরিবার

শেষের কথা
হঠাৎ করে ছবির জগৎ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তন্দ্রা বর্মন। বিয়ে করে স্বামী-পুত্র নিয়ে তাঁর তখন সুখের সংসার। অন্য জগৎ। পেশাদারি মঞ্চ, যাত্রা, ছোট-পর্দা— কোনও কিছুর হাতছানিতে সাড়া দেননি। শেষ জীবনটা কাটিয়ে ছিলেন গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউতে হিন্দ সিনেমার পাশের একটি ফ্ল্যাটে। সেখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে ওরাল ক্যান্সারে ২০১৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড— পরের দিন কিন্তু কোনও পত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হয়নি। বেশ কয়েকদিন বাদে একটি স্বনামধন্য পত্রিকায় সম্পাদক সমীপেষুতে জনৈক পাঠক লিখলেন তন্দ্রা বর্মনের মৃত্যুর কথা। তখন মনে হয় ‘অতল জলের আহ্বানে’র সেই গানটির অন্তরা অংশের কথা যা তাঁর জীবনে সত্যি হয়ে গেছে— ‘চলে গেলে ডাকবে না তো কেউ পিছু /স্মৃতি আমার থাকবে না তো আর কিছু/ যদি ভাবি এই আমি আর নই একা সে ভুল/ভুল সবই ভুল।’

Latest article