সংবিধান প্রণেতারা ভারতবর্ষের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে কখনওই এমন ব্যবস্থা রাখেননি যাতে কেন্দ্রীয় সরকার অতিশক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। কেবল আপৎকালীন পরিস্থিতিতেই এমনটা হতে পারে। বরং বলা যেতে পারে, ভারতের সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্রীয় সরকারকে অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কথা বলে। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙেঘর মতাদর্শপুষ্ট বিজেপি-শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বারবার একতরফা নীতিনির্ধারণের অভিযোগ বিভিন্ন সময় পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিভিন্ন অ-বিজেপি-শাসিত রাজ্যসরকারগুলি করছে। এবং এই অভিযোগ আদৌ ভিত্তিহীন নয়।
আরও পড়ুন-পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করলেন পিকে
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে রীতিমতো তুড়ি মারার কাজটা শুরু হয় মোদি-জমানার শুরু থেকেই। বাংলা দখলের স্বপ্নে বুঁদ হয়ে ছিল আরএসএস এবং বিজেপি। স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি। ফলে মোদি সরকার বাংলার রাজ্য সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রীয় অতিসক্রিয়তাকে হাতিয়ার করে বাগে আনার খেলায় নেমেছে। কখনও কেন্দ্র-নিযুক্ত রাজ্যপাল দ্বারা বা কখনও কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের ধুয়ো তুলে এ-কাজ তারা করছে। প্রতিশোধস্পৃহা বাড়তে বাড়তে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি-আক্রমণের রূপও নিয়েছে। আর তারই মাশুল গুনতে হয়েছে বাংলার জনগণকে। জিএসটি-র ন্যায্য পাওনা থেকে বাংলাকে উপেক্ষা করা এবং বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সরিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত এরই ফলশ্রুতি। সবকিছুতেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে শিকেয় তুলে নির্লজ্জ একপেশে পদক্ষেপ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। সবচেয়ে লক্ষণীয়, রাজ্যপালের কেন্দ্রের এজেন্ট হিসেবে অতিসক্রিয়তা।
রাজ্যপাল জগদীপ ধনকখড়ের অত্যুৎসাহী মনোভাব। সংবিধানসভা বা গণপরিষদ আগাগোড়াই রাজ্যপাল পদটিকে নামসর্বস্ব প্রধানের তকমা দিয়েছে আর প্রকৃত শাসন ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার মুখ্যমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত করেছে। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে দেখছি, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল মহোদয় বারবার নির্বাচিত সরকারকে জনসমক্ষে বেকায়দায় ফেলার সবরকম চেষ্টা করে চলেছেন। অন্যদিকে, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে রাজ্যপালদের অতিসক্রিয়তা দূরের কথা বরং অতিনিষ্ক্রিয়তা চোখে পড়ার মতো। বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশে যখন একের পর এক প্রশাসনিক ব্যর্থতা— দলিত শ্রেণি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং নারীর সুরক্ষার প্রশ্নে, তখন সেখানকার রাজ্যপালকে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপালের মতো জনসমক্ষে বা সামাজিক মাধ্যমে কোনও বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি। তা হলে বাংলায় যুক্তরাষ্ট্রীয় অতিসক্রিয়তা মিথ্যা অভিযোগের পশরা সাজান কোন বিশেষ উদ্দেশে? অতিমারির সময়েও মোদি সরকার বিমাতৃসুলভ আচরণ করা থেকে একমুহূর্তের জন্যও বিরত থাকেনি। বাংলাতে টিকার জোগান তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এমনকী করোনা-সংক্রান্ত মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠকে বাংলা তার দাবিদাওয়া তোলার সুযোগটুকুও পায়নি। এ-রাজ্যে করোনা আবহের মধ্যেও মোদিবাহিনী বড় বড় জনসভা করেছে। হাস্যকরভাবে, আবার সেই মোদি-সরকারই পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্য সচিবের বিরুদ্ধে বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ তুলেছে।
এরকম অহেতুক যুক্তরাষ্ট্রীয় টানাপোড়েন সৃষ্টি যে নেহাতই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে এবং পরে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে রাষ্ট্রপতি শাসনের কথা বলার মধ্যেও ওই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে ফেলার আয়োজন স্পষ্ট। রাজ্যপালদের সম্মেলনে মোদি সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বুলি আওড়ালেও আদতে তাঁর সরকার বিভিন্ন সময়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার সুযোগে পেশিশক্তির আস্ফালন যে প্রদর্শন করে চলেছে, তা বলা বাহুল্যমাত্র। যে স্বৈরাচারী কায়দায় জম্মু এবং কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল হয়েছে, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বিধানসভায় কোনওরকম আলোচনা ছাড়াই, তার পরেও জম্মু-কাশ্মীরের প্রায় সমস্ত বিরোধী নেতাকে গৃহবন্দি করা হয়েছে, সেটাও যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় কুঠারাঘাত। সর্বসম্মতিভিত্তিক রাজ্য-কেন্দ্র কাঠামোর যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিশাসনের ব্যবস্থা সংবিধানের পাতায় জ্বলজ্বল করলেও তা মোদি-সরকার অবিরত খাটো করার প্রচেষ্টায় অব্যাহত। তার নিদর্শন, নোট বাতিলের মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত বা আচমকা সারা দেশে লকডাউন জারি।
একইভাবে নাগরিক সংশোধন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও রাজ্যগুলোর পরামর্শ উপেক্ষা করে নির্দেশ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার মধ্যেও মোদি-সরকারের আস্ফালন চোখে পড়ার মতো। বাংলার সরকারকে বারেবারে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে মোদি-শাহ জুটির পর্যদুস্ত হওয়ার পরেও নজিরবিহীনভাবে চোখে পড়ছে। ভারতের সংবিধান কেন্দ্র-রাজ্য মেলবন্ধনের কথা বললেও, বিজেপির হিন্দুত্ববাদী সরকার ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের পক্ষেই কাজ করেছে। সাম্প্রতিককালে, ইজরায়েলি বেসরকারি সংস্থা এনএসও-র পেগাসাস ব্যবহার করে বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের ওপর নজরদারি চালানোর অভিযোগ উঠেছে।
আরও পড়ুন-ত্রিপুরায় মানুষের মহাজোট, নেতৃত্বে মমতা-অভিষেক সেনাপতি: কুণাল
বিরোধী দলগুলো এ নিয়ে তদন্ত চাইলেও মোদি-সরকার তদন্ত করা তো দূর অস্ত্, পুরো বিষয়টিকে চক্রান্ত বলে উড়িয়ে দিয়েছে। আলোচনাতেও তাদের আপত্তি। বাংলার সরকার ঐতিহাসিকভাবে পেগাসাস নিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করে রাজধর্ম পালন করলেও কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজধর্ম পালন করেনি। বিজেপি-র ডাবল ইঞ্জিন সরকারের প্রতি অতি আসক্তি থেকেও বেশ পরিষ্কার যে অ-বিজেপি-শাসিত রাজ্য সরকারগুলির প্রতি তাদের উদাসীনতা ও উপেক্ষার মনোভাব কতটা বিপজ্জনক। বলাই বাহুল্য, এরকম পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় উদারনৈতিক গণতন্ত্রের কাঠামোটাকেই একদিন ভেঙে ফেলতে পারে। তাই জোটবেঁধে এদের হারানোই ভারতরক্ষার একমাত্র পথ।