সুদীপ্তা রায় চৌধুরী মুখোপাধ্যায়: ঝুপড়ি আর স্কাইস্ক্যাপারের মাঝে বেখাপ্পা লটকে থাকা ভূখণ্ড আমার দেশ। ভারতবর্ষ। যার শরীরে পেট্রোডলারের ছ্যাঁকা, সাব-অল্টার্ন রুটির ঘ্রাণ। এখানে কুচকাওয়াজ আর শাসকের বজ্র আওয়াজের মাঝে তেরঙায় মুড়ে যে হেরিটেজ ফেস্টিভ্যাল পালিত হয়. স্বাধীনতা দিবস তার ডাকনাম। চারিদিকে বিকট সুরে দেশাত্মবোধক গান বাজিয়ে, ভুল তথ্য সহযোগে লালকেল্লার ভাষণ শুনিয়ে, বাজারে অজস্র ছাড় অফারের সম্ভার নিয়ে, রাজভবনের চা চক্রের সাক্ষী থেকে এই শ্রাবণী ‘ছুটির দিন’ দিব্যি ৭৫-এ পা দিল।
আরও পড়ুন- বিজেপি মন্ত্রী এখন জনবিচ্ছিন্ন জনপ্রতিনিধি
কিন্তু বাকি ৩৬৪ দিনের রোজ নামচার খবর? রাষ্ট্র পাহারায় নতজানু থেকে একই সাথে শিহরিত ও ভীত হওয়ার যে বিপন্ন কাহিনি প্রতিনিয়ত লেখা হচ্ছে তার কোনো সূক্ষ্ম বা স্থূল ব্যাখ্যা কি শাসক কোনও দিনও দেবে? নাকি শাসকের চরণে অর্পিত ফুল বেলপাতা সরিয়ে তত্ত্ব নিরপেক্ষ ডিসকোর্স আজকের স্বাধীন ভারতে নেহাতই এক রূপকথা?
অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় যে সংবিধান গৃহিত হয়েছিল তার ১৯ নং ধারা “বাক স্বাধীনতা” ২১ নং ধারা “ব্যক্তিস্বাধীনতা” সুনিশ্চিত করেছিল। কিন্তু গত সাত বছরে বাক স্বাধীনতার হাল দেখে বলতে হয় বিরুদ্ধমত মানেই এদেশে কেন্দ্রীয় শাসকের চোখে বিদ্রোহের ডাক। এ ভাবনা অসুস্থ্ মনের ফসল। খানিকটা নিরাপত্তাহীনতারও। সবটা এখনও দখল হয়নি, এই ভয় থেকেই কী বর্তমানের কেন্দ্র সরকার দ্রোহ আর বিদ্রোহের বিভেদ গুলিয়ে ফেলছে!
আরও পড়ুন- তফশিলি-অনগ্রসর কল্যাণে বড় ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর
১৯২৮ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রক্তকরবী’ নাটকে যে বদ্ধ রাষ্ট্রের কথা বলেছেন তার সাথে পরাধীন ভারত, হিটলারের জার্মানি, স্তালিনের রাশিয়া আর আজকের ‘স্বাধীন’ ভারতের কী আশ্চর্য মিল! ১৯৩০ সালে প্রকাশিত ‘রাশিয়ার চিঠি’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রশংসা করেছিলেন, সাক্ষাৎকারের যে অংশে তা ছাপা হয়েছিল সোভিয়েত রাশিয়ার ‘ইজভেস্তিয়া’ পত্রিকায়। আর যে অংশে তিনি বিরুদ্ধ মতবাদীদের সাথে যে আচরণ রাষ্ট্র করছে তা “চিন্তার কারণ” হবে বলায় ওই অংশ বাদ দেওয়া হয়েছিল। ঠিক যেন আজকের মোদি-শাহ শাসিত ভারত ।
আরও পড়ুন- দু’সপ্তাহের ছুটি , এএফসি নকআউটে নতুন দল বাগানের
জগদ্বিখ্যাত স্প্যানিশ কবি লোরকাকে হত্যা করে দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ট শক্তি। ভারতে গৌরী লঙ্কেশ বা কালবুর্গীর একই পরিণতি দেখা যায়। হিটলারের জার্মানি থেকে ব্রেশট পালাতে পেরেছিলেন, কিন্তু মোদীর ভারতে অশীতিপর কবি ভারভারা রাওকে দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ রাখা হয়। রাশিয়ার কবি মান্দেলস্তামকে সন্দেহবশত গ্রেফতার করে সাইবেরিয়ায় পাঠানো হয় কোনো রকম শীতবস্ত্র ছাড়া। সেখানেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। একই পদ্ধতি অবলম্বন করে ভারতে সমাজকর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামীকে সিস্টেমের মধ্যে রেখে হত্যা করা হয়। স্ট্যান স্বামীর শক্ত খাদ্য গলাধঃকরণ করতে একটি যন্ত্র প্রয়োজন হত যা তাঁর কারাবাসকালে তাঁকে দেওয়ার জন্য কোর্টের কাছে আবেদন করেন যেদিন মঞ্জুর হয় সেদিনই মারা যান। মান্দালস্তামের পরিবারও একইভাবে অসুস্থ্ কবির জন্য আবেদন করেছিলেন শীতবস্ত্রের। তা যখন মঞ্জুর তখন কবি তার ঊর্ধ্বে।
ঔপনিবেশিক ভারতে কায়েম করা আইপিসি ১২৪(এ) ধারাটি রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা সিডিশন আইন নামে পরিচিত ছিল। মহাত্মা গান্ধী যাকে ‘প্রিন্স অফ দ্য আইপিসি’ বলতেন, সেই আইন ব্রিটেনেই ২০০৯ সালে অবলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু এ দেশে আজও বলবৎ আছে। এই আইন পরাধীন দেশে গান্ধী, তিলক, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় প্রমুখের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হয়েছিল। আর স্বাধীন ভারতে এর বলি হন বিনোদ দুয়া, রাজদীপ সরদেশাই সহ আরও অনেকে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ইউএপিএ ধারার অপপ্রয়োগ। জার্নালিস্ট কাপ্পান সিদ্দিকি, মণিপুরে এনএসএ ধারায় অভিযুক্ত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি আর এক জার্নালিস্ট। এছাড়া ‘পিঁজরা পোল’ আন্দোলন দেবাঙ্গন কলিতা। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটির গর্ভবতী ছাত্রী সফুরা জারগার, কৃষি আইনের বিরোধিতা করা নদীপ কাউর।
আরও পড়ুন- বিশ্বভারতী-কাণ্ডে উপাচার্যকে ঘেরাও করার পরিকল্পনা
নির্বাচিত স্বৈরশাসক যদি তালিবানের আদলেই গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে, তবে স্বাধীনতা আদতে রোমান হরফে লেখা ‘Swadhinata’ অর্থাৎ স্বাদ হীনতা হয়ে যায়। তাই নয় কী! কবি ঋজুরেখ চক্রবর্তীর ভাষায় “যাবতীয় স্বৈরাচার কহে এক গতে/ আমার সন্ত্রাস যেন থাকে ধর্ম মতে”।