অশোক মজুমদার: হাতেগোনা মাত্র ক’দিন… কলকাতার রাজপথে একত্রিশ বছর ধরে একুশে জুলাইয়ের ধারাবাহিক জনধারা সুনামির মতো আবারও আছড়ে পড়বে। বছরকার এই দিনটি তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক বার্ষিক তর্পণ। এই দিনেই তিনি তাঁর লক্ষ লক্ষ কর্মী-সমর্থকদের আগামীর বার্তা দেন।
আরও পড়ুন-গুরু ও পূর্ণিমা
আমার জানা নেই, পৃথিবীতে মে দিবস আর ভাষা দিবস ছাড়া আর কোনও সামাজিক আন্দোলনের বার্ষিকী এইভাবে পালন করা হয় যেখানে স্মৃতি হয়ে আছে মৃত্যু। আর এই দুটি দিবসের ব্যাপকতা এতটাই যে গোটা বিশ্বের কাছে দিন দুটির গুরুত্ব অপরিসীম।
একুশে জুলাই সেই জায়গায় একটি রাজ্যভিত্তিক জনসম্মেলন হলেও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এমন উদাহরণ সত্যিই বিরল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক এখানেই পার্থক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন বাকি দেশের সঙ্গে নিজের রাজ্যের। যাঁর একডাকে বছরের এইদিন কলকাতার পথে মিছিল করে হাঁটে জেলায় জেলায় থাকা তাঁর অনুগামীরা।
আরও পড়ুন-তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ
এই যে আজ গোটা দেশের কোটি কোটি মানুষ ভোট দিতে যায় যে পরিচয়পত্র হাতে সেই পরিচয়পত্রের দাবিতেই তিন দশক আগে ১৯৯৩ সালের একুশে জুলাইয়ের মিছিলে পুলিশের গুলিতে তেরোজন মারা গিয়েছিল। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আহত হয়েছিলেন মারাত্মক। সুস্থ হতে লেগেছিল বহুদিন। তার পর থেকেই কংগ্রেস থেকে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন হলেও ধর্মতলা চত্বরে প্রতিবছর একুশে জুলাই পালিত হয় একইরকম আবেগের বিচ্ছুরণে। এটা শুনতে বা লিখতে খুবই সাধারণ মনে হলেও আমরা যারা চাক্ষুষ করে আসছি বছরের পর বছর তারাই বুঝতে পারি লক্ষ লক্ষ মানুষের জনসমাবেশে ওইদিন কলকাতা প্রায় অবরুদ্ধ থাকে। ভিড় যেন প্রতি বছরের রেকর্ড নিজেই ভাঙে।
সারাবছরের একটা দিনও কলকাতামুখী না হয়েও একুশে জুলাই কিসের টানে তাহলে এরা জড়ো হয়? আগেরদিন রাত থেকে বৃষ্টি বাদল যাই হোক, মূল মঞ্চের সামনে বসে থাকে ওরা কেন? এর উত্তর একটাই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হ্যাঁ, এই মানুষটির জন্যই কাতারে কাতারে লোক হাজির হয়। বাসে, ট্রেনে, গাড়িতে যে যেভাবে পারে গন্তব্য একটাই— ধর্মতলা। বহু বছর ধরে সমালোচকরা স্বভাবতই বলে আসছেন এরা সব গ্রামের লোকজন কলকাতা দেখতে আসে। চিড়িয়াখানা, জাদুঘরে ভিড় জমায়। বেশি বিপ্লবীরা এক সুর উঁচিয়ে এক তাচ্ছিল্য শব্দ সাজিয়ে বলে, ডিম্ভাত-এর লোভে আসে!
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
হাসিও পায় আজকাল এসব শুনে। ১৯৯৩ সালের একুশে জুলাই আমিও হাজির ছিলাম ধর্মতলায়। চাক্ষুষ করেছি সেদিনের ঘটনা। দেখেছি দিদিকে রক্তাক্ত। তারপর থেকে প্রতি একুশে আমিও হাজির হই। দেখি কাতারে কাতারে মানুষ বসে থাকে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি কিংবা তালুফাটা রোদ্দুর— কিছুই ওদের একচুলও নড়াতে পারে না যতক্ষণ না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্টেজে উঠে ভাষণ শেষ করছেন।
এরা কেউ বিশ, পঁচিশ বছর ধরে টানা আসছেন ধর্মতলায়। কী মনে হয় ডিম্ভাত-এর লোভে? বিরোধীদের রাজনৈতিক সংকট এমন ছন্নছাড়া অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে সাধারণ সমালোচনা করারও ভাষা কী হবে সেটারও খেই হারিয়ে একটা অযৌক্তিক শব্দের আমদানি করতে হচ্ছে যেটার সঙ্গে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাকে হেয়টা দৃশ্যতই স্পষ্ট।
হ্যাঁ, কিছু মানুষ একুশে জুলাই কালীঘাট মন্দির, চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, ভিক্টোরিয়া যেতেই পারে। এদের অনেকেই জীবনে কলকাতা আসেইনি কোনওদিন। তাদের কেউ কেউ যদি একটু ভিড় করে চিড়িয়াখানায় তাতে তো আর একুশে জুলাইয়ের মূল উদ্দেশ্যটা মিথ্যে হয়ে যায় না। একটা মানুষের ডাকে গোটা বাংলা থেকে লাখ মানুষ কলকাতামুখী এটাই সবকিছুর ঊর্ধ্বে বাস্তব। বাকিটা অনুসঙ্গ।
ঘটনা হচ্ছে, এসব বালখিল্য সমালোচনা ছাড়া কোনওদিনই আপনাদের মস্তিষ্ক এটা ভাবায় না, একটি ছোটখাটো পাঁচ ফুট উচ্চতার মেয়ের স্নেহ, মায়ার বিস্তৃতি জুড়েছে তাঁর রাজনীতির রক্তে। নাহলে এত মানুষ ফি বছর হাজির হতে পারে না। এই উৎসর্গতার জন্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাস করেন বাংলার মানুষের ঘরের ভিতর, তাদের রান্নাঘরে, তাদের বিকেলের এমনিই আড্ডায়। এই সহজ ভাবনা থেকেই একুশে জুলাইয়ে একটি একটি মানুষ জুড়ে হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ যাদের ভালবাসায় সিক্ত হয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রের মধ্যে সবথেকে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হয়ে সুভাষিত।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিলক্ষণ জানেন সেটা। তাই একুশের মঞ্চ একাধারে যেমন রাজনৈতিক সভা, অন্যদিকে আপামর বাংলার মানুষকে তাঁর পাশে থাকার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের কর্মসূচিও বটে। কারণ তিনি কখনওই নির্বাচনে সাফল্যলাভ করে বিজয় মিছিল করার নির্দেশ দেন না। সর্বদাই বলেন একুশে জুলাই সমবেত হয়ে শহিদ স্মরণ করেই উৎসর্গ করা হবে বিজয়। মানুষের জয় মানুষের মাঝেই উদযাপিত করার এক মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেছেন উনি একুশে জুলাইয়ের দিনে। ‘নো আইডেন্টিটি নো ভোট’-এর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একদিন তাঁকে দেশের রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে সামগ্রিকভাবে টেনে এনেছিল, সেই দিনটিই তাঁর জীবনপথ হয়ে উঠল। আসলে ১৯৯৩ সালের একুশে জুলাই বোধহয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির ধাত্রীভূমি। এখান থেকেই সেদিন তাঁর ভিতর থেকে জন্ম নেয় এক ভাবনা যা আন্দোলন হয়ে পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে, গঞ্জে, শহরের আনাচে-কানাচে।
আরও পড়ুন-২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফল উপভোগ করার, কিন্তু আত্মতুষ্টি নয়: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
একুশে জুলাইয়ের আঘাত তাঁকে এতটাই শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছিল যে শুধু জেদ আর সাহস সম্বল করে তিনি একের পর এক যত আন্দোলনের ডাক দিয়ে চলেন। তাঁর সেই দুর্দমনীয় আন্দোলনের সামনে একদিন যেমন একদিন চৌত্রিশ বছরের বাম শাসন ধরাশায়ী হয়েছে, তেমনি নরেন্দ্র মোদি অ্যান্ড কোম্পানির ভারত জয়ের চাকাকে আটকে দিয়ে লেজেগোবরে করে দিচ্ছেন বারেবার। এই হার না মানা মনস্তত্ত্ব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈশিষ্ট্য বলেই তিনি বলতে পারেন, আন্দোলনেই আমার জন্ম। যতদিন বেঁচে থাকব মানুষের অধিকার রক্ষার আন্দোলন করে যাব। একুশে জুলাইও তাই সম্পূর্ণ সমর্পণ মানুষের প্রতি। আবেগ-উচ্ছাস ও নেত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা এই দিনটিকে এক ইতিহাসের সাক্ষী করে তুলছে ক্রমশ।