চুপ, আন্দোলন চলছে!

সিবিআই বোফর্স থেকে শুরু করে কবিগুরুর নোবেল পদক উদ্ধার, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। কে না জানে, তদন্ত চালিত হয়েছে দিল্লির শাসকের মর্জিতে। এবার এই শহরের নির্যাতিতা ন্যায় বিচার পাবেন তো? প্রশ্নটা এড়াতে পারলেন না সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

আন্দোলন, কী জন্য?
ন্যায়ের দাবিতে।
কার বিরুদ্ধে?
অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আরজি কর (R G Kar Case) হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে নির্যাতন ও খুনের বিরুদ্ধে।
আর রোগী পরিষেবা যে এই আন্দোলনে রোজ খুন হচ্ছে, তার বেলা!
সে আর কী করা যাবে! সবই ওই কো ল্যাটারাল ড্যামেজ!
সেই ড্যামেজের নিট ফল কী?
শুনশান শহরের সরকারি হাসপাতাল। এসএসকেএম, এন আর এস, আরজি কর, চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল, মেডিক্যাল কলেজ।
ছবিটা কীরকম?
জরুরি বিভাগের সামনে দু’-চারটি পথ সারমেয় ছাড়া আর কিছুই নেই। সব একেবারে খাঁ খাঁ করছে। এই ছবি গত তিন-চারদিনের। নজিরবিহীন। ব্যতিক্রমী।
যেসব সরকারি হাসপাতালে একটি বেডের আশায় মাসের পর মাস অপেক্ষায় থাকতে হয়, একটি টেস্টের জন্য তারিখ মেলে তিনমাস পর, সেই এসএসকেএম, এন আর এস, আরজি কর, চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল, মেডিক্যাল কলেজে হাজারো আসন ফাঁকা। আউটডোরে লাইন নেই রোগীদের। টিকিট কাউন্টার তালাবন্ধ। এমার্জেন্সিতেও রোগী বেশ কম। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের ভিড় আচমকা উধাও!
কোথায় গেলেন রোগীরা?
জুনিয়র ডাক্তাররা পরিষেবা দিচ্ছেন না। তারপরেও ক’দিন নিরুপায় ও অসহায় মানুষ ছুটে এসেছেন এইসব সরকারি হাসপাতালে। কিন্তু সোমবার থেকে তাঁরাও নেই।
কেন?
আসলে ডাক্তারদের উপর আস্থা হারাচ্ছে মানুষ।
অসহায় শূন্যতা ছাড়া কিছু নজরে আসছে না। একদিকে রাম-বামের মিছিলের গর্জন। অন্যদিকে হাসপাতালেই গরিব মুমূর্ষু মানুষের অনুপস্থিতি। কেউ ছুটছেন বেসরকারি নার্সিংহোমে। ভরসা? স্বাস্থ্যসাথী কার্ড। আবার কেউ জেলা হাসপাতাল বা স্থানীয় চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে হত্যে দিচ্ছেন। এটাই এখন বাংলার চিত্র।
এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডে ৩৬টি বেড রয়েছে। সারা বছর মোটামুটি ২২ থেকে ২৪টি বেড ভর্তি থাকে। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে দশে।
একই অবস্থা আরজি করের। জরুরি বিভাগে ৫ জন রোগীও আসছেন কি না সন্দেহ! সেখানে ২ হাজার বেডের মধ্যে সিংহভাগ খালি।
ন্যাশনাল মেডিক্যালেরও এক অবস্থা।
মনে পড়ে যাচ্ছে লকডাউনের সময়কার কথা। জরুরি বিভাগের সামনে সারি দিয়ে পড়ে রয়েছে স্ট্রেচার। তার সামনেই অবস্থান পড়ুয়াদের।
ফুলবাগানে বি সি রায় শিশু হাসপাতাল। আউটডোর বন্ধ। অগত্যা স্থানীয় চিকিত্সককে ফোন করে ছুটছেন রোগী। লোক নেই। কারণ, সকলে জেনে গিয়েছেন এসে লাভ হবে না।
চিকিত্সকরা নিজেদের ভরসাযোগ্য করে রাখতে ব্যর্থ।
‘আরজি করে (R G Kar Case) যা হয়েছে, তা জঘন্য। অপরাধীর শাস্তি আমরাও চাই। আন্দোলন চলুক। এই আন্দোলনে আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। কিন্তু, রোগীদের অপরাধ কোথায়, একটু বলতে পারেন? সরকারি হাসপাতালে পরিষেবা পাওয়া যাচ্ছে না।’— জরুরি বিভাগের সামনে কাতর কণ্ঠে পরিষেবা স্বাভাবিক করার আর্জি জানাচ্ছেন রোগীর বাড়ির লোকজন।
কেউ স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতে হাসপাতালে এসেছেন। কেউ মাকে কিংবা বাবাকে। কেউ আবার ছেলে মেয়েকে। সরকারি হাসপাতালে পরিষেবা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন খোদ রোগী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরাই।
আরজি করে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় উত্তাল গোটা দেশ। এই পরিস্থিতিতে কলকাতায় গত আটদিন ধরে সবক’টি সরকারি হাসপাতালে আউটডোর পরিষেবা ব্যাহত। বিচারের দাবিতে কাজ থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। রোগী পরিষেবা তলানিতে এসে ঠেকেছে। ফিরে যাচ্ছেন হাজার হাজার রোগী। তারই জেরে গত কয়েকদিনে সরকারি হাসপাতালে আশ্চর্যজনকভাবে কমে গিয়েছে রোগীর সংখ্যা। হাসপাতাল চত্বর একেবারে ফাঁকা। আউটডোর বন্ধ। চিকিৎসার কারণে অনেককে প্রায়ই সরকারি হাসপাতালগুলোতে আসতে হয়। কিন্তু, কয়েকদিন ধরে যা চলছে, তা অমানবিক।
কেন অমানবিক?
হাসপাতাল (R G Kar Case) জরুরি পরিষেবার জায়গা। সেখানে কর্মবিরতি কেন? মানতে পারছেন না রোগীরা। শুধু তাই নয়, ধীরে ধীরে সরকারি চিকিৎসকদের উপর আস্থা হারাতে বসেছেন তাঁরা।
কর্মবিরতির কারণে চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে। শুধুমাত্র সিনিয়র ডাক্তাররা কাজ করায় ঠিক সময়ে চেক-আপ হচ্ছে না। মানুষ হাসপাতালে আসেন চিকিৎসার পাওয়ার জন্য। তাঁদের সেটাই কাজ। সেই পরিষেবায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে আন্দোলন করে কী লাভ? পিজি, এন আর এস, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ, বাঙ্গুর হাসপাতাল, সর্বত্র একই ছবি। সব জায়গাতেই ভোগান্তির ছবি।
রোগীরা সব কোথায় গেলেন?
ডাক্তারবাবুদের মূল্যবোধ?
অতি ক্রোধ ষড়যন্ত্রকারীদের সাহায্য করছে। মৃত চিকিৎসকের লাশের আগুনে ফুটছে আন্দোলনের কেটলিতে রাখা জল। পুড়ছে দায়বদ্ধতা। সামাজিক মূল্যবোধের ছাই উড়ছে চারিদিকে।
শিউরে উঠেছে বিবেক। রবীন্দ্রনাথের বাংলায় মানুষ কি দিন দিন পশু হয়ে যাচ্ছে? ডাক্তারের মর্মান্তিক পরিণতি আমাদের যত্নে লালন করা বাঙালি অস্মিতাকেই সজোরে আঘাত করেছে, রক্তাক্ত হয়েছে যাবতীয় বোধ, বুদ্ধি, অনুভূতি।
ঘটনাটা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে ক্রমাগত গুজব ছড়ানোও কম বড় অপরাধ নয়। কিছু একটা ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারলেই যেন তৃপ্তি! সামাজিক ব্যাধি ও মানসিক বৈকল্যের বিরুদ্ধে শুরুতে যে আন্দোলন ছিল ষোলোআনা অরাজনৈতিক, তাতে আকস্মিক রাজনীতির রং লাগা মোটেই অভিপ্রেত ছিল না। একের পর এক লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে বিরোধীদের ঘোলা জলে মাছ ধরার প্রবণতা কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। হরেক কিসিমের মিথ্যে ছড়িয়ে জনমানসে অবিশ্বাস তৈরি করাও শাস্তিযোগ্য।
এই কানাগলিতে সাধারণ ঘরের এক মেয়ের ধর্ষণ ও খুনের ইতিবৃত্ত পথ হারালে তার চেয়ে শোচনীয় পরিণতি আর কিছু হতে পারে না। তখন সুবিচার দেবে কে? দ্রুত বিচার করে ফাঁসি দিতে না পারলে নিষ্পাপ মেয়েটার আত্মা শান্তি পাবে তো! দোষীদেরই বা কী হবে?
প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল যে!

আরও পড়ুন- ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বেরতেই মিথ্যাচার ফাঁস

Latest article