ভাস্কর ভট্টাচার্য: এই তো সেদিনের কথা। ইতিহাসের বিচারে মাত্র ৪০ কি তার একটু বেশি বছরের কথা। ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে ‘সাবা ব্যাঙ্ক’ নামে একটা ছোট্ট জাহাজ সেই যে পাড়ি দিল নাসো বন্দর থেকে কিন্তু সে আর তার গন্তব্যস্থল আমেরিকার ডিনার-কি বন্দরে পৌঁছল না। যাকে বলে অদৃশ্য হয়ে গেল। গোটা একটা আস্ত জাহাজ চোখের নিমেষে হারিয়ে গেল! কী হল সেই জাহাজটির? তার সন্ধান আজও কেউ পায়নি। যদি আর একটু পিছিয়ে যায় সেই ১৯৪০ সালের দিকে তাহলে ঠিক এমন ভাবেই আরেক নিখোঁজের খবর আমরা দেখতে পাব। তবে সেটি জলে ভাসা জাহাজ নয় আকাশের উড়োজাহাজ। সেই উড়োজাহাজের সন্ধান পেতে সবাই উদগ্রীব হয়ে উঠলেও তারও সন্ধান মেলেনি। অর্থাৎ রহস্যের কিনারা হয়নি। সেই থেকেই মানুষের চোখ পড়ল বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলের (Bermuda Triangle) দিকে। বিশ্বের অন্যতম রহস্যময় স্থান। তাহলে আরও কয়েকশো বছর পিছিয়ে যাওয়া যাক। ১৭৫০-এর কথা। পাঁচখানা জাহাজ নিয়ে হাভানা থেকে স্পেনের দিকে রওনা হয়েছিলেন ক্যাপ্টেন ডন জুয়ান মানুয়েল ডি’বোলিনা। হাবানা বন্দর ছেড়ে ফ্লোরিডার দিকে জাহাজ চলেছে। একসঙ্গে চলল সেই দল। হঠাৎ প্রবল বেগে সামুদ্রিক ঝড়, ঘূর্ণি। সব ওলট-পালট হয়ে গেল সমুদ্রের রূপ। বলি না আর জাহাজ কোনক্রমে রক্ষা পেলেও বাকি চারটে জাহাজের আর কোনও হদিশ নেই। ৬২ বছর পরে আবার খবরের কেন্দ্রবিন্দুতে বারমুডা ট্রাঙ্গেল। ১৮৬২-র ৩১ ডিসেম্বর ‘পেট্রিয়ট’ নামের একটি জাহাজ রওনা দিয়েছিল সাউথ ক্যারোলিনা থেকে নিউইয়র্কের দিকে। সেই জাহাজ আর নিউইয়র্কে কোনওদিনই পৌঁছয়নি। কোথায় গেছে সেই জাহাজ তারও সন্ধান কেউ পায়নি। ক্যাপ্টেন জোশুয়া স্লোকাশ আমেরিকার নামকরা নাবিক। পালতোলা জাহাজে পৃথিবী ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা তার ছিল। সেই স্লোকাস ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ নভেম্বর জাহাজে পাড়ি দিয়ে আর ফেরেননি। রহস্যের কিনারা আজও হয়নি। ১৮৮০ সালে ‘আটলান্টা’র অন্তর্ধান রহস্য আজও ভুলতে পারেনি।রহস্যের কিনারা নিয়ে অসংখ্য লেখালেখি হয়েছে। ১৮৮০ সালের জানুয়ারি মাসে তিনশো নাবিক ও ক্যাডেট নিয়ে বারমুডা বন্দর থেকে ইংল্যান্ডের দিকে যাত্রা করেছিল। সেটাই ছিল শেষবার। তারও আর কোনও শেষ উত্তর মেলেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুদিন পর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর ফ্লোরিডার ফোর্ট লডারভেল নেভাল স্টেশন থেকে মহড়া দেবার জন্য আকাশে উড়েছিল পাঁচটি অ্যাভেঞ্জার টর্পেডো। বিমানগুলিও শেষ পর্যন্ত পথ হারিয়েছে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে মায়ামি সমুদ্রতটের মাইলখানেকের মধ্যেই হারিয়ে যায় উইচক্রাফট নামের ইয়ট। যেটা বলার, এই অঞ্চলে বারবার অনেক বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। তার কোনওটারই কোনও সন্ধান বা কিনারা হয়নি। এর রহস্য উদঘাটন না হলেও এক তরুণ বাঙালি কিন্তু সেই বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলের মধ্যে দিয়ে যাত্রা করে অদ্ভুত ভাবে বেঁচে ফিরেছেন। সেই বাঙালি তরুণের নাম তপন কুন্ডু। তিনি লিখেছেন, সেই সময় সমুদ্র ছিল সাংঘাতিক উত্তাল। ঠিক যে জায়গা থেকে বিমান ও জাহাজ অদৃশ্য হয়ে যায় সেই জায়গার কাছাকাছি যেতেই সমুদ্র শুধু উত্তাল নয় তাদের জাহাজের গতিও গিয়েছিল অনেক কমে। মনে হচ্ছে জাহাজকে কেউ পিছন দিকে টানছে। বিপদ কাটিয়ে তপনবাবু ফিরতে পেরেছিলেন ডাঙায়। ১৯৮৭ সালে সেই যাত্রার বর্ণনা তিনি লিখেছিলেন। তার অভিজ্ঞতার কথা কিন্তু অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে তিনি বা তাঁর জাহাজ সত্যিই বারমুডা ট্রাঙ্গেলের উপর দিয়ে গিয়েছিল তো? বারমুডা তার অভিশপ্ত আকর্ষণী ক্ষমতা হারিয়েছে। সব ছাড়িয়ে যে প্রশ্নের আজও কোনও সঠিক উত্তর মেলেনি বা রহস্যজনক হয়ে রয়েছে। কত মানুষ কত জাহাজ এই রহস্যময় বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলে (Bermuda Triangle) বিলীন হয়ে গেছে। রহস্যের জট খোলার অপেক্ষায় আজও সন্ধানীরা।
আরও পড়ুন: বিচিত্র সৃষ্টির রহস্য