মোদি জমানায় দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কব্জা করার প্রক্রিয়া শাসকীয় আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে এক লজ্জাজনক প্রকৌশল। যার ফলে বহুমাত্রিক গণতন্ত্রের দেশে একমাত্রিক আধিপত্য তথা এক অসহ্য কর্তৃত্ববাদ জায়গা করে নিচ্ছে। এর লক্ষ্য হল ‘এক দেশ, এক পার্টি’র শাসন প্রতিষ্ঠা । লিখছেন পূর্ণেন্দু বসু
আরও পড়ুন-হাওড়ায় চালু হচ্ছে চেয়ারম্যান অন কল
একাধিপত্যকামী নরেন্দ্র মোদি সিবিআই, এনআইএ, ইডি, আয়কর বিভাগ এবং বন্ধুমনোভাবাপন্ন পুলিশ বাহিনীর লোকজনকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের পিছনে লাগিয়ে দিচ্ছেন। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে পাওয়া হিসাববহির্ভূত হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যবহার করে শাসকদল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ন’টি রাজ্য সরকারের পতন ঘটিয়েছে। বিজেপির পক্ষে মানানসই করে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো হয়েছে, যাতে তাদের নির্বাচনী রণনীতিকে সফল করা যায়। এর আগে এই মাত্রার দেশজোড়া একাধিপত্য দেখা যায়নি।
আরও পড়ুন-নিউটাউনে এবার স্মার্ট ফুটপাথ
এই আধিপত্যবাদী মনোভাব নিয়ে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে এক হাস্যকৌতুকে পরিণত করা হয়েছে। ক্ষমতাপ্রিয় মোদি চান না অন্যের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগাভাগি হোক। তাই বারংবার তিনি অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে রাজ্যের এক্তিয়ারে দখলদারি করেছেন। কখনও কৃষি আইনের ক্ষেত্রে, কখনও-বা জিএসটি আইন লাগু করার ক্ষেত্রে কিংবা আইন করে দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে কার্যত ‘সরকার’ বানিয়ে দিয়ে! অর্থ কমিশনের অধিকার খর্ব করে রাজ্যের ন্যায্য পাওনা থেকে রাজ্যগুলিকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। রাজ্যগুলিকে প্রতিশ্রুতি-মতো জিএসটির বকেয়া দিচ্ছে না কেন্দ্র। মোদি সরকার এবং তাঁর দল বিজেপি-র মুখ কালো হয়, এমন কোনও রাজ্য পুলিশের তদন্তকাজকে পাশ কাটিয়ে এনআইএ, সিবিআই এবং ইডিকে তদন্তভার দিয়ে দিচ্ছে।
আরও পড়ুন-নিউটাউনে এবার স্মার্ট ফুটপাথ
আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়— এ-কথা মানছে না মোদি-শাহরা। রাজ্যের ক্ষমতায় বারবার এই হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। রাজ্যের প্রতিবাদে কর্ণপাত করেছে না মোদি-প্রশাসন। করোনা- মোকাবিলায় ঔপনিবেশিক বিপর্যয় মোকাবিলা আইনকে ব্যবহার করে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকার (পড়ুন মোদি) হস্তগত করেছে। এক্ষেত্রে রাজ্যগুলিকে নীতি নির্ধারণ, কার্যকারী মোকাবিলার বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণ, টিকা উৎপাদন, বিক্রি বা বণ্টনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। যখন কেন্দ্রের ভয়ঙ্কর অযোগ্যতা এবং চরম ঔদ্ধত্যের বেলুন ফেটে গেল, তখন নরেন্দ্র মোদি দায় চাপিয়ে দিলেন রাজ্যগুলির উপর। এর পরেও তিনি এই প্রত্যাশায় রইলেন যে, রাজ্যগুলি তাঁর শর্তেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। অথচ এই নরেন্দ্র মোদিই বিভিন্ন সময়ে পাঠানো রাজ্যগুলির সহযোগিতার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছেন করেছেন।
আরও পড়ুন-‘ভারতীয়’র হাতে বন্দি ভারতের জয়, পিচ চরিত্রে অবাক দ্রাবিড়
নরেন্দ্র মোদি এমনই এক শাসক যিনি সরকারকে গাইড করা বা পরামর্শ দেওয়ার জন্য যে-সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সংবিধান মেনে তৈরি হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলিকে তাঁর হুকুম তামিল সংস্থায় পরিণত করেছেন। শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠানগুলি সেতুর কাজ করে, তাদের কাজে হস্তক্ষেপ ঘটিয়ে সাংবিধানিক গণতন্ত্রকে কালিমালিপ্ত করা হয়েছে। পার্লামেন্টকে অকেজো করে রাখা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের মাথা নিচে নামানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে পরিণত করা হয়েছে আর পাঁচটি বিভাগের মতো একটি সরকারি দপ্তরে। তথ্য কমিশন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তথ্য সরবরাহ করে না। বেশিরভাগ তথ্যই গোপন করে রাখা হয়।
আরও পড়ুন-বিরাট এলে কী হবে, আমি জানি না, মুম্বই টেস্ট নিয়ে উদাসীন অধিনায়ক
লোকপালের কী হল, তা এক রহস্যজালে আবৃত হয়ে আছে। জাতীয় মানবিধাকার কমিশন, সংখ্যালঘু কমিশন মাঝেমধ্যে কিছু বিজ্ঞপ্তি জারি করে। কোনও সরকারি এজেন্সি তার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (ক্যাগ) সরকারের নির্দেশ মেনে কাজ করতে বাধ্য হয়।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা নামেই। প্রধানমন্ত্রীর অফিস-ই শেষ কথা। সরকারের সচিবগণ নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রায় কোনও ভূমিকা পালন করেত পারেন না। তাঁদের কাজ কেবল প্রধানমন্ত্রীর অফিসের নির্দেশ পালন করা। তাঁদের মেধা বহুক্ষেত্রেই কাজে লাগে না। কারণ দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একাই একশো। তিনি সর্বজ্ঞ। তিনি-ই যে-কোনও বিধান দেওয়ার কর্তা। বিশেষজ্ঞরাও তাঁর আজ্ঞাবহনকারী হবেন এটাই তিনি চান। আনুগত্যই একমাত্র মানদণ্ড। সেটা দিয়েই ঠিক হয় কারা প্রধানমন্ত্রীর কাছের লোক হবেন।
আরও পড়ুন-‘ভারতীয়’র হাতে বন্দি ভারতের জয়, পিচ চরিত্রে অবাক দ্রাবিড়
এসবের পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রী সদা-সর্বদা নিজের ব্যক্তি-ভাবমূর্তি তৈরির ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক ও অতি সক্রিয়। তাঁর কাজকর্ম, আচার-আচরণ ব্যক্তি-ভাবমূর্তির কঠিন আবরণে ঢাকা। তিনি এটাই প্রতিষ্ঠিত করতে চান এ-তাবৎকালের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনিই একা নতুন-ভারত গড়তে সক্ষম। তিনি সব জানেন। সব পারেন। তিনিই মুশকিল আসান। তিনি ‘৫৬ ইঞ্চির’ লৌহপুরুষ। গরিবের ত্রাতা। রক্ষাকর্তা। শত্রুনাশকারী। দেশরক্ষক। তিনিই আইন, তিনিই শাসন, তিনিই বিচার। তাঁর বিরুদ্ধে যে কথা বলবে, তাঁর কাজের যে সমালোচনা করবে সে-ই দেশদ্রোহী, সে-ই অনাগরিক। ইতিহাসের পাতায় আত্মপ্রতিষ্ঠাই তাঁর জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুন-আরও ২০ হাজার স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড বছর শেষে
তিনি ভাবেন নাটকীয় আচার-আচরণ আর জবরদস্ত বক্তৃতা দিয়েই তিনি বাজিমাত করবেন। সম্মোহিনী ক্ষমতা দিয়েই তিনি মানুষকে বশ করবেন। আর বশীভূত মানুষের সমর্থনে তিনি একাধিপত্য চালিয়ে যাবেন। বিরোধীরা ভয় পাবে তাঁকে। ভয়ে কেউ কিছু বলবে না। বললেই সিবিআই! ইডি এবং চরিত্রহনন বা কখনও ঘরবন্দি তো কখনও জেলবন্দি। নজরদারির পাকা বন্দোবস্ত। পেগাসাস তো আছেই।
আধিপত্যবাদী মতাদর্শ কর্তৃত্ববাদের জন্ম দেয়। কর্তৃত্ববাদই একাধিপত্যের পথ প্রশস্ত করে। গণতন্ত্রের গলা টিপে রাজতান্ত্রিক মনোভাবে ভর করে একাধিপত্যকামীরা আইন-শাসন ও বিচার বিভাগকে বশ্যতার জালে জড়িয়ে ফেলে। তা না হলে মানুষের ‘বিশ্বাস’ (শাসক প্রচারিত) কখনও সর্বোচ্চ আদালতের মূল বিচার্য বিষয় হয়! একটি রাজ্য পরিণত হয় কেন্দ্রীয় শাসনাধীন অঞ্চলে! পুরুষানুক্রমে বসবাসকারী নাগরিক হয়ে যান ‘বিদেশি’! শাসকের মিথ্যা প্রচার কী করে হয়ে ওঠে দেশ চালানোর নির্দেশাত্মক নীতি! বহুত্বের খণ্ডন ও একাধিপত্যের প্রতিষ্ঠা হল বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসনের মর্মকথা।
আরও পড়ুন-স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই এগিয়ে চলবে বালি
গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এঁদের চক্ষুশূল। তাই কখনও মন্দির, কখনও যুদ্ধকে হাতিয়ার করে গণ-উন্মাদনা সৃষ্টির পথে গোটা দেশে একটি মত চাপিয়ে দেওয়ার সার্বিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। ইতিহাস সাক্ষী এসবের মাধ্যমে স্বৈরতান্ত্রিক- ফ্যাসিবাদী-ধর্মীয় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। মেকি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় বিভাজন মোদি-জমানার হাতিয়ার।
দেশকে বাঁচাতে হলে এই সার্বিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে।