আন্তর্জাতিক মানব অধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা (UDHR) এবং অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি (ICESCR) এর দুটি মূল নথি হল খাদ্য অভ্যাস ও খাদ্য নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা। অন্যদিকে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় পরিষ্কার করে বলা আছে, ধর্মীয় অভ্যাস যেন কোনওভাবেই বিনষ্ট না হয়। আবার কী কী খাবে বা খাবে না, সেটা ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১-এ গুজরাত হাইকোর্টে একটি মামলায় তৎকালীন বিচারপতি পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, খাদ্যাভ্যাস ও বিভিন্ন ধরনের খাবারের দোকানের স্টলের উপরে যেন কোনওরকম নিষেধাজ্ঞা জারি না হয়। মাননীয় বিচারপতি তাঁর একটি পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, আপনি ননভেজ খান না, এটা আপনার ভাবনচিন্তার ফসল কিন্তু আপনি কীভাবে জোর জবরদস্তি করতে পারেন তাদের ওপর যারা ননভেজ খায়?
আরও পড়ুন-কলকাতার গির্জা
ইদানীং মধ্যপ্রদেশ সরকার ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে মাছ-মাংস-ডিমের দোকানগুলোর উপরে বুলডোজার চালাতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রদেশকে নিরামিষাশী রাজ্য করার পিছনে সবথেকে বড় কারণ হল বাঙালি, বিহারী, ওড়িয়া, অসমীয়া যাতে না খেয়ে মরে এবং রাজ্যের কয়েক লক্ষ মানুষ যাতে জীবিকার সংকটে ভোগে। মধ্যপ্রদেশের যারা এই মাস-মাংস ও ডিম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত তাদের একটা বড় অংশ হল মুসলমান, অসমীয়া এবং বিহারী। এই সমস্ত ব্যবসায়ীরা যে কেবলমাত্র শুধু মধ্যপ্রদেশে এই খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করে তা নয়, তারা সারা ভারতবর্ষের সমস্ত রাজ্যেও রফতানি করে, অর্থাৎ এই সরকার এটাই করতে চাচ্ছে যে এই সমস্ত জিনিসগুলো বা খাদ্যগুলো বিক্রি হোক খুব বড় বড় শপিংমলে যাতে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর ঘরে টাকা ঢোকে এবং তারা একচেটিয়া এই খাদ্যগুলোর কালোবাজারি পায়ের উপর পা দিয়ে করতে পারে।
আরও পড়ুন-স্মরণে বরণে মহম্মদ রফি
অথচ বিজেপি সরকারের এদিকে কোনও নজর নেই যে ভারতবর্ষ থেকে প্রায় ১৫০ জন অন্য সম্প্রদায়ের ব্যক্তি সারা বিশ্বে বিফ রফতানি করে এবং তারা সবচেয়ে বেশি বিফ রফতানি করে ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইরাক, আলজেরিয়া সহ এমন ৫০টি দেশে। ভারতবর্ষ মহিষের মাংস রফতানিতে সারা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয় এবং সেখানে ৮৯১ মিলিয়ন ইউএসডি বিদেশি মুদ্রা আয় করে। এই ১৫০টি বিফ রফতানিকারক ব্যবসায়ীর মধ্যে একজনও কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ আপনি পাবেন না। সবচেয়ে বেশি বিফ রফতানি করে আলা নাসম প্রাইভেট লিমিটেড। এই কোম্পানির বিদেশি মুদ্রা আয় হয় ৩১২ মিলিয়ন ইউএসডি। এদিকে কিন্তু বিজেপি তথা মোদি সরকারের কোনও মাথাব্যথা নেই কিন্তু সাধারণ গরিব মানুষ, যারা পেটের দায়ে এই বিফ বা অন্যান্য মাংস, ডিম ও মাছের বিক্রি বা কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত, তাদের পেটে লাথি মারার জন্য ব্যস্ত হয়েছে। মাননীয় বিজেপি সরকারের কাছে আমার একটাই আর্জি, এই গরিব মানুষের পেটে লাথি মারার আগে এই বৃহৎ ব্যবসায়ীদের মহিষের মাংস রফতানি করা ছাড়তে বলুন আগে।
আরও পড়ুন-জেব্রা ক্রসিং
আসলে আবার এই ২০২৪ লোকসভা ভোটের আগে এই পারসেপশন তৈরির চেষ্টা চলছে যে ভারতবর্ষ প্রকৃতপক্ষে হিন্দুদেরই দেশ এবং শুধু হিন্দুদেরই দেশ নয়, এখানে উচ্চ শ্রেণির হিন্দুত্ববাদীদের দেশ। ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য, যে রাজ্যগুলোকে একসঙ্গে বলা হয় সেভেন সিস্টার্স, তাদের প্রধান খাদ্য কিন্তু বিফ। এছাড়াও অনেক উচ্চ শ্রেণির হিন্দু আছেন, যাঁরা আদৌ ননভেজ নন। তাহলে এই হিন্দুদের মধ্যে বিভাজন করাটা নরেন্দ্র মোদির আরেকটা নতুন ছক বা কৌশল।
আসলে ভারতবর্ষের সংবিধানটাকে অমান্য করে এবং বিশ্বের আন্তর্জাতিক মানব অধিকারের আইনকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মোদি সরকার চাইছে ভারতবর্ষের প্রত্যেকটা মানুষ কী খাবে, কী পরবে তারই একটা রূপরেখা তৈরি করে দেবে বিজেপি সরকার, যার দ্বারা হিন্দু বলয়ে একচেটিয়া ভোট পাওয়ার প্রবণতা বাড়বে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মস্থানে মাইক বাজানো বন্ধ। আসলে এই বিজেপি সরকার যেটা বোঝাতে চেয়েছে সেটা হল, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচবার আজান হয় মসজিদে এবং পাঁচবার ফরজ, সুন্নত ও নফল নমাজ পড়তে হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই অভ্যাসের উপরে কুঠারাঘাত করতে চাইছে বিজেপি সরকার। মূলত একটি সম্প্রদায়ের উপরে মানসিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ আরোপ করতে চাইছে। আমরা ছোটবেলায় হিন্দু বন্ধুদের সঙ্গে গিয়ে মাইকে কীর্তন শুনেছি। কীর্তন হওয়ার মাঝে যখন মসজিদ থেকে আজানের পবিত্র বাণী ভেসে আসত তখন কিন্তু কীর্তনে উপস্থিত মানুষজন কীর্তন বন্ধ করে দিতেন। আজান শেষ হওয়া পর্যন্ত তাঁরা কিন্তু অপেক্ষা করতেন। শেষে তাঁরা বলতেন এবারে আজান শেষ হয়ে গেছে, আবার শুরু করো অর্থাৎ এই যে পারস্পরিক ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা আমাদের ভারতবর্ষের সংস্কৃতি। যুগ যুগ ধরে ভারতবর্ষে এটা চলে আসছে, সেটা যে শাসকের আমলই হোক, ইংরেজ আমল বা কংগ্রেসের শাসন। কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের কাছে আমার একটি প্রশ্ন। তাহলে কি আমরা যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে বেড়ে উঠেছি, একই গ্রামের মধ্যে হি-মুসলমান পাশাপাশি বাস করে এসেছি, সেটা লুপ্ত? তাহলে কি কীর্তন গান জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই শুনতে পাবে না এবং উপভোগ করতে পারবে না?
আরও পড়ুন-আজ টেট
ভারতবর্ষের সংবিধানের মধ্যে উজ্জ্বল ভাবে লেখা আছে ধর্ম পালনের অধিকার সমভাবে উপভোগ করবে সব ধরনের মানুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। তাহলে বিজেপি সরকার কি চাইছে ভারতবর্ষের সংবিধানটা আবার নতুন ভাবে নতুন আঙ্গিকে নিজেদের মতো তৈরি করতে? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিলাম ভারতবর্ষকে হিন্দুত্ববাদী ধর্মের দেশ করা হল। তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার একটি প্রশ্ন যে নেপাল তো বহুদিন ধরে হিন্দু রাষ্ট্র কিন্তু নেপাল তো কোনওদিন বিশ্বের শক্তিধর দেশ হতে পারেনি। নেপাল তো খাদ্য, অর্থ, সুখ-শান্তিতে সমৃদ্ধ হতে পারেনি। একইভাবে পাকিস্তানের কথা এসে যায় বা আফগানিস্তানের কথাও এসে যায়। তারাও মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছে কিন্তু তারা তো কোনওদিন বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের সমকক্ষ হতে পারেনি? আসলে বিজেপি সরকার পুরোপুরি ভাবে ভুলে যাচ্ছে যে ধর্মমত জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না, বরং মানুষ যদি ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোনও মানুষকে সেলাম করে, প্রণাম করে, নমস্কার করে, স্যালুট করে, তাহলে মনুষ্য ধর্মটা রক্ষা হয়।