মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়: ‘লক্ষ্মীর অন্তরের কথাটি হচ্ছে কল্যাণ, সেই কল্যাণের দ্বারা ধন শ্রীলাভ করেH। কুবেরের অন্তরের কথাটি হচ্ছে সংগ্রহ, সেই সংগ্রহের দ্বারা ধন বহুলত্ব লাভ করে। বহুলত্বের কোনো চরম অর্থ নেই। দুই দুগুণে চার, চার দুগুণে আট, আট দুগুনে ষোলো অংক গুলো ব্যাঙের মতো লাফিয়ে চলে; সেই লাফের পাল্লা কেবলই লম্বা হতে থাকে।’
~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অতিমারির কালে স্কুলে পঠন পাঠন বন্ধ থাকলেও দপ্তরে নানারকম কাজকর্ম চলে। কিছুদিন আগে আমাদের বালিকা বিদ্যালয়ের দপ্তরে নানান বয়সী মহিলাদের আসা-যাওয়া লেগেই ছিল। এঁরা এই বালিকা বিদ্যালয়ে অনেককাল আগে পড়েছেন, বেশিরভাগেরই বয়স তিরিশ বা চল্লিশের উপরে। তাঁরা এসেছেন বিদ্যালয়ে তাঁরা যে পড়েছেন তার একটি সার্টিফিকেট নিতে, যাতে জন্মতারিখ ইত্যাদি থাকবে। জানতে চাইলাম, কেন? জানলাম, এগুলো মূলত তপশিলি জাতি ও জনজাতি শংসাপত্র তৈরি করার জন্য প্রয়োজন, কারণ লক্ষীর ভান্ডার নামক যে প্রকল্পটি চালু হয়েছে সেখানে এর বিশেষ চাহিদা। বিষয়টি ক্রমে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল। প্রথমত এই যে মাঝবয়সী মহিলা যারা শংসাপত্র তৈরি করার জন্য আজ স্কুলের প্রাঙ্গণে আবার ফিরে এলেন, তাতে এটা স্পষ্ট হলো যে দীর্ঘ কয়েক দশকে যারা রাজত্ব করছিলেন তাঁরা মেয়েদের জাতিগত শংসাপত্র দেওয়ার দায়িত্ব কখনো নেননি। হয়তো মেয়েদের কথা তারা ভেবেও দেখেননি। মুখে যাই বলুন, তাদের ভাবনাটাই হল, মেয়েদের আবার পরিচয় কী? পিতা,স্বামী,পুত্রের পরিচয়েই পরিচিত তারা। পরিবারের লোকেরাও ভেবেছেন, যাদের দিন কাটে রান্নাঘরে, তাদের শংসাপত্র থাকার প্রয়োজন কী? এই যে রামের মা, সীমার মা এর বাইরে তাদের যে নিজস্ব একটা নাম আছে, তাই বা ক’জন মনে রাখেন! তার উপর সাম্যের গান যতই গাওয়া হোক, পিছিয়ে পড়া বা বলা ভালো পিছিয়ে রাখাদের নিয়ে কারো মাথাব্যথা ছিল না। অন্য কারণটি হলো এই যে শংসাপত্র জোগাড় করতে গেলে সেইকালে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হত, দপ্তরে দপ্তরে হাঁটাহাঁটি করতে করতে পায়ের চটি ক্ষয়ে যেত, এত কাগজ লাগত যে শেষ পর্যন্ত মানুষ হাল ছেড়ে দিত। একথা অনস্বীকার্য যে দুয়ারে সরকার প্রকল্পের মাধ্যমে এই অত্যন্ত জরুরী বিষয়টি খুব সহজে সমাধান করা গেল। জাতিগত শংসাপত্র ছাড়া তপশিলি জাতি জনজাতি গোষ্ঠী বহু অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন । যাঁরা এদের নাম করে বড় বড় প্রকল্প তৈরি করতেন তাঁরা কিন্তু এদের কথা ভাবেননি।
আরও পড়ুন-সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জন্মদিবস উপলক্ষে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর শ্রদ্ধার্ঘ্য
আজ পশ্চিমবাংলায় দুয়ারে সরকার এবং তারপরে লক্ষীর ভান্ডার প্রকল্পের মাধ্যমে মেয়েদের প্রকৃত অবস্থাটি উঠে আসছে। সেই সাথে নারীর ক্ষমতায়নের এক নতুন দিগন্ত খুলে যাচ্ছে। আমরা লক্ষ্ করে দেখছি যে এইসব মেয়েরা যারা নানান কারণে, মূলত আর্থিক কারণে, মাঝপথেই শিক্ষার জগত থেকে ঝরে পরে ছিলেন আজ তাঁরা সেই শিক্ষায়তনে এসে দাঁড়িয়েছেন যাতে পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষার পথে এগোতে পারে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, লক্ষীর ভান্ডারে আছে কল্যাণের স্পর্শ। যারা এই দেশের কোটি কোটি টাকা নিয়ে স্থানান্তরে চলে গেলেন, যাদের চুলের ডগাও সরকার স্পর্শ করতে পারল না এবং যে সরকার এদেশের সমস্ত মানুষের সম্পদ অকাতরে বিক্রি করে দিচ্ছেন তারাই আসলে কুবেরের সাধনায় মত্ত। তারা তাদের ধন-ভান্ডার সংগ্রহ করেন জনগণকে ঠকিয়ে চলেন। তা সে নোটবন্দী হোক, বা অপরিকল্পিত লকডাউন, যাই-ই হোক না কেন। শুধু লাফিয়ে লাফিয়ে সংখ্যা বাড়ান, কিন্তু সাধারণের কাছে ‘ আচ্ছে দিনে ‘ র ছিটেফোঁটাও পৌঁছায় না । মেয়েদের জন্য এর আগেও ফলাও করে শোনানো হল ‘বেটি বাঁচাও” জাতীয় প্রকল্পের কথা। আসলে কতজন যে বাঁচল, তার কোনও খবর নেই। বরং নানান কট্টরবাদিতায় মেয়েরা আরও অন্ধকারে ঢুকে পড়েছে । সেখানে একটি কন্যাশ্রী প্রকল্প বাংলার মেয়েদের সামনে অন্য ভবিষ্যৎ খুলে দিয়েছে। যাঁরা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তাঁরা জানেন কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবাদে স্কুলে মেয়েদের ভর্তির হার বেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা ছাত্রীরা অন্যরকম ভবিষ্যতের কথা ভাবছে। বিয়েই ছিল একমাত্র গতি , সেখান থেকে পরিবর্তনের পথ তৈরি করেছে কন্যাশ্রী। আজকের লক্ষীর ভান্ডার মহিলাদের হাতে সেই ক্ষমতাটুকু এনে দিচ্ছে যাতে অন্যের কাছে হাত না পেতেও তারা সংসারের কিছু কিছু প্রয়োজন, তাদের নিজস্ব কিছু সাধ পূরণ করতে পারেন। সমীক্ষা বলে মেয়েদের হাতে টাকা গেলে তা সবসময়ই সংসারের কল্যাণে লাগে। স্বনির্ভর দল নিয়ে প্রথম দিকের সমীক্ষায় দেখা গেছিল মহিলাদের একটা বড় অংশ এই অতিরিক্ত রোজগার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় লাগিয়েছেন। আজকে গোটা বাংলা জুড়ে যে মহোৎসবের আয়োজন হয়েছে তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে। বহুকাল আগে স্বাধীনতার আগে রবীন্দ্রনাথের দিদি সাহিত্যিক স্বর্ণকুমারী দেবীর বিখ্যাত কন্যা, সমাজকর্মী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী সরলা দেবী চৌধুরানী লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প তৈরি করেছিলেন যেখানে ভারতীয় মেয়েদের নিজের হাতে তৈরি কাপড় এবং অন্যান্য বস্তু স্বদেশী ভাবে উদ্দীপিত হয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো। আজকের লক্ষী ভান্ডার মেয়েদের ক্ষমতায়নের পথ স্পষ্ট করে তুলেছে। সবচেয়ে বড় কথা যে আজ এ রাজ্যে যে কোন সরকারি দপ্তর সর্বদা মেয়েদের সমস্ত রকম সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। যে কোন দপ্তরে গেলেই দেখা যাবে মেয়েরা বিশেষত সংখ্যালঘু জাতি ও তপশিলি জাতি গোষ্ঠীর মেয়েরা যাদের কেউ কাছে ডাকে না তাদের সর্বক্ষণ বিশেষ নজর দিয়ে সমস্ত কিছুর সাথে যুক্ত করার এক বড় প্রয়াস চলছে। পশ্চিমবাংলার এই পরিবর্তন যে কোন জনপদে ঢুকলেই বোঝা যায়। আমরা দেখেছি এখন মেয়েরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে আরও অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠেছেন। কন্যাশ্রীর মেয়েরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে বন্ধুর বাল্যবিবাহ রুখে দিচ্ছে। আর মায়েদের দেখছি এক অন্য ভূমিকায়।
আরও পড়ুন-কোজাগরী লক্ষীপুজো উপলক্ষে অভিষেক ব্যানার্জীর শুভেচ্ছাবার্তা
গার্হস্থ্য হিংসার শিকার তারা অনেকেই আজকে স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচার চেষ্টা করছেন। এই লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প তাদের স্বাবলম্বনের পথে খানিকটা এগিয়ে দিচ্ছে।আমরা দেখছি শহরের প্রান্তে থাকা বস্তিবাসী মা ও মেয়ে যাদের ভয়ংকর অন্ধকারে কেবলমাত্র ভিক্ষা করে বাঁচতে হচ্ছে, আজকে লক্ষীর ভান্ডার তাদের সম্ভ্রম ফিরিয়ে আনছে। স্কুলে কয়েকজন পুরুষ এলেন তাদের স্ত্রীর শংসাপত্রের জন্য । আমরা তাদের বললাম আপনাদের স্ত্রীদের আসতে বলুন। এ কথাটা বলার উদ্দেশ্য সত্যি এটাই যে সেই মহিলাকে একবার চোখে দেখবো। গৃহের অভ্যন্তরে সমস্ত জীবন যাদের কেটে গেল। বহু পরিশ্রমে যিনি সংসার ধরে রাখেন, অর্থমূল্যে মাপা হয় না বলে তিনি সারাজীবন হীনমন্যতায় ভোগেন। একসময় কথা হয়েছিল গৃহশ্রমের মূল্যায়ণ নিয়ে, অনেকেই হেসে উঠতেন। সেই তিনিই কিন্তু এখন তার গৃহলক্ষ্মীর দরখাস্তটি নিয়ে আসছেন। আরও একবার এই সরকার ঘরে ঘরে মেয়েদের সম্মানিত করলো।