মেঘ ভাঙা বৃষ্টি ও হড়পা বান
কিছুদিন আগেই উত্তরকাশীতে ঘটে গেল বড়সড় বিপর্যয়। খবর অনুযায়ী, মেঘ ফেটে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে হড়পা বানের। ভেসে গিয়েছে বহু গাড়ি, বাড়ি। ক্ষয়ক্ষতি অনেক। বিজ্ঞান যত উন্নত হচ্ছে আমরা তত প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্বন্ধে বেশি জানতে পারছি। ইদানীং মেঘ ভাঙা বৃষ্টির সঙ্গে হড়পা বান ঘটিত দুর্যোগের ঘটনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বস্তুত মেঘ ভাঙা বৃষ্টি আর হড়পা বান, ঘটনা দুটি একটু ধোঁয়াশা যুক্ত। আবহাওয়া বিজ্ঞানে, যদি কখনও দৈর্ঘ্যে ১০ কিলোমিটার ও প্রস্থে ১০ কিলোমিটার জায়গায় ১ ঘণ্টায় ন্যূনতম ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, তখন বলা হবে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি। ওই ১০ কিমি X ১০ কিমি জায়গার সমস্ত বৃষ্টি একত্রিত করলে, মোট বৃষ্টির পরিমাণ দাঁড়াবে ১ কোটি ঘন মিটার জলের সমান। কল্পনা করা যেতে পারে, যদি যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন ও ইডেন উদ্যান স্টেডিয়াম দুটিকে সুবিশাল কড়াই ধরা হয়, তবে এই দুটি কড়াই জল ভর্তি করতে ১ কোটি ঘন মিটার জলের দরকার। কখনও কখনও মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিও হতে পারে। তখন ওই স্থানে মেঘ ভাঙা বৃষ্টির জলের পরিমাণ হবে এই রকম ৫ কড়াই (স্টেডিয়াম) ভর্তি জল। স্বাভাবিক ভাবেই, উল্লিখিত মেঘ ভাঙা বৃষ্টি আরও বেশি অঞ্চলে ঘটলে, সেই জল রাখতে এইরকম আরও বেশি কড়াইয়ের প্রয়োজন হবে। তবে মনে রাখতে হবে, অন্য কোনওভাবে এই পরিমাণ জল সঞ্চয় করলে তখন মেঘ ভাঙা বৃষ্টির জল বলা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। যেমন অস্ট্রেলিয়াতে, কোনও কোনও জায়গাতে মাটি খনন করে কুয়ো বানালেই প্রচণ্ড বেগে জল ভূমি সমতলের ওপরে উঠে আসে, অনেকটা জায়গা প্লাবিত হয়ে যায়। কোনও পাম্পের প্রয়োজন হয় না, নাম আর্টিসিয়ান কুয়ো। এই আর্টিসিয়ান কুয়োর সাহায্যে অস্ট্রেলিয়াতে অনাবৃষ্টির সময় কৃষিক্ষেত্রে জল সরবরাহ করা হয়। মার্কিন আবহাওয়া সংস্থা ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস অনুযায়ী, বৃষ্টিপাতের ফলে ৬ ঘণ্টারও কম সময়ে বন্যার সৃষ্টি হলে তাকে হড়পা বান বলা হবে। বলা বাহুল্য, দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন সংক্ষেপে ডিভিসি-র বাঁধের জল ছাড়ার জন্য যদি ৬ ঘণ্টার মধ্যে বন্যা হয় তখন কিন্তু হড়পা বান বলা যাবে না। কেননা হড়পা বান শুধু অতি বৃষ্টিপাতের সঙ্গে সংযুক্ত ঘটনা।
আরও পড়ুন-পরীক্ষা স্বচ্ছ করতে কড়া ব্যবস্থা, আজ ডিএলএড পার্ট-টু
মেঘ ভাঙা বৃষ্টিই কি কারণ
মোটামুটিভাবে ১) পৃথিবীর বিষুবরেখার ২০ ডিগ্রি ল্যাটিটুডের বাইরে, যেখানে পৃথিবীর ঘূর্ণনজনিত বল বেশি, ২) নিরবচ্ছিন্ন জলীয় বাষ্প সরবরাহ, ৩) পাহাড়ি অঞ্চল, যেখানে ঊর্ধ্বাকাশে অনিয়মিত পাহাড়ে ধাক্কা খাওয়া বাতাসের বাতিক্রান্ত প্রভাব ও নানারকম তাপমাত্রার তারতম্যজনিত বায়ুমণ্ডলের ঊর্ধ্বাকাশে অস্থিরতা। ৪) ভারতীয় উপমহাদেশে, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর অক্ষরেখা যখন স্বাভাবিক অবস্থার উত্তরদিকে থাকে (ব্রেক মনসুন) তখন হিমালয়ের পাদদেশ অঞ্চলে (যেমন উত্তরকাশী অঞ্চল) মেঘ ভাঙা বৃষ্টির সম্ভাবনা বেশি। যদিও মেঘ ভাঙা বৃষ্টির মাপকাঠি হচ্ছে অন্তত দৈর্ঘ্যে ১০ কিলোমিটার ও প্রস্থে ১০ কিলোমিটার জায়গায় ১ ঘণ্টায় ন্যূনতম ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত। এর কোনও অন্যথা হলে তাকে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি বলা হবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, গত ৫ অগাস্ট উত্তরকাশীতে যে বিপর্যয় খবরে প্রকাশ মেঘ ভাঙা বৃষ্টির থেকে সৃষ্ট হড়পা বানেই ঘটেছে বিপত্তি। অথচ হিমালয়ের পাদদেশ অঞ্চলে ইন্ডিয়া মিটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের অনেক পর্যক্ষণ মন্দির আছে, কিন্তু কোথাও মেঘ ভাঙা বৃষ্টির শর্ত অনুযায়ী বৃষ্টি হয়নি। উপরন্তু আশপাশে ৫০০ কিমির মধ্যে আবহাওয়া রাডার না থাকলেও বর্তমানে অতি সংবেদনশীল উপগ্রহ চিত্র আছে। এই উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করেও মেঘ ভাঙা বৃষ্টির কোনও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ ওই দিন ওই স্থানে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি হয়নি বলেই ধরে নেওয়া যায়, অর্থাৎ এক্ষেত্রে হড়পা বান অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তব প্রশ্ন হল, তাহলে এই বিধ্বংসী ভয়াবহ জলের বান কথা থেকে এল।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
উত্তরাখণ্ড হড়পা বানের নেপথ্যে
কিছুদিন আগেও মাটি, পাথর, কয়লা সমেত খনিজ খাদানগুলিতে বিশেষত কোদাল, বেলচা, গাঁইতি, শাবল ইত্যাদি হাত নির্ভর যন্ত্র ব্যবহার হত। সেই কারণে তখন ওপেন কাস্ট খাদান করা সম্ভব ছিল না। রাস্তা তৈরিতেও বড় পাথর, পাহাড় ইত্যাদি জায়গা বাদ দিয়ে করা হত। কিন্তু বর্তমানে ভারতেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনেক অনেক উন্নতি হয়েছে। আর্থ মুভার-সহ নানারকম অতিকায় বুলডোজার এখন হাতের মুঠোয়। তাই উত্তর ভারতে হিমালয় পাদদেশ সংলগ্ন ৮৬০০ ফুট উচ্চতা থেকে ১৪০০০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত ১২০০০ কোটি টাকার বিনিময়ে রাস্তা তৈরি অনেকদিন হল শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পের কাজ কতটা পরিবেশবান্ধব তা প্রশ্নাতীত নয়। ভয়ানক শক্তিশালী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে, পাথর পাহাড় গুঁড়িয়ে, কখনও গভীর খনন করে, বিশাল গাছ উপড়ে রাস্তা তৈরির কাজ সগর্বে, স্বমহিমায় এগিয়ে চলেছে। পাহাড়ের ঢাল বরাবর উঁচুর দিকে যাওয়ার জন্য, ও রাস্তার প্রয়োজনীয় উন্নতি বজায় রাখতে কখনও কখনও পাহাড়ের নানা গভীর স্তর পর্যন্ত ভাঙতে হচ্ছে। ভূতাত্ত্বিক গঠন অনুযায়ী পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ জলস্তর পর্যন্ত কোথাও কোথাও এই খননকাজ পৌঁছে জল বেরিয়ে আসছে। এর ফলে এই জল, আশপাশের নিচু নালা দিয়ে নদীতে এসে ও সামান্য বৃষ্টির সহায়তায় প্রচণ্ড বেগে নিচে চলে আসা অসম্ভব নয়। যা হড়পা বানের সমতুল্য। এই অভ্যন্তরীণ জলস্তরের জল পাহাড়ের উপরের লেকের জলের গভীরতা বজায় রাখে, লেক শুকিয়ে যায় না, এর জন্য কোনও পাম্পের প্রয়োজন হয় না। রাস্তা তৈরির ফলে যদি এই অভ্যন্তরীণ জলস্তরের জলরাশি ক্রমাগত নদীতে চলে আসে, তবে কোনও দিন হয়তো পাহাড়ের উপরের লেকের জল নিঃশেষিত হয়ে যেতে পারে। ঘটনাটি অনেকটা অস্ট্রেলিয়ার আর্টিসিয়ান কুয়োর মতো। পার্থক্য একটাই, ওখানে এই বিনা পয়সার কুয়োর জল সমতল ভূমিতে কৃষিকাজে লাগছে, আর এখানে পাহাড়ে হড়পা বানের পরিস্থিতি তৈরি করছে।