পুরসভায় যখন লাল পার্টির পরিচলানাধীন ছিল, তখনকার অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার সৌজন্যে এখনকার কলকাতা পুর প্রশাসনের অহেতুক ব্যয় প্রচুর। তা সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত কলকাতা পুরসভা দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে নিজস্ব অর্জনের অস্মিতায় নিশ্চিত করতে হয় নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের অগ্রগমন। লিখছেন অর্থনীতির অধ্যাপক দেবনারায়ণ সরকার
আরও পড়ুন-KMC 106: স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাতি এমবিএ ছাত্র রানা এবার তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন বাজেট সম্পর্কে বলেছিলেন, “We must consult our means rather than our wishes”. অর্থাৎ, বাজেটের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের ইচ্ছার তুলনায় আমাদের আর্থিক সংস্থানকে বেশি গুরুত্ব দেব, তার পরামর্শ অবশ্যই মেনে চলব।
এই আর্থিক সংস্থানের উপর ভিত্তি করেই গত ১১ ডিসেম্বর তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে ‘দশ দিগন্ত ইস্তেহার’ বা ‘ভিশন ডকুমেন্ট’ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে স্থান পেয়েছে, পুর-স্বাস্থ্যকেন্দ্রেগুলির ২৪ ঘণ্টা স্বাস্থ্যপরিষেবা প্রদানের জন্য পরিকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে ডেঙ্গিমুক্ত তিলোত্তমা, ঘরে ঘরে পরিশ্রুত পানীয় জলের সরবরাহ থেকে শুরু করে জমা জলের দ্রুত নিষ্কাশনের লক্ষ্যে নিকাশিব্যবস্থার সংস্কার, সহজ সরল পদ্ধতিতে স্থানীয় সমস্যার দ্রুত সমাধান থেকে শুরু করে সৌন্দর্যায়ন, শহরের ঐতিহ্যবাহীস্থানগুলির সঙ্গে পর্যটন এবং স্থানীয় শিল্পগুলির মেলবন্ধনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদি নানা প্রকল্প বাস্তবায়নকে পাখির চোখ করে আগামী দিনে এগনোর পরিকল্পনা।
আরও পড়ুন-অপবিত্র করছে গঙ্গাকে
পিছন ফিরে তাকালে দেখতে পাই, ২০২০-১১-এ কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের আয় ছিল ১৫৭১কোটি টাকা। ২০২০-২১-এ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০৬৫ কোটি টাকায়। অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে এই আয়। এবছর তা বাড়িয়ে ৪০৫০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দারজ করা হয়েছে।
পুর সভার আয় মূলত তিনটি ক্ষেত্র থেকে আসছে। ১) কর রাজস্ব, ২) কর নিরপেক্ষ রাজস্ব, ৩) সরকারি – বেসরকারি অংশীদারিত্ব।
এই তিনটি ক্ষেত্র থেকে অনুদান বাদ দিয়ে ২০১০-১১ তে আয় হয়েছিল ৭৯৭ কোটি টাকা যা ২০২০-২১-এ বেড়ে হয়েছে ১৪৬৬কোটি টাকা। এর মানে আয় বেড়েছে ৬৬৯কোটি টাকা, শতাংশের হিসাবে প্রায় ৮৫ শতাংশ।এই আয়ের ৫০শতাংশের বেশি কর রাজস্ব থেকে আসছে। এর পাশাপাশি এই সরকার কর নিরপেক্ষ রাজস্ব আয়ও বাড়াবার চেষ্টা করেছে। ২০১৯-২০তে ‘কর রাজস্ব’ থেকে আয় এসেছে ৮৬০কোটি টাকা এবং ‘কর নিরপেক্ষ রাজস্ব’ থেকে আয় হয়েছে ৪৩৩ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন-গ্রামে থেকে শহরে উত্তরণের দলিল ১৪৪এ, ১৫-১৬য় জয় নিশ্চিত
মোট ছয়টি ক্ষেত্র থেকে কলকাতা কর্পোরেশন কর রাজস্ব বাবদ আয় করছে যার ৯৫ শতাংশ আসে সম্পত্তি কর থেকে। বাকি আসে বাণিজ্য কর, পেশাগত কর, বিজ্ঞাপন কর, কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পত্তির ওপর সেবা কর, যানবাহন কর, মালবাহী গাড়ির উপর কর থেকে।
এর পাশাপাশি কর নিরপেক্ষ রাজস্ব বাবদ সরকার প্রায় ১৬টি ক্ষেত্র থেকে আয় করছে। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- বাড়ির নকশা, রাস্তা, পার্ক থেকে প্রাপ্ত আয়, জল সরবরাহ থেকে প্রাপ্ত আয়, লাইসেন্স ফি বাবদ আদায় করা অর্থ, নর্দমা ও জল নিষ্কাশন থেকে আয় এবং পৌর বাজার থেকে আয়।
আরও পড়ুন-এমপি কাপে গোলের উৎসব
২০২০-২১-এ ‘কর নিরপেক্ষ রাজস্ব’ বাবদ ৫২২কোটি টাকা আয় ধরা হয়েছে যার মধ্যে বিল্ডিং প্ল্যান থেকে ২২ শতাংশ, রাস্তা- পার্ক থেকে ১৯ শতাংশ, জল সরবরাহ থেকে ১০ শতাংশ এবং লাইসেন্স ফি থেকে ১০ শতাংশ রয়েছে। গত দশ বছর যাবৎ এই আয় পুরসভা বিভিন্ন উপায়ে বাড়াবার চেষ্টা করেছে এবং বাস্তবে তা বেড়েওছে।
আরও পড়ুন-দশ বছরে অনেকটা বদলেছে কলকাতা
চিন্তার বিষয় , আয় যথেষ্ট বাড়লেও খরচের জায়গায় সমস্যা একটা রয়েই গেছে। পেনশন ফান্ড যা বামফ্রন্ট জমানার শেষের দিকে কলকাতা পুরসভার ঘাড়ে চেপেছে। এর ফলে পুরসভাকে নিজস্ব আয়ের অর্ধেকের বেশি টাকা এই খাতে খরচ করতে হচ্ছে। ২০১০-১১-তে বামফ্রন্ট পেনশন ফান্ডে খরচ করেছিলেন ১৭৬কোটি টাকা যা এই দশ বছরে বাড়তে বাড়তে ২০২০-২১-এ হয়েছে ৭৯২কোটি টাকা। শতাংশের নিরিখে শুধুমাত্র এই খাতে খরচ বেড়েছে ৪৫০ শতাংশ যা সরকারের নিজস্ব আয়েরনশ৫৪ শতাংশ ।
আরও পড়ুন-লখিমপুরকাণ্ড : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফার দাবি মমতা
তা সত্ত্বেও উন্নয়নের কাজে ভাটা পড়েনি। সবথেকে বেশি খরচ হয়েছে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়(solid waste management)। ২০২০-২১-এ এই খাতে খরচের পরিমাণ ৫৪০ কোটি টাকা। এছাড়া জল সরবরাহে প্রায় ২৭৫ কোটি টাকা, রাস্তাঘাট খাতে প্রায় ২৫৫কোটি টাকা, নর্দমা ও জল নিষ্কাশনে প্রায় ২৩৫কোটি টাকা, স্বাস্থ্যখাতে প্রায় ১২৪ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ ছিল। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এই পুরসভা বস্তি উন্নয়নে প্রায় ১৩২ কোটি টাকা খরচ করেছে যেখানে ২০১০-১১সালে বামেরা এই খাতে খরচ হয়েছিল মোটে ৯০ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন-অপবিত্র করছে গঙ্গাকে
বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, সকল অনুদান বাদে কলকাতা পুরসভার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ২০২১-২২-এ আয়ের লক্ষমাত্রা স্থির করা হয়েছে ১৯২৫ কোটি টাকা যার মধ্যে পেনশন ফান্ডে ব্যয় হবে প্রায় ৮৫০কোটি টাকা। অর্থাৎ 44 শতাংশেরও বেশি। বামফ্রন্ট পরিচালিত পুরসভা শেষের দিকে ইচ্ছেমত কর্মী নিয়োগ করেছিল বলেই এই সমস্যা এত বড় আকার নিয়েছে।
এপ্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্টের একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৬ থেকে। ৮৫০কোটি টাকার এই প্রজেক্টে ৪৫০ কোটি টাকা ঋণ দেবে এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক । জোকা, বেহালা, যাদবপুর, টালা এইসব অঞ্চলগুলিতে এর কাজ চলছে জোরকদমে, যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, প্রতিটি ঘরে পরিশ্রুত পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া যায়।
আরও পড়ুন-শ্রদ্ধায় সমাধিস্থ সৎপাল
পেনশন ফান্ডের এই বিপুল খরচ, কলকাতার কাঠামোগত সমস্যা এসব প্রতিকূলতাকে সঙ্গে নিয়েই বাস্তববাদী পরিকল্পনা ও তার সফল রূপায়নের ক্ষেত্রে কলকাতা কর্পোরেশনের স্বচ্ছ ভূমিকা সত্যিই ঈর্ষণীয়।