যন্ত্রণা থেকে সৌন্দর্যের উত্থান

যুদ্ধ আর বিভাজনের আগুনে পৃথিবী জ্বলছে, তখন লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের কলম মনে করিয়ে দেয়— শেষ থেকেই আসলে নতুন যাত্রা শুরুর। ২০২৫ সালের নোবেলজয়ী এই হাঙ্গেরিয়ান লেখক দেখিয়েছেন, সৌন্দর্য কেবল শান্তিতে নয়, ছাই-ভস্মে লুকিয়ে থাকে তার দীপ্তি। সাহিত্যই হতে পারে সেই আলো, যা পতনের অন্ধকারে মানবতাকে নতুন সৃষ্টির পথে ফেরায়। আলোচনায় রিমা বাগ

Must read

চারিদিকে শুধু মাটি পড়ে রইল, পাহাড়ের শান্ত নিস্তব্ধতা, আর রইল, বিপুল শূন্যতায় মরা পাতার চাদরে ঢেকে থাকা মাটি। এই মাটিই যেন জ্বলন্ত পৃথিবীর নিচে লুকিয়ে থাকা সব কিছুকে আড়াল করে রেখেছে। বিপুল সৌন্দর্যের মাঝেও যে ভাঙন, ধ্বংস হতে পারে তা হয়তো লাসলো ক্রাসনাহোরকাই-ই সবার আগে উপলব্ধি করেছিলেন। যেখানে পৃথিবী জ্বলছে, চলছে যুদ্ধ ও বিভাজনের উন্মাদনা, সেখানে শিল্পই একমাত্র, যা ভস্মের মধ্যে নতুন ফুল ফোটায়।
পুনরুজ্জীবন
২০২৫ সালের সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর মুহূর্তেই সমগ্র সাহিত্যজগতের নজর পড়ে এক ব্যক্তির দিকে— লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। নীরব অথচ প্রবল শক্তিসম্পন্ন এই লেখককে সুইডিশ অ্যাকাডেমি ঘোষণায় বলেছে ‘প্রলয়ের ভয়াবহতার মাঝেও শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রমাণ করা এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন স্রষ্টা’ হিসেবে।
তার রচনায় আমরা পাই ধ্বংস, অবক্ষয়, নৈতিক পতন— অথচ সেই অন্ধকারের মধ্যেই আলো খুঁজে পাওয়ার এক অদম্য প্রচেষ্টা। ক্রাসনাহোরকাই বিশ্বাস করেন, পৃথিবী পতনের পথে হলেও মানবমনের এক বিন্দু আলোকই তাকে টিকিয়ে রাখে। তাঁর লেখার দীর্ঘ বাক্যগঠন, চিন্তার প্রবাহ, আর গভীর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি পাঠককে টেনে নিয়ে যায় এমন এক জগতে, যেখানে প্রশ্ন জাগে— কেন ধ্বংসও সুন্দর হতে পারে না?

আরও পড়ুন-চুরি করা ‘খুকি মা’ বদলে দিয়েছিল দয়ালের জীবন

সংঘর্ষ ও শিল্পের যাত্রা
লাসলোর সাহিত্যবোধের শিকড়ে রয়েছে তাঁর জীবনের প্রেক্ষাপট। ১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর গিউলায় জন্ম নেওয়া এই লেখক শৈশব থেকেই একাকিত্বে বেড়ে ওঠেন। প্রকৃতি ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী, আর প্রশ্ন করা ছিল তাঁর সহজাত অভ্যাস। তাই তাঁর লেখায় বারবার উঠে আসে মধ্য ইউরোপের সমাজজীবনের পতন, মানুষের নৈতিক অবক্ষয় এবং সভ্যতার ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী।
তাঁর উপন্যাসের চরিত্রেরা প্রায়ই বাস করে এমন এক পৃথিবীতে, যেখানে প্রত্যাশা এক প্রহসন, নৈতিকতা বিলীন, আর বেঁচে থাকাই এক অবিশ্বাস্য সংগ্রাম। তাঁদের অস্তিত্ব যেন ক্রমশ প্রমাণ করে, মানুষ শুধু ধ্বংসের মুখোমুখি নয়— ধ্বংসের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সৃষ্টির সম্ভাবনা।
দার্শনিক উত্তরাধিকার
নোবেল কমিটি তাঁর লেখার রীতিকে মধ্য ইউরোপের কাব্যিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে যথাযথ কারণও রয়েছে, তাঁর লেখায় ফ্রাঞ্জ কাফকা, স্যামুয়েল বেকেট ও দস্তয়েভস্কি-র প্রভাব স্পষ্ট।
তাঁর গদ্যে দেখা যায় ইউরোপীয় ভাবনার সঙ্গে পূর্বের দর্শনের মেলবন্ধন— জাপানি বৌদ্ধ তত্ত্ব, চিনা দর্শন, এমনকী জৈনধর্মের অন্তর্নিহিত শান্তিও। তার পরাবাস্তব বর্ণনা ও অস্তিত্ববাদী অনুসন্ধান রাজনীতি, ধর্ম ও মানবতার সীমারেখা মুছে এক সর্বজনীন প্রশ্ন তোলে। তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন—
‘‘আমি লিখি, কারণ নীরবতাকে সহ্য করতে পারি না।’’
এই এক বাক্যেই স্পষ্ট, লেখালিখি তাঁর কাছে নিছক পেশা নয়, বরং অস্তিত্বের প্রতিবাদ।
লেখার জগৎ
লাসলোর গদ্য পরিচিত তাঁর ‘প্রবাহী সিনট্যাক্স’-এর জন্য। তাঁর বাক্য কখনও কখনও পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ধরে চলে—বিরামচিহ্নহীন, অথচ গভীর সুরে গাঁথা। পাঠককে তিনি বাধ্য করেন পূর্ণ মনোযোগ দিতে, ভাবতে, ডুব দিতে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট— ‘পৃথিবীর সম্পূর্ণ চিত্রটি দেখানো।’
১৯৮৫ সালে তাঁর প্রথম সাহিত্য প্রকাশিত হয় ‘স্যাটানটাঙ্গো’। এক ধ্বংসপ্রায় গ্রাম, যেখানে মানুষ প্রতারণা এবং অবিশ্বাসের মধ্যে এক চরম লড়াইয়ের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। যেখানে আশা বা প্রত্যাশা দুই এক প্রহসন। তবুও এক রহস্যময় প্রত্যাবর্তনের স্বপ্নই তাদের বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। এই প্রথম তিনি তাঁর লেখার মূল দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে পেলেন— ‘ধ্বংসের মধ্যেই টিকে থাকার সৌন্দর্য’। পরবর্তীতে ১৯৯৪-এ পরিচালক বেলা তাঁর এই উপন্যাসটিক একটি সাতঘণ্টা ব্যাপী কিংবদন্তি চলচ্চিত্রের রূপ দেয়।
১৯৮৯ সালে প্রকাশিত দ্য মেল্যাঙ্কোলি অফ রেজিস্ট্যান্স বইটির প্রেক্ষাপট ছিল একে অস্থির শহর এবং তার একটি সার্কাসের উপরে। যেখানে দর্শক এবং সাধারণ মানুষের মূল জীবনের কেন্দ্রবিন্দু এক তিমি। এবং এই তিমিকেই তুলে ধরা হয় তাদের বিপর্যয়ের কান্ডারি হিসেবে, যা সেখানেই দাঙ্গা এবং ফ্যাসিস্ট মনোভাবনার উত্থান করে।
লাসলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এই ওয়ার এন্ড ওয়ার (১৯৯৯)। এক সরকারি কর্মচারীর গল্প যিনি বিশ্বাস করেন প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলি মানবজীবনের মুক্তির একমাত্র পথ। এই কর্মচারী পাণ্ডুলিপিগুলি ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংরক্ষণ করার এই দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা করতে থাকেন, তাতে মানুষের চিন্তা কখনওই মরে না যায়। তাঁর লেখাই দর্শনের এমন এক ধারণাকে স্পষ্ট করে যার অর্থ, লিখিত রূপই টিকে থাকে, শব্দই মুক্তির পথ।’
২০০৮-এর ‘সিবো দেয়ার বিলো’ (Seiobo There Below) উপন্যাসে তিনি শিল্পের প্রতি ভক্তি এবং ক্ষণস্থায়ী বিশ্বের মধ্যে সৌন্দর্যের অনুসন্ধান করেছেন। কিয়োটোর কামো নদীর মাঝখানে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা সাদা বকের দৃশ্যটি শিল্পী বা স্রষ্টার একাকী অবস্থানের এক কাব্যিক প্রতীক। তবে এখানে জাপানের এক ধর্মীয় দেবী সাইবো এবং চিনা-বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের বিভিন্ন আধ্যাত্মিক রূপরেখাকেও তুলে ধরেছেন এই সাহিত্যে।

আরও পড়ুন-বিধানসভা ভোটে এলাকায় না জেতাতে পারলে পুরভোটে টিকিট হবে না, বার্তা সাংসদের

সম্মাননা
ক্রাসনাহোরকাই অসংখ্য সম্মান এবং পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তবে ২০১৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল ম্যান বুকার সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। তবে তাঁর ব্যারন ওয়েনকহাইমস হোমকামিং (২০১৬) লেখায় পোস্ট-কমিউনিস্ট হাঙ্গেরির দুর্নীতিকেও সেই সঙ্গে ব্যঙ্গ করেন তিনি। এবং সর্বশেষ এবং সর্বোচ্চ ২০২৫-এর সাহিত্য নোবেল পুরস্কার যেন তাঁর ভাবনা-চিন্তার চূড়ান্ত স্বীকৃতি দেয়, ‘ধ্বংস ও সৌন্দর্য একে অপরের পরিপূরক, শিল্প এবং শব্দই মানবতার একমাত্র আশ্রয়’ আবারও প্রমাণ করে এই পুরস্কার।
যন্ত্রণা ও সৌন্দর্য
আজ পৃথিবী জ্বলছে যুদ্ধ, বিভাজন ও মিথ্যার আগুনে। সভ্যতা ক্লান্ত, মানুষ অবসন্ন। এমন সময়ে লাসলো ক্রাসনাহোরকাই আমাদের মনে করিয়ে দেন—
‘সবকিছু ভেঙে গেলেও শিল্প কখনও শেষ হয় না।’
এই এক বাক্যে যেন বর্তমান পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে আশার বাণী— যে ধ্বংসের মধ্যেও সৃষ্টি আছে, যে অন্ধকারের ভেতরেও আলো জ্বলে, এবং যে শব্দই শেষ পর্যন্ত মানবতার একমাত্র আশ্রয়।

Latest article