“ইতিহাস শুধু রাজাদের কীর্তিগাথা নয়, এটি জনগণের সংগ্রাম ও পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা।” —এই কথাটি আজকের ভারতে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইতিহাস বলে, যে-জাতি অতীত থেকে শিক্ষা নেয় না, তার ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢেকে যায়। ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং এটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক বিকাশের ফল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতে শাসনের সুবিধার্থে “বিভেদ কর, শাসন কর” নীতি অনুসরণ করেছিল, যার প্রধান হাতিয়ার ছিল ইতিহাসের বিকৃতি। ফলে ভারতীয় ইতিহাসকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন এটি কেবল হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের একটানা শৃঙ্খল। ব্রিটিশদের এই রাজনৈতিক প্রকল্পের প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী হয়ে ওঠে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো, বিশেষ করে আরএসএস ও বিজেপি। “পাথরে আগুন জ্বলে না, অথচ মানুষ অমূলক কারণে হানাহানি করে।”— ভারতীয় ইতিহাসের বিকৃতি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ঔপনিবেশিক শাসনের আগে ভারত ছিল এক বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, যেখানে বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর মিলন ঘটেছিল। ইসলাম ও হিন্দুধর্মের মিশ্রণেই তৈরি হয়েছিল এক অনন্য ভারতীয় সংস্কৃতি— সংগীত, স্থাপত্য, সাহিত্য, খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এই মিশ্রণ স্পষ্ট। ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা ভারতীয় ইতিহাসকে কৃত্রিমভাবে তিনটি পর্বে ভাগ করেছিল— প্রাচীন হিন্দু যুগ, মধ্যযুগ বা মুসলিম যুগ, এবং আধুনিক ব্রিটিশ যুগ। এই বিভাজন প্রথম প্রভাবশালীভাবে প্রস্তাব করেছিলেন স্কটিশ ঐতিহাসিক জেমস মিল তার বিখ্যাত গ্রন্থ “The History of British India” (1817)-তে। এই গ্রন্থে মিল ভারতীয় সভ্যতার প্রতি তার তীব্র বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেন এবং যুক্তি দেন যে, ভারতীয় সমাজ ছিল বর্বর, অন্ধবিশ্বাসে নিমজ্জিত এবং শুধুমাত্র ব্রিটিশ শাসনের মাধ্যমেই ‘সভ্যতা’ অর্জন করতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গির মূল সমস্যা হলো, এটি ইতিহাসকে একপাক্ষিকভাবে উপস্থাপন করে।
মধ্যযুগের বাস্তবতা ছিল অনেক জটিল। মুসলিম শাসকদের মধ্যে শুধুমাত্র যুদ্ধবাজ বা ধর্মীয় কট্টরপন্থী শাসকই ছিলেন না, বরং বহু শাসক প্রশাসন পরিচালনায় হিন্দু অভিজাতদের যুক্ত করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, আকবরের রাজসভায় রাজপুত রাজারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন, এবং তার ধর্মীয় নীতিগুলো উদার ও সমন্বয়ধর্মী ছিল। মুঘল আমলে হিন্দু জমিদার এবং আমলারা প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে কাজ করতেন। ফলে, এই সময়কালকে শুধুমাত্র ‘বিদেশি আক্রমণের’ যুগ হিসেবে দেখানো একধরনের ঐতিহাসিক মিথ্যা প্রচারের শামিল। অন্যদিকে, ব্রিটিশরা নিজেদের শাসনকালকে ‘সভ্যতা’ ও ‘আইনের শাসন’ প্রতিষ্ঠার যুগ বলে প্রচার করলেও, বাস্তবে তাদের শাসনকাল ছিল শোষণ ও দমননীতির উদাহরণ। ১৭৫৭ সালের পর ভারতীয় সম্পদের ব্যাপক শোষণ, কৃষকদের দুর্দশা এবং অর্থনীতির ধ্বংস প্রমাণ করে যে, ব্রিটিশ শাসন মোটেই কোনও মুক্তির যুগ ছিল না। এই ধরনের ইতিহাসের বিকৃতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মূল রাজনৈতিক কৌশলের অংশ ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় সমাজকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করা এবং মুসলিম শাসকদের ‘বহিরাগত’ হিসেবে উপস্থাপন করে হিন্দুদের মধ্যে একধরনের সন্দেহ ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করা। এই বিভাজন নীতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আজও অনুভূত হয়। তাই, ইতিহাসকে সঠিকভাবে বোঝা এবং অতীতের বিকৃত ব্যাখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করা খুবই জরুরি। কারণ, “যে ইতিহাস জানে না, সে তার ভবিষ্যৎও গড়তে পারে না।”
“যেখানে ধর্ম রাজনীতির হাতিয়ার, সেখানে জনগণের দুর্ভোগ অবধারিত।” —ভারতে আরএসএস ও বিজেপির উত্থান এই কথার সত্যতা প্রমাণ করে।
১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) শুরু থেকেই ব্রিটিশ উপনিবেশবাদকে চ্যালেঞ্জ না করে বরং মুসলমানদের ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তাদের মতাদর্শের মূল ভিত্তি ছিল ইউরোপের ফ্যাসিবাদী চিন্তাভাবনা। আরএসএসের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক এমএস গোলওয়ালকার তার “We or Our Nationhood Defined” (১৯৩১) গ্রন্থে লিখেছিলেন, “হিন্দুস্তানের অ-হিন্দু জনগণকে হয় হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষা গ্রহণ করতে হবে, নয়তো তারা হিন্দুজাতির সম্পূর্ণ অধীনস্থ হয়ে থাকবে, কোনও নাগরিক অধিকার ছাড়াই।” এই বক্তব্য সরাসরি জার্মানির নাৎসি মতাদর্শের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
আরও পড়ুন-এনসিইআরটির পাঠ্যবইতে বদল, মুঘল ও সুলতানি সাম্রাজ্য বাদ গেল, যুক্ত হল কুম্ভমেলা
“যে রাজনীতি জনগণের কল্যাণ ভুলে যায়, সে কেবল ধ্বংসের পথ তৈরি করে।”— বিজেপির উত্থান ও শাসনকাল এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করছে। বিজেপি হল আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা। ১৯৮০ সালে দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে আসছে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং ২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গার মাধ্যমে তারা ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে এক নতুন স্তরে নিয়ে যায়। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিজেপি তাদের হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডাকে আরও শক্তিশালী করেছে, যা মূলত ভারতে হিন্দু আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দিকে পরিচালিত হয়েছে। এই অ্যাজেন্ডার প্রধান লক্ষ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য বিজেপি ‘লাভ জিহাদ’, গো-রক্ষা, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC)-এর মতো নীতিগুলো চালু করেছে, যা মূলত মুসলিম সম্প্রদায়কে টার্গেট করার জন্যই তৈরি।
এছাড়াও, বিজেপি ইতিহাস পুনর্লিখনের মাধ্যমে মুসলিম শাসকদের ভূমিকা এবং অবদান মুছে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুঘল ইতিহাস বাদ দেওয়া, মুসলিম স্থাপত্য ও সংস্কৃতির অবদান অস্বীকার করা— এসব উদ্যোগের মাধ্যমে ইতিহাসের একটি বিশেষ সংস্করণ উপস্থাপনের প্রচেষ্টা চলছে, যা শুধুমাত্র হিন্দু জাতীয়তাবাদকে জোরদার করতে সাহায্য করছে। ধর্মীয় মেরুকরণের ক্ষেত্রেও বিজেপি-শাসিত ভারতে বড় পরিবর্তন এসেছে। তাদের শাসনামলে ধর্মীয় সংঘর্ষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের দিল্লির দাঙ্গা কিংবা ২০২৩ সালের হরিয়ানার সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তারই উদাহরণ। বিজেপির রাজনৈতিক কৌশল ধর্মীয় বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে হিন্দু ভোট সংহত করার দিকে পরিচালিত হয়েছে, যা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে আরও উসকে দিয়েছে।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা হ্রাস পাওয়ার ঘটনাও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং গণমাধ্যমের ওপর বিজেপির নিয়ন্ত্রণ জোরদার হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান কার্যত সরকারের স্বার্থ রক্ষার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে, ফলে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিই দুর্বল হয়ে পড়ছে।
এভাবে দেখা যায়, বিজেপির শাসনকাল আদতে সেই প্রবাদের প্রতিফলন যেখানে বলা হয়, “ক্ষমতা দুর্নীতির জন্ম দেয়, আর সম্পূর্ণ ক্ষমতা সম্পূর্ণ দুর্নীতির জন্ম দেয়।” বিজেপির ক্ষমতা দৃঢ় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রবণতা বাড়ছে, যেখানে বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করা হচ্ছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে কেবলমাত্র একদলীয় শাসনের স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভারতে বিজেপি ও আরএসএসের রাজনীতি শুধুমাত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়, এটি দলিত, আদিবাসী, নারী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধেও এক গভীর ষড়যন্ত্র। এটি একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা, যেখানে ধর্মের নামে সংখ্যাগুরুর আধিপত্য চাপিয়ে দেওয়া হবে। “যে ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ করে না, সে নিজেই তার শিকার হয়।” ভারত যদি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে চায়, তবে এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই। ইতিহাস সাক্ষী, যে-সমাজে ফ্যাসিবাদ জয়ী হয়েছে, সে-সমাজ ধ্বংসের মুখে পড়েছে। অতএব, প্রতিরোধ এখন সময়ের দাবি। “অন্যায় সহ্য করাও অন্যায়ের সমান।”