ডেটা চোরের উৎপাত

সাধারণ মানুষ ইন্টারনেটের দুনিয়ায় এতটাই মেতে আছেন যে, তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্যগুলোর খেয়াল রাখতেও ভুলে যান। ওদিকে চোরেরা ওঁত পেতে আছে কোন সুযোগে সেগুলো চুরি করে— এ-বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে তুলতেই কলম ধরেছেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

ইন্টারনেট পাড়ায় চোরের উৎপাত
ব্যস্ত সবাই এদিক-ওদিক করছে ঘোরাঘুরি–
বাবু হাঁকেন, ‘ওরে আমার গোঁফ গিয়েছে চুরি!’
গোঁফ হারানো! আজব কথা! তাও কি হয় সত্যি?
গোঁফ জোড়া তো তেমনি আছে, কমেনি এক রত্তি।

আরও পড়ুন-যুবভারতীর বিপুল ক্ষতিতে উঠছে প্রশ্ন, দায় এড়াল ফেডারেশন ও আইএফএ

গোঁফ হারানোর গল্প শুনে নিশ্চয়ই হাসি পাচ্ছে—পাবেই তো; গোঁফ তো গোঁফের জায়গাতেই আছে তার আবার চুরি কীসের। একদম ঠিক কথা, কিন্তু বাস্তবে গোঁফ চুরি সত্যি! গতকাল সন্ধ্যায় দেখি পরিতোষ আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। পরিতোষ আমার ছোটবেলার বন্ধু। ফেসবুকে খুবই অ্যাক্টিভ। রিল বানিয়ে টাকা পাওয়ার দোরগোড়ায়! ভাবলাম নতুন কোনও ফেসবুক আইডি খুলে হয়তো আমাকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। অ্যাকসেপ্ট করতে যাব এমন সময় কী মনে হল কী জানি— একবার ফোন করলাম। ও বলল, সে নাকি নতুন কোনও আইডি-ই খোলেনি! একটু নেড়েচেড়ে দেখতেই জানা গেল ওটা ফেক আইডি। অন্য কেউ বানিয়েছে। দেখলেন, চোরের কেমন কাজ! ওর প্রোফাইল ওর কাছেই রয়েছে, অথচ কেউ একজন হুবহু ওর প্রোফাইল বানিয়ে রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছে। হল না গোঁফ চুরি! আসলে ওরা ডেটা চোর। অন্যের তথ্য চুরি করে, বলা ভাল কপি পেস্ট করে নকল পরিচয় তৈরি করে। আপনাদের অনেকের সঙ্গেই এমন ঘটনা হামেশাই হচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই, লোক ঠকানো! বর্তমানে ইন্টারনেট দুনিয়ায় এদের উৎপাত খুবই বেড়েছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক অত্যাচারের শিকার হতে হচ্ছে এই ডেটা চোরের দৌরাত্ম্যে।
সীমানা পেরিয়ে
সাল ১৯৬৮, অ্যাপ্রানেটের হাত ধরে পৃথিবীর বুকে ইন্টারনেটের আগমন। সে এক বিরাট প্রাপ্তি! কিছু কমতি ছিল বটে; সেসব কাটিয়ে ১৯৮৩ সালের ১ জানুয়ারি অ্যাপ্রানেট ও দ্য ডিফেন্স ডেটা নেটওয়ার্কের একত্রিত প্রচেষ্টায় পুরোপুরিভাবে ইন্টারনেটের প্রাপ্তি ঘটল। বিশ্ব জুড়ে তখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে সীমানা পেরোনোর হিড়িক! ভারতবাসীরাও এ-ব্যাপারে পিছিয়ে ছিলেন না; এডুকেশনাল রিসার্চ নেটওয়ার্কের হাত ধরে ইন্টারনেটের ভারতে অনুপ্রবেশ ১৯৮৬ সালে। তবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ইন্টারনেটের পরিচয় ঘটে ১৯৯৫ সালের ১৫ অগাস্ট, স্বাধীনতা দিবসের দিন। এই শুভ কাজটির সূচনা করেছিল বিদেশ সঞ্চার নিগম লিমিটেড। ব্যস, তাহলে আর কী! এরপর থেকে সাধারণ মানুষ মারাত্মকভাবে ইন্টারনেট-নির্ভর হয়ে পড়ে— সহজেই এবং তাড়াতাড়ি তথ্যের লেনদেনের তাগিদে।

আরও পড়ুন-রাজ্যের শহরাঞ্চলেও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের জন্য পাকা ছাদের উদ্যোগ

এরমধ্যে ১৯৯১ সালে ব্রিটিশ প্রোগ্রামার টিম বার্নার্স লি এই পৃথিবীকে উপহার দিলেন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব। চারিদিকে হইচই পড়ে গেল। ক্রমে প্রযুক্তির বাজারে এল সোশ্যাল মিডিয়া। ১৯৯৭ সালে মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয় প্রথম স্যোশাল মিডিয়া সাইট সিক্স ডিগ্রিজের। পিছু পিছু আসে ট্যুইটার, ফেসবুক, উইচ্যাট, শেয়ার চ্যাট, ইনস্টাগ্রাম, পিন্টারেস্ট, কিউজোন, উইবো, ভিকে, টাম্বলার, বাইদু তিয়েবা, থ্রেডস ও লিঙ্কডইন-এর মতো সমাজমাধ্যমগুলো। তবে ইউটিউব, লেটারবক্সড, কিউকিউ, কোরা, টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যাল, লাইন, স্ন্যাপচ্যাট, ভাইবার, রেডিট, ডিসকর্ড, বিকিস ও টিকটকের মতো জনপ্রিয় এবং বহুল ব্যবহৃত মাধ্যমগুলোকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় মনে করা হয়। সমাজমাধ্যমে সাধারণ মানুষের ঢল এখন সামলানো দায়! অন্যকে চেনা এবং নিজেকে তুলে ধরার এ এক অনন্য উপায়।
ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়ার পাশাপাশি বিজ্ঞান এই বিশ্বকে আরও একটি মনে রাখার মতো উপহার দিয়েছে। সাল ১৯৯২, পৃথিবীর মানুষ পেল আইবিএম সাইমন পার্সোনাল কমিউনিকেটর মোবাইল, বলা ভাল স্মার্টফোন, তবে স্মার্টফোন কথাটি অফিসিয়ালি ব্যবহৃত হয় ১৯৯৭ সাল থেকে। আমাদের দেশেও প্রথম টাচস্ক্রিন স্মার্টফোন আসে ২০০৪ সালে, নোকিয়া ৭৭১০। যদিও সাধারণ মানুষ প্রথম ব্যবহার করে ২০০৮ সালের নোকিয়া ৫৮০০ এক্সপ্রেস মিউজিক। এখন মজার কথা, আজকের দিনে আমরা ছোট থেকে বড় সবাই সারাক্ষণ ইন্টারনেট, স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার ত্রিকোণ প্রেমে মগ্ন।
রঙিন দুনিয়ার আবেশ
সকাল থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, রাত কাটিয়ে আবার সকাল, সর্বক্ষণই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন ও স্যোশাল মিডিয়া। কিন্তু সবটাই যে শুধুমাত্র ভালর জন্য, কাজের কথা ভেবে তা নয়; বর্তমানে ইন্টারনেটের ব্যবহার অনেকটাই অকারণে হচ্ছে। ছোট থেকে বড় প্রায় সকলেই সোশ্যাল মিডিয়ার তাড়িত আবেগের বশে সময় নষ্ট করে চলেছে। লাইক, শেয়ার ও কমেন্টের মায়াবী জালে ওরা পুরোপুরি আটকে গেছে। বিজ্ঞানের আশীর্বাদ ক্রমেই অভিশাপ হয়ে দেখা দিচ্ছে।
জার্মান সংস্থা স্ট্যাটিস্টার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এইসময় পৃথিবীর প্রায় ৫৫২ কোটি মানুষ ইন্টারনেট এবং ৪৮৮ কোটি মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। ভারতেও প্রায় ৯৫.৪৪ কোটি মানুষ ইন্টারনেট এবং ৬৫.৯ কোটি মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট দুনিয়ায় চলাফেরা করেন চিন এবং ভারতের লোকেরা। জিএসএমএ ইন্টেলিজেন্সের একটি রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, আমাদের দেশে প্রায় ১১২ কোটি সেলুলার মোবাইল কানেকশন রয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ডেটা রিপোর্টাল-এর তথ্য-পরিসংখ্যান বলছে, এই মুহূর্তে পৃথিবীর প্রায় ৫২২ কোটি সক্রিয় স্যোশাল মিডিয়া ইউজার রয়েছে; যার মধ্যে ৪৬.২ কোটি ভারতবাসী। শুধু ফেসবুকেই রয়েছে প্রায় ৩৭ কোটি ভারতীয়র অ্যাকাউন্ট; ইউটিউবে ৪৬ কোটি, লিঙ্কডইনে ১২ কোটি, ইনস্টাগ্রামে ৩৬ কোটি, স্ন্যাপচ্যাটে ২০ কোটি, ফেসবুক মেসেঞ্জারে ১২ কোটি, এছাড়াও ট্যুইটার অর্থাৎ এক্সেও রয়েছে প্রায় ৩ কোটি ভারতীয়র অ্যাকাউন্ট।
শিকারির পাতা ফাঁদ
সভ্যতা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। সেই গতির সঙ্গে তাল মেলাতেই সাধারণ মানুষ আজ ইন্টারনেটের সঙ্গে এত বেশি যুক্ত। কিন্তু অনলাইনের সমস্ত যোগাযোগ কিংবা কাজকর্ম সুরক্ষিত নয়। শুধু কি তাই, আমরা অধিকাংশ সময়ই অত্যন্ত অসচেতনভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করি। বলা বাহুল্য, ভারতবর্ষের মোবাইল-ইন্টারনেট ইউজারদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি গ্রামের মানুষ। তাই আমরা সবসময় মায়াবী অনলাইনের চাল বুঝতে পারি না।
ওরা শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত ভদ্রলোক, কিন্তু ওদের মনে চোর, ওরা ওঁত পেতে বসে থাকে অনলাইনে, সুযোগ খোঁজে আমার-আপনার মতো ইউজারদের প্রোফাইলে সিঁদ কাটার জন্য, মাঝেমধ্যে নানারকম লটারি জেতা, টাকা পাওয়া, গিফ্ট পাওয়ার মতো লোভনীয় লিঙ্ক পাঠায়, মেসেজ করে, কখনও কখনও ফোনও করে, ওটিপি চাই, কিন্তু দিলেই শেষ! দেখবেন আমার-আপনার ব্যক্তিগত সমস্ত তথ্য নিমেষে চুরি গেছে। আপনি জানতেও পারবেন না, আপনার নাম করে কে কখন ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে হাওয়া হয়ে গেছে; কিংবা হয়তো আপনার নাম করে মোটা টাকার লোন তুলেছে; নাহয় কোনও ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু ঠকছেন আপনি। আজকালকার ডিজিটাল ডেটা চোরের এমনই কারসাজি!
স্যোশাল মিডিয়ায় অ্যাকাউন্ট খোলা মানেই নিজের গোপনীয়তার সঙ্গে আপস করা। কিন্তু তাতে কী— সময়ে সময়ে সেলফি পোস্ট, কী খাচ্ছি কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে যাচ্ছি, কী পরেছি কী পরব এসব না জানালেই যেন নয়! লাইক কমেন্ট শেয়ারের উত্তেজনাই আলাদা! পর্দার আড়ালের ডেটা চোর সেখান থেকেই জেনে নিচ্ছে আমার-আপনার ভাল-লাগা, মন্দ-লাগা, পেশা, নেশা ও এমনকী সারাদিনের কাজের শিডিউল। চট করে তৈরি করে ফেলছে একটি উপযোগী ডিজিটাল প্রোফাইল। প্রয়োজনমতো বেচে দিচ্ছে কোনও এক থার্ড পার্টির কাছে। তথ্যের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন! দুর্ভাগ্য ওই তথ্য আমার-আপনার একান্তই ব্যক্তিগত; আমাদেরই অসচেতনতার কারণে ডেটা চোরেরা সেগুলো নিয়ে ব্যবসা করছে।

আরও পড়ুন-বিষ্ণুপুর বাইপাসে রাজ্য গড়ে তুলবে সাততলার আধুনিক মার্কেটিং হাব, মউ স্বাক্ষরের পর হল জমি পরিদর্শন

চোরের বুদ্ধি
আজকাল এইসব ডিজিটাল চোরের উপদ্রব বড্ড বেড়েছে। সাইবার জগতে অপরাধের তালিকা প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে। পাবলিক রেসপন্স এগেইনস্ট হেল্পলেসনেস অ্যান্ড অ্যাকশন ফর রিড্রেসাল বা প্রহরের রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, আমাদের দেশেও আগামী ২০৩৩ সালের মধ্যে সাইবার অ্যাটাকের সংখ্যা বছরে ১ ট্রিলিয়ন পর্যন্ত বেড়ে যাবে। দুঃখজনক যে, এই সংখ্যাটি আগামী ২০৪৭ সালে গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ১৭ ট্রিলিয়ন। পিডব্লিউসি ইন্ডিয়া খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, প্রায় ১৬ শতাংশ ভারতীয় ইন্টারনেট ইউজার তাদের ডেটা সিকিউরিটি বা ডেটা প্রাইভেসির ব্যাপারে কোনও কিছুই জানেন না।
আড়ালে থাকা ডেটা চোরেরা এইসব অসাধু কাজকর্ম সম্পন্ন করতে নানা ধরনের উপায় বাতলে থাকেন। মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সামান্য ভুল কিংবা অসাবধানতার সুযোগ নিয়ে ওরা তথ্য লোপাট করে। ইমেইল বা সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের দুর্বল পাসওয়ার্ডগুলো ধারণা করে প্রোফাইলে লগইন করে। কখনও ফিশিং সাইটের প্রলোভনে কোনও ইন্টারনেট ইউজারের গোপন তথ্য আদায় করে নেয়। এমনকী ম্যালওয়্যার, রানসামওয়্যার, ভাইরাস কিংবা ডিজিটাল ব্ল্যাক মেইলিং-এর মাধ্যমে তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে ডেটা চোরের দল। বেচে দিচ্ছে ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠান, উৎপাদনশীল কোম্পানি, রাজনৈতিক দল, বেসরকারি সংস্থা, স্বার্থপর ব্যবসায়ী কিংবা কোনও সন্ত্রাসী গ্রুপের মতো থার্ড পার্টির কাছে। পয়সার বিনিময়ে পরের গোপনীয়তা একদল বিক্রি করছে, অন্যদিকে একদল কিনছে, সবটাই মুনাফার জন্য। কিন্তু ঠকছে সাধারণ মানুষ!
বাঁচার উপায়
তথ্যের গোপনীয়তা নষ্ট হওয়ার কারণেই সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছেন বহু মানুষ। বদলে যাচ্ছে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমীকরণগুলো। শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে ঘটছে খারাপের জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। ভুগছে জনস্বাস্থ্য। ব্যক্তিগত তথ্যের এই ধরনের অপব্যবহার বন্ধ করতে, সাধারণ মানুষের মধ্যে ডেটা সিকিউরিটি ও ডেটা প্রাইভেসির ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে সারা পৃথিবী জুড়ে প্রতিবছর ২৮ জানুয়ারি দিনটি পালিত হয় ‘ডেটা প্রাইভেসি ডে’ হিসেবে।
নানারকম গেমসে টাকা উপার্জন, কর্মসংস্থান, লোন, ফেক ওয়েবসাইট, এনজিও, বার কোড, কিউআর কোড, ভরতুকি, অনলাইন বুকিং, ফ্রি হোম ডেলিভারি, কিংবা স্টক মার্কেটে দারুণ রিটার্নের প্রলোভন হোক কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় মানহানির ভয় দেখানো, এভাবেই চলে ইনফরমেশন সংগ্রহের চক্র। এই ফাঁদ আটকাতেই, মানুষকে ডিজিটাল শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে, কাউন্সিল অব ইউরোপ ২০০৭ সালে প্রথম ইউরোপিয়ান ডেটা প্রোটেকশন ডে পালন করে। দু’বছর পর ইউনাইটেড স্টেটসের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ রিজোলিউশন পাশ করে ২০০৯ সালের ২৮ জানুয়ারি ন্যাশনাল ডেটা প্রাইভেসি ডে হিসেবে চিহ্নিত করে। সেই থেকেই এই দিনটি আমেরিকা, কানাডা, কাতার, নাইজেরিয়া, ইজরায়েল-সহ ইউরোপের আরও ৪৭টি দেশে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উদযাপিত হয়।
আমাদের দেশ ভারতবর্ষেও ডেটা সিকিউরিটি কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার উদ্যোগে এই দিনটি পালন করা হয়। অন্ধকারে থাকা ডেটা চোর বা হ্যাকারদের কাছে তথ্যগুলো যেন জানলার ধারে রাখা আছে; এখন সেগুলো রক্ষা করতে হলে জানলার গায়ে বেড়া দিতে হবে তাহলে আর চোর ঢুকতে পারবে না; যাকে বলে ডেটা সিকিউরিটি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধু বেড়া নয়, প্রয়োজনে জানলার গায়ে কোনও পর্দা, নাহয় জানলাটা পুরো বন্ধ করে দিতে হবে, যাকে বলে ডেটা প্রাইভেসি বা প্রোটেকশন। তাহলে আর চোর দেখতেও পাবে না, চুরিও করতে পারবে না। তাই আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় ডিভাইসের সফটওয়্যার ও অ্যাপগুলো লেটেস্ট ভার্সন আপডেট করে রাখতে হবে, পাসওয়ার্ড যতটা সম্ভব আনকমন ও কঠিন রাখতে হবে, ব্রাউজিং-এর সময় কুকিজ এবং ক্যাশে গুলো ডিলিট করে দিতে হবে। ওয়েবসাইটে লগইন করলে প্রাইভেসি সেটিংসে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া খুবই জরুরি। অন্যথায় বিপদ এড়ানো মুশকিল!

আরও পড়ুন-স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাঠ দিল জৈবহাট, সচেতন করলেন বক্তারা

ডিজিটাল অ্যারেস্টের ফাঁদ
তবে আজকের ডিজিটাল যুগে প্রতারণার রূপ বদলে গেছে, আর সেই বিবর্তনের এক কুৎসিত অধ্যায় হল তথাকথিত ডিজিটাল অ্যারেস্ট, একটি মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদ, যা প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের ভয়কে পুঁজি করে। সাইবার অপরাধীরা প্রথমে নিজেকে সরকারি সংস্থার কর্মকর্তা, পুলিশ বিভাগ, বা বিচার বিভাগের প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে ভুক্তভোগী কে তথ্যগত চাপে ফেলতে চায়। ইমেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার ইনবক্স, যে কোনও মাধ্যমেই তারা পাঠিয়ে দেয় নকল অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বা সমন। অভিযোগের তালিকা ছড়িয়ে থাকা অ্যালগরিদমের মতো—পর্নোগ্রাফি, স্মাগলিং, মানি লন্ডারিং কিংবা ড্রাগ ট্রাফিকিং। সবই সাজানো, সবই ভুয়ো, আকর্ষণের মতো কিন্তু ভিত্তিহীন।
সামাজিক মনোবিজ্ঞান বলছে, এ ধরনের প্রতারণা আমাদের মস্তিষ্কের ‘ফাইট-অর-ফ্লাইট’ প্রতিক্রিয়া সক্রিয় করে। মস্তিষ্কের অ্যামাইগডালা আতঙ্কে ভরপুর সিদ্ধান্ত নেয়, যুক্তির প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স তখন প্রায় অচল হয়ে পড়ে। গুরুত্বহীন সন্দেহও তখন সত্যের রূপ নেয়। ফলে সাধারণ মানুষ তড়িঘড়ি নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে নথি, পরিচয়পত্র, ব্যাঙ্ক ডিটেলস, এমনকী ভারী অঙ্কের টাকাও পাঠিয়ে দেন অপরাধীদের হাতে। প্রতারণা ঘটে দিনদুপুরে, প্রযুক্তির আলোয় দাঁড়িয়ে মানুষ যেন মানসিক অন্ধকারে পড়ে যায়।
এই চক্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের মূলমন্ত্র হল তথ্য ও সচেতনতা। কোনও সরকারি দফতর কখনওই ফোন, মেসেজ বা সোশ্যাল মিডিয়ার ইনবক্সে কাউকে গ্রেফতারের নোটিশ দেয় না। এটি একটি মৌলিক প্রশাসনিক প্রোটোকল। সন্দেহজনক বার্তা পাওয়ামাত্রই তথ্য যাচাই করা, অফিসিয়াল হেল্পলাইন ব্যবহার করা এবং নিজেকে শান্ত রাখতে পারাই সবচেয়ে বড় ঢাল। বিজ্ঞান যেমন সত্যের অনুসন্ধান শেখায়, তেমনই ডিজিটাল নাগরিকত্ব শেখায় সচেতনতা ও প্রমাণভিত্তিক বিচারবোধ। এই দুইয়ের সমন্বয়েই প্রতারণার অন্ধকার ভেদ করে একজন হয়ে ওঠে নিরাপদ, আত্মবিশ্বাসী ব্যবহারকারী, যিনি প্রযুক্তিকে ব্যবহার করেন, কিন্তু প্রযুক্তির ফাঁদে পড়েন না।

Latest article