পেগাসাস কেলেঙ্কারি। আড়িপাতা কাণ্ড। ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিসর বিপন্ন। শীর্ষ আদালতের সাম্প্রতিক রায়ে বেআব্রু মোদি সরকার। লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়
জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা এবার ধাক্কা খেয়েছে শীর্ষ আদালতে। পেগাসাস মামলার রায়ে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আর ভি রবীন্দ্রনের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গড়ে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। ২৭ অক্টোবরের এই রায়ে বলা হয়েছে সামরিক স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে ভারতে ভারতীয় নাগরিকদের খবরাখবর সংগৃহীত হয়েছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখবে ওই কমিটি। রায়ের শুরুতে ব্যবহৃত হয়েছে জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত রচনা ‘নাইনটিন এইট্টিফোর’ থেকে উদ্ধৃত একটি অংশ। “If you want to keep a secret, you must also hide it from, yourself.” যদি তুমি কিছু গোপন করতে চাও তবে তা নিজের কাছে থেকেও লুকিয়ে রেখ। এখন, প্রশ্ন হল এসব কথা বলার বা উল্লেখ করার দরকার পড়ল কেন?
পড়ল, তার অন্যতম কারণ মোদি সরকারের আচরণ। ভারতের সংবিধান বলছে, গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার সীমায়িত হতে পারে, হতেই পারে। তবে তার পিছনে থাকতে হবে বৈধ উদ্দেশ্য। পাশাপাশি, এই পরিসর খর্ব করার উদ্দেশ্য এবং এই খর্ব করার ফলে যে ক্ষতি নাগরিকদের হবে তার পরিমাণ, এ দু’য়ের মধ্যে যেন সামঞ্জস্য থাকে। সংবিধান কর্তৃক নির্দিষ্ট এই নীতি যদি পেগাসাসের ক্ষেত্রে মোদি সরকার মেনে চলত, তাহলে এই স্পাইওয়্যার ব্যবহারের আগে, সেই ব্যবহারকে আইনসম্মত করার জন্য এই সংক্রান্ত একটা আইন পাশ করত। সেসব করেনি বলেই, এ ধরনের গোপন আড়িপাতা সফটওয়্যার ব্যবহারের বৈধতা নেই বলেই, মোদি সরকার এই মামলায় কোনও এভিডেভিট পেশ করেনি। তার বদলে আদালতে পেশ করেছে, একাধিকবার পেশ করেছে, সেই একই কথা, যেটা মোদি-মন্ত্রিসভার এক সদস্য সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন। মোদি সরকারের ওই মন্ত্রী মহোদয় বারবার সংসদ কক্ষে আড়িপাতার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
মুশকিল হল, সংসদে যে বক্তব্য পরিবেশিত হয় সেটি পার্লামেন্টারি প্রিভিলেজ বা আইনসভার সদস্যদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিশেষ অধিকার দ্বারা সংরক্ষিত। সেখানে মিথ্যা বললে বা বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করলে তার জন্য কোনও শাস্তিবিধানের ক্ষমতা আদালতের নেই। কিন্তু আদালতে যদি এফিডেভিট বা হলফনামা পেশ করে এমনটা করা হয় তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মিথ্যা হলফনামা দেওয়ার দায়ে কারাদণ্ডও হতে পারে।
মোদি সরকার এসব ভালমতোই জানে বলে, জেল জরিমানা এড়াতে, সযত্নে এফিডেভিট দাখিলের পথে পা মাড়ায়নি। সরকারের এই আচরণ নিশ্চয়ই শীর্ষ আদালতের চোখ এড়ায়নি। তাই-ই তাঁরা ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র কুমিরছানা মার্কা অজুহাত দেখিয়ে হলফনামা দাখিল করা থেকে বিরত থাকার বিষয়টিকে আর মানতে চাননি। সলিসিটর জেনারেল লিখিতভাবে কিছু না জানিয়ে মুখে মুখে ওই জাতীয় নিরাপত্তার কথাটি বলেছেন। তাতে যে চিঁড়ে ভেজেনি, শীর্ষ আদালতের রায়ে তা সুস্পষ্ট। সেখানে বলা হয়েছে, “such an omnibus oral allegation is not sufficient.” অস্যার্থ, বহু উদ্দেশ্যসাধক এরকম মৌখিক অভিযোগ এ বিষয়ে যথেষ্ট নয়।
এই যে জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে, সে সংক্রান্ত কোনও নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ কিন্তু মোদি সরকার আদালতে দাখিল করতে পারেনি। বরং, সেরকম কোনও নথি বা তথ্য দেখাতে বা পেশ করতে অস্বীকার করেছে। রায়দানকালে শীর্ষ আদালত তাই বলছে, “We had made it clear … we would not push … to provide any information that would impact national security.” শীর্ষ আদালত স্পষ্ট জানিয়েছেন, জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে এমন কোনও নথি প্রকাশের ব্যাপারে তাঁরা জোরাজুরি করছেন না। তা বলে বিষয়টা স্রেফ ওই অজুহাতে সরকার পক্ষ এড়িয়ে যাবে, এই বিষয়টিকেও অন্যায্য বলে মনে করেছেন তাঁরা। তাই, তাই-ই শেষ পর্যন্ত তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
আরও একটা কথা। কে এস পুত্তাস্বামী রায়ে গোপনীয়তার অধিকার রক্ষার বিষয়ে একটা গাইডলাইন বানানো হয়েছিল। সেই গাইডলাইনটিকে সামনে রেখে এবার শীর্ষ আদালত রায়ে স্পষ্টতর ভাষায় জানিয়েছেন, জাতীয় নিরাপত্তার জুজু দেখালেই বিচার বিভাগ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠবে, সেটা কিন্তু নয়। স্রেফ ওই কথা বললেই ছাড় পাওয়া যাবে না। “Mere invocation of national security by the State does not render the Court a mute spectator.” জাতীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গ টেনে এনে যদি রাষ্ট্র ভাবে আবারও আদালতকে স্রেফ দর্শকের ভূমিকায় আটকে রাখা যাবে, তবে তারা ভুল করছে, সেকথাটাও সুপ্রিম কোর্ট এবারের রায়ে কোনও রাখঢাক না করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। রায়ে উল্লিখিত এই মন্তব্যগুলো যে আগামী দিনেও বিভিন্ন মামলায় পূর্ব দৃষ্টান্ত বা আইনগ্রাহ্য নজির হিসেবে ব্যবহৃত হবে, সেকথা বলাই বাহুল্য। আর এটা ভেবেই সম্ভবত মোদি-শাহ-র কপালের ভাঁজ চওড়া হচ্ছে।
পরিশেষে আর একটা কথা। সলিসিটর জেনারেল চেয়েছিলেন, সরকার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করুক এবং সেই কমিটি বিষয়টা তদন্ত করে দেখুক। ১ নভেম্বর, ২০১৯-এ পেগাসাসের বিষয়টা সামনে আসা সত্ত্বেও সরকার এনিয়ে কোনও হেলদোল দেখায়নি। সেজন্যই সলিসিটর জেনারেলের ওই আর্জি শীর্ষ আদালত নাকচ করে দিয়ে নিজেরাই কমিটি গড়ে দিয়েছেন।
এই রায় আদালতের ওপর, বিচার ব্যবস্থার ওপর দেশবাসীর আস্থা আরও মজবুত করল। আর সেটাই বোধহয় মোদি-শাহদের সবচেয়ে বেশি ভয়ের কারণ।