কবিতার ছন্দে বর্ষার গন্ধ

ভরা বর্ষায় মানব মনে আসে তুমুল প্রেমের জোয়ার। সেই জোয়ারে ভাসতে ভাসতে কবিরা প্রেমের ব্যাকুলতা প্রকাশ করেন বিভিন্ন কবিতায়। বিষয়বস্তু হিসেবে বর্ষা কমবেশি প্রায় সব কবির রচনায় উপস্থাপিত হয়েছে। এই ঋতুর আবেদন মধ্যযুগের বাংলা কবিতা থেকে শুরু করে সমসাময়িক কবিদের কবিতায় অনুরণিত। তাঁরা বর্ষাকে কবিতার, কবিতাকে বর্ষার পরিপূরক করে তুলেছেন। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

মানব মনে প্রেমের জোয়ার
কবিদের মন ও আবেগকে বিশেষভাবে আলোড়িত করে বর্ষা। এই ঋতুর আবেদন অন্যরকমের। অন্য মেজাজের। বিষয়বস্তু হিসেবে কমবেশি প্রায় সব কবির কবিতায় প্রাণ পেয়েছে। বর্ষা আমাদের মনকে যুগপৎ আনন্দ-বেদনা ও বিরহকাতরতায় সিক্ত করে। প্রাণরসে জাগিয়ে তোলে প্রকৃতিকে। সবুজে সবুজে ভরিয়ে দেয় পরিবেশ। এই ঋতুর আবেদন মধ্যযুগের বাংলা কবিতা থেকে শুরু করে সমসাময়িক কবিদের কবিতায় অনুরণিত। তাঁরা বর্ষাকে কবিতার, কবিতাকে বর্ষার পরিপূরক করে তুলেছেন, কবিতার বিভিন্ন কাব্যিক ব্যঞ্জনা অনুপ্রাস ও দ্যোতনায়। তাঁদের কবিতার ছন্দে লেগে থাকে বর্ষার গন্ধ। ভাববাদী মানুষেরা প্রেমের ঋতু হিসেবে বর্ষাকেই বিবেচনা করেন। কেননা এই ঋতুতেই প্রকৃতিতে লাস্যময়তার সঙ্গে সঙ্গে মানব মনেও তুমুল প্রেমের জোয়ার আসে। সেই জোয়ারে ভাসতে ভাসতেই কবিরা বিভিন্ন কবিতায় প্রকাশ করেন প্রেমের বিবিধ ব্যাকুলতা।

আরও পড়ুন-বাড়ি-বাড়ি পানীয় জল পৌঁছে দিতে জোরকদমে কাজ শুরু

প্রিয়া বিরহের যাতনা
মহাকবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’-এ দেখা যায়, রামগিরি পর্বতের উপর দিয়ে যখন মেঘ ডানা মেলে উড়ে যেত, তখন যক্ষের মনে জাগত প্রিয়া বিরহের যাতনা। তাই তিনি বিশদ ব্যাকুলতা বর্ণনা করে মেঘকে দূত করে পাঠাতেন প্রিয়ার কাছে। কালিদাসের সমাধিতে নৈবেদ্য আকারে বর্ষা সারাক্ষণ ঝরে কি না, জানা নেই, তবে বর্ষার আজীবনের ঋণ তাঁর কাছে। আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং যদি রামগিরি পর্বতের উপর দিয়ে উড়ে না যেত, আর সেই মেঘ দেখে যক্ষের মনে না জাগত প্রিয়া বিরহের যাতনা, তবে কি মেঘ কিংবা এই বর্ষা কাব্যদেবীর যোগ্য রসদ হত? হয়তো হত না।
বৈষ্ণব পদাবলীর কবিদেরকেও বিরহের সঙ্গে বর্ষার নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে দেখা যায়। বর্ষাকে তাঁরা দিয়েছেন স্থিতিস্থাপকতা। পদাবলী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাজনদের কবিতায় বর্ষা এসেছে একাধিকবার। রাধাকৃষ্ণের প্রেমের সঙ্গী হিসেবে। অভিসার ও বিরহ, দুই পর্বে। চণ্ডীদাস প্রেম বিরহকাতরতার কথা প্রকাশ করেন তাঁর কবিতায়। লেখেন, ‘এ ঘোর রজনি মেঘের ঘটা/ কেমনে আইল বাটে/ আঙিনার মাঝে বধূয়া ভিজিছে/ দেখিয়া পরাণ ফাটে।’
বিদ্যাপতির বিরহের কবিতায় বর্ষা ও বিরহ একাকার হয়ে গেছে, যা নতুনত্ব পায় মধ্যযুগের বাংলা গীতিকবিতায়। সেখানে বর্ষা এসেছে রাধিকার প্রেমকে উসকে দেওয়ার জন্য। বিশেষ করে অভিসার আর বিরহ পর্বে বর্ষা যেন প্রেমানলে ঘিয়ের ছিটা। বিদ্যাপতি লেখেন— ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর/ এ ভরা ভাদর মাহ বাদর/ শূন্য মন্দির মোর।’ এখানে বৃষ্টির জল যেন রাধার চোখের জল হয়ে ঝরে পড়ছে। যা পৃথিবীর সকল প্রেমিকাকেই ব্যাকুল করে তোলে।
উপরের কবিতাগুলোয় রাধার মনের প্রেম, কামনা-বাসনা আরও উসকে দিয়েছে বর্ষা। এখানেই এই ঋতুর সার্থকতা।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বর্ষাকে কল্পনা করেছেন প্রকৃতির অরূপ শক্তি হিসেবে। তাঁর কবিতায় বর্ষার প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় বর্ষার রূপকল্প বর্ণনা করেছেন এভাবেই— ‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর/ উথলিল নদ-নদী ধরণীর উপর/ রমণী রমন লয়ে সুখে কেলি করে/ দানবাদী দেব যক্ষ সুখিত অন্দরে।’
একা দ্বারের পাশে
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অজস্র কবিতায়-গানে বর্ষা এসেছে মহা সমারোহে। এই ঋতুর আবেদন যে এত বেশি সুধাময় হয়, তা প্রথম দেখিয়েছেন তিনিই। তাঁর চোখ দিয়ে এই ঋতুকে নতুনভাবে চিনতে শিখেছি, বুঝতে শিখেছি। ‘বর্ষার দিনে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন— ‘এমন দিনে তারে বলা যায়,/ এমন ঘনঘোর বরিষায়/ এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে/ তপনহীন ঘন তমসায়।/ সে কথা শুনিবে না কেহ আর,/ নিভৃত নির্জন চারি ধার।/ দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,/ আকাশে জল ঝরে অনিবার/ জগতে কেহ যেন নাহি আর।’
একটি গানে তিনি ব্যক্ত করেছেন বৃষ্টিদিনে একাকী মনের কথা, ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে/ আঁধার করে আসে/ আমায় কেন বসিয়ে রাখ/ একা দ্বারের পাশে।/ কাজের দিনে নানা কাজে/ থাকি নানা লোকের মাঝে,/ আজ যে আমি বসে আছি/ তোমারই আশ্বাসে।’
প্রতীকী ব্যাঞ্জনায় বর্ষা
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন ছন্দের জাদুকর। বর্ষার ছবি এঁকেছেন তিনিও। ‘ইলশেগুঁড়ি’ কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন বর্ষার নাচন। বিশেষ করে হালকা বৃষ্টির সময় প্রকৃতি ও মানুষের মনের কী অবস্থা হয়, সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় বর্ষা ধরা দিয়েছে বিভিন্ন প্রতীকী ব্যঞ্জনায়। বর্ষার মেঘ তাঁর বিরহ-বেদনাকে আরও বেশি উসকে দিয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘বাদল রাতের পাখি/ ওড়ে চল যেথা আজো ঝরে জল, নাহিক ফুলের ফাঁকি।’
কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বর্ষা এক গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুমাত্রিক প্রতিবিম্ব। এই ঋতুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, আবেগ, এবং মানুষের জীবন ও প্রকৃতির সম্পর্ক তাঁর কবিতায় বিশেষভাবে ফুটিয়ে উঠেছে। ‘কেমন বৃষ্টি ঝরে’ কবিতায় লিখেছেন, ‘কেমন বৃষ্টি ঝরে— মধুর বৃষ্টি ঝরে— ঘাসে/ যে বৃষ্টি ঝরে— রোদে যে বৃষ্টি ঝরে আজ/ কেমন সবুজ পাতা— জামীর সবুজ আরও— ঘাস যে হাসির মতো— রোদ যে সোনার মতো ঘাসে’।
কবি বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় বর্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছে। ‘বর্ষার দিন’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘সকাল থেকেই বৃষ্টির পালা শুরু,/ আকাশ-হারানো আঁধার-জড়ানো দিন/ আজকেই, যেন শ্রাবণ করেছে পণ,/ শোধ করে দেবে বৈশাখী সব ঋণ।’

আরও পড়ুন-ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকুন স্থানীয় নেতৃত্বকে বার্তা অভিষেকের

জীবনের একটি অংশ
‘বুড়ো-ভোলোনো ছড়া’য় অন্যভাবে বৃষ্টির প্রসঙ্গ এনেছেন কবি বিষ্ণু দে। লিখেছেন, ‘আয় বৃষ্টি হেনে,/ ছাগল দেব মেনে,/ বোমা ডুবে যাবে/ ডাকাতের দল উবে।’ নিছক বৃষ্টি নয়, তিনি বলেছেন অস্থির সময়ের কথা। সমাজের কথা।
বর্ষার রূপ নানাভাবে প্রকাশ পায় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায়। তিনি এই ঋতুকে জীবনের অংশ হিসেবে দেখিয়েছেন, যেখানে দুঃখ, আনন্দ, স্মৃতি সবকিছু মিলেমিশে একাকার। ‘যখন বৃষ্টি নামলো’ কবিতায় লিখেছেন, ‘বুকের মধ্যে বৃষ্টি নামে, নৌকা টলোমলো/ কূল ছেড়ে আজ অকূলে যাই এমনও সম্বল/ নেই নিকটে- হয়তো ছিলো বৃষ্টি আসার আগে/ চলচ্ছক্তিহীন হয়েছি, তাই কি মনে জাগে/ পোড়োবাড়ির স্মৃতি? আমার স্বপ্নে-মেশা দিনও?/ চলচ্ছক্তিহীন হয়েছি, চলচ্ছক্তিহীন।’
কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বিচ্ছেদ’ কবিতায় বর্ষার একটি প্রতীকী ব্যবহার দেখা যায়। তিনি লেখেন— ‘তোমাকে দিয়েছি চিরজীবনের বর্ষা ঋতু/ এখন আমার বর্ষাতে আর নেই অধিকার/ তবুও হৃদয় জলদমন্ত্রে কাঁপে যেহেতু/ চোখ ঢেকে তাই মনে করি শুধু ক্ষণিক বিকার।’ এই কবিতায় বর্ষা ভালবাসার কষ্টের প্রতীক। তিনি বর্ষাকে ‘চিরজীবনের বর্ষা ঋতু’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা তাঁর ভালবাসার গভীরতাকে প্রকাশ করে।
বর্ষা নিয়ে অসংখ্য কবিতা উপহার দিয়েছেন কবি জয় গোস্বামী। তাঁর কাছে বর্ষা একটি আবেগ ও অনুভূতি, যা তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু ও শৈলীকে প্রভাবিত করে। লিখেছেন কাব্যোপন্যাস ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’, কবিতা ‘মেঘবালিকার জন্য রূপকথা’।
বাস্তব ভূমির উপর আছড়ে পড়ে
কথা হল কবি সুবোধ সরকারের সঙ্গে। বৃষ্টি তাঁর কবিতাকে কতটা প্রভাবিত করে, জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘‘বর্ষার একটা অসামান্য সৌন্দর্য আছে। সে নিজেই নিজেকে প্রকাশ করতে পারে। তবে আমার কবিতায় বর্ষা শুধু বর্ষা হিসেবে কখনও আসেনি। কেবলমাত্র বৃষ্টির সৌন্দর্যকে লিখব ভেবে কখনও কোনও কবিতা লিখিনি। আমার একটি কবিতার কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। নাম ‘দুব্বো’। সেটা লিখেছিলাম প্রায় বাইশ-তেইশ বছর আগে। তখন গুজরাতের দাঙ্গা হয়ে গেছে। ওই দাঙ্গার বিরুদ্ধে একটা কবিতার বই লিখি। নাম ‘কাল্লু’। এই বইতে আছে কবিতাটা। প্রায় দেড় পাতার একটি কবিতা। তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি। তবে বৃষ্টিটা সম্পূর্ণ গুজরাতের দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে। সেখানে একটা ভয়ঙ্কর ঘটনার পর বৃষ্টিকে একজন প্রশ্ন করছে, ‘‘বৃষ্টি তুই হিন্দু নাকি মুসলমান?’’
তিনি আরও বলেন, শহরে বর্ষা একরকম, গ্রামের আরেকরকম। আমি রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানের দারুণ ভক্ত। অনেক গান আমার মুখস্থ। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। বৃষ্টি তো প্রকৃতির দান। আকাশের ব্যাপার। মেঘের ব্যাপার। বর্ষার উপর আমার একটা ক্রাশ আছে। কিন্তু আমার নিজের লেখায় অসম্ভব ভয়ঙ্কর রিয়েলিটির জায়গা থেকে বারবার বৃষ্টি উঠে এসেছে। আমার প্রেমের কবিতার মধ্যেও বৃষ্টি আছে। সেই বৃষ্টি বা বর্ষা রবীন্দ্রনাথের বর্ষা নয়। সেই বৃষ্টি মেঘদূতের বৃষ্টি নয়। আমার বৃষ্টি বা আমার বর্ষা সম্পূর্ণভাবেই বাস্তব ভূমির উপর আছড়ে পড়ে।
একই প্রশ্ন রেখেছিলাম কবি সুজিত সরকারের কাছে। তিনি জানালেন, বর্ষা অবশ্যই আমার প্রিয় ঋতু— নগরজীবনের নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও। তবে, মনে হয়, বর্ষার প্রতি অতিরিক্ত আবেগ জন্ম নেওয়ার অন্যতম কারণ হল রবীন্দ্রনাথের গান। সরাসরি বর্ষা সেভাবে আমার কবিতায় আসেনি। একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে— ‘বেহালায়, বারাসতে, আগরপাড়ায় বিভিন্ন কারণে সকালবেলায় ফোনে কথা বলে জানতে পারলাম, আমি যেখানে থাকি, সেই হাওড়ার মতোই সেখানেও তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। আমার চেতনায় বেহালা, বারাসত, আগরপাড়া মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম, বড়ো এক অনামের ভেতরে সব নাম হয়ে আছে। বড়ো এক অবিভাজ্যতার ভিতরে আমার সবাই বিভাজিত হয়ে আছি।’

আরও পড়ুন-ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকুন স্থানীয় নেতৃত্বকে বার্তা অভিষেকের

কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘বর্ষা মানে বিরহে কাতর যক্ষকে নিয়ে বিষণ্ণ থাকার সে একটা দিন গেছে। বর্ষা মানে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি পর্যায়ের গান নিয়ে যথেষ্ট আদিখ্যেতা করা হয়ে গেছে। শুধু কি তাই! বৃষ্টি পড়ল কি পড়ল না আমাদের ছোট উঠোনের সিঁড়ির ধাপিতে বসে বসে চাঁপাফুলরঙা রোগা বইটি খুলবই আমি। যে বইয়ের নাম ‘ছিন্নপত্র’। বড় হতে হতে নশ্বরতা যখন আমাকে আধমরা করে ফেলেছে প্রায় সেরকম একটা সময় প্রবল বৃষ্টিপাত। বাঁধভাঙা শ্রাবণ। আমরা দু’জনে আলকেউটের ভয় উপেক্ষা করে আলপথ ধরে হেঁটে হেঁটে একটা বাড়িতে গেলাম। তারপর সারারাত তুমুল বৃষ্টি। মুহুর্মুহু বজ্রপাত। তাই, বর্ষা আমি ভুলি না কখনও। লিখি, ‘বাঁশবন আমাকে শুধু টেনে নিয়েছে তার ঘুমে/ আর সেই ঘুমের পথ চিরে-চিরে তখনই তো দেখা হল/ আমাদের দেখা হল।”

Latest article