একটি ছবির তারা

কেউ অভিনয় করেছেন একটি ছবিতে। কেউ-কেউ দু-তিনটি ছবিতে। যদিও দর্শক-মনে বিশেষভাবে রেখাপাত করেছেন একটি মাত্র ছবিতে অভিনয় করেই। আজও তাঁদের নিয়ে হয় জোর চর্চা, আলোচনা। এমনিই কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর উপর আলোকপাত করলেন সন্ময় দে

Must read

ইংরেজিতে ‘ওয়ান নভেল ওয়ান্ডার’-এর মতোই ‘ওয়ান ফিল্ম ওয়ান্ডার’ বলেও একটি কথা আছে। ‘ওয়ান নভেল ওয়ান্ডার’-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল হার্পার লি-র লেখা ‘টু কিল আ মকিং বার্ড’ উপন্যাসটি। এই একটি উপন্যাসই সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু আমরা এখানে উপন্যাস অথবা ছবি নয়, ছবির এমন কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে আলোচনা করব, যাঁরা একটি মাত্র ছবিতে অভিনয় করেই সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন।
এবারে মূল বিষয়ে আসি। ‘ওয়ান ফিল্ম ওয়ান্ডার’-এর অভিনেতাদের নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যে ছবিটির কথা সর্বাগ্রে মনে আসবে সেটি হল ‘পথের পাঁচালী’। ১৯৫৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটিতে পেশাদার অভিনেতা ছিলেন মাত্র তিনজন। কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী আর রেবাদেবী। বাকি সকলেই অপেশাদার অথবা যাঁরা এর আগে কখনও অভিনয় করেননি, অথবা অভিনয়ের সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগ নেই। এমনকী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তখনও পর্যন্ত পেশাদার অভিনেত্রী নন। উল্লেখ্য, এই ছবিতে ছোট দুর্গার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা রুমকি বন্দ্যোপাধ্যায়।
আসি ইন্দির ঠাকরুনের কথায়। ‘পঁচাত্তর বৎসরের বৃদ্ধা, গাল তোবড়াইয়া গিয়াছে, মাজা ঈষৎ ভাঙিয়া শরীর সামনের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে…’; বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে অভিনেত্রী খুঁজে বের করা খুব সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে ওই বয়সি অথবা তার আশপাশের বয়সিদের শারীরিক সক্ষমতা আর স্মৃতিশক্তির সমস্যা হওয়া খুব স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন-ছাত্ররাই সুস্থ রাজনীতির ভবিষ্যৎ পুরুলিয়ার প্রস্তুতি সভায় তৃণাঙ্কুর

সত্যজিৎ রায় তাঁর সহকারীদের ‘ইন্দির ঠাকরুন’ খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিলেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মনের মতো কাউকে পাওয়া গেল না। তখন একজন বললেন, ‘‘কোনও কম বয়সি মহিলাকে মেকআপ আর পরচুলা পরিয়ে…’’।
সত্যজিৎ তৎক্ষণাৎ তাঁর পরামর্শ নাকচ করে দিলেন। ‘পথের পাঁচালী’তে যিনি সেজঠাকরুন হয়েছিলেন, সেই রেবাদেবী খোঁজ দিলেন চুনীবালাদেবীর। ভদ্রমহিলা সম্পর্কে অভিনেত্রী নিভাননীদেবীর মা। সত্যজিৎ দেখা করলেন তাঁর সঙ্গে। তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন ইনি ঠিক তেমনটিই। ভদ্রমহিলা এর আগে ‘বিগ্রহ’ আর ‘রিক্তা’ নামের দুটি নির্বাক ছবিতে অভিনয় করেছেন। আর তারও অনেক আগে মঞ্চে অভিনয় করেছেন।
বাড়ি থেকে পনেরো মাইল দূরে শ্যুটিং স্পট। মোটরে করে শ্যুটিং করতে যাওয়া, শ্যুটিং সেরে সেদিনই আবার ফিরে আসার প্রস্তাবে তিনি হাসিমুখেই সায় দিলেন। শ্যুটিংয়ের দিন রাত থাকতেই উঠে পড়তেন বচ্চন সিংয়ের ট্যাক্সিতে। বোড়ালে সারাদিন শ্যুটিং করে আবার ফিরে আসতেন। একদিনের জন্যও কোনওরকম বিরক্তি দেখাননি। উল্টে শ্যুটিংয়ের সময় দারুণ সিরিয়াস থাকতেন।
চুনীবালার স্মৃতিশক্তির কথা না বললেই নয়। একজন অভিনেত্রী হয়েও যেরকম কন্টিনিউইটি মনে রাখতেন তা অবিশ্বস্য। শট নেওয়ার আগে বলতেন, ‘‘কই, আগের শটে তো আমার হাত ভেজা ছিল, এখন তো ভেজালেন না!’’, অথবা, ‘‘আগের শটে আমার ডান হাতে কাঁথা আর বাঁ-হাতে ঘটি ছিল কিন্তু!’’
ছবি মুক্তির পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৫৬ সালে চুনীবালা সত্যজিৎ রায়, উত্তমকুমারদের উপস্থিতিতে সেরা অভিনেত্রীর বিএফজেএ পুরস্কার পান। এর কিছুদিন পরেই পরলোকগমন করেন। এই একটি মাত্র ছবি করেই তিনি পৃথিবী জুড়ে যেরকম জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, তা এত বয়সে আর কোনও অভিনেতার পাওয়ার নজির নেই।
এই ছবির ‘অপু’র চরিত্রে অভিনয় করেন সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনয় করে শিশুশিল্পী হিসেবে জিতে নিয়েছিলেন ‘গোল্ডেন বিয়ার’ পুরস্কার। কিন্তু এরপর আর অন্য কোনও ছবিতে তাঁকে অভিনয় করতে দেখা যায়নি। সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় হতে চেয়েছিলেন ফুটবল খেলোয়াড়, কিন্তু জীবন তাঁকে অন্য দিকে বয়ে নিয়ে যায়। সে এক অন্য কাহিনি।

আরও পড়ুন-আবারও আদালতে প্রশ্নের মুখে সিবিআইয়ের ভূমিকা

‘দুর্গা’ চরিত্রের অভিনেত্রী উমা দাশগুপ্ত, পরবর্তীকালে উমা সেন, স্বামী, পুত্র, কন্যা নিয়ে সংসার করেছেন, মাঝে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন, কিন্তু অভিনয় নিয়ে কোনও দিনই আগ্রহ দেখাননি।
ভবানীপুরের বেলতলা অঞ্চলের শ্যামানন্দ রোডের দোতলা বাড়িতে গীতানাথ আর ইরা ঠাকুর থাকতেন তাঁর দুই মেয়ে রিঙ্কু আর টিঙ্কুকে নিয়ে। পরিচালক তপন সিংহ তাঁর ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবির জন্য নির্বাচিত করেন টিঙ্কুকে। ১৯৫৭ সালে মুক্তি পায় সেই ছবি। রহমতের চরিত্রে ছবি বিশ্বাস অসামান্য অভিনয় করেন আর ছোট্ট মিনির ভূমিকায় টিঙ্কু ঠাকুরের জুড়ি মেলা ভার। যেমন তার চমৎকার স্ক্রিনপ্রেজেন্স তেমনই স্বাভাবিক তার পর্দার উপস্থিতি। ‘কাবুলিওয়ালা’ দেখেছেন অথচ ‘মিনি’কে ভালবেসে ফেলেননি, খুঁজলে এমন একজন মানুষকেও পাওয়া যাবে না।
টিঙ্কু ঠাকুরের ভাল নাম ঐন্দ্রিলা ঠাকুর আর তাঁর বড় দিদি শর্মিলা। সত্যজিৎ রায় যখন তাঁর ‘অপুর সংসার’-এর জন্য ‘অপর্ণা’ খুঁজছেন তখন ঐন্দ্রিলা ঠাকুরকেই প্রথম নির্বাচন করেন। কিন্তু তাঁর বয়স অনেকটাই কম হয়ে যাওয়ায় পরে তিনি ঐন্দ্রিলার বড় দিদি শর্মিলাকে নেন ওই ভূমিকায়। এখানে আরেকটা কথাও বলে রাখি, সত্যজিৎ সর্বপ্রথম ‘অপর্ণা’ বেছেছিলেন সন্ধ্যা রায়কে।
টিঙ্কু ঠাকুর, ওরফে ঐন্দ্রিলা ঠাকুর এই একটি ছবি করেই বিখ্যাত হয়ে গেলেন। পরবর্তীকালে তিনি আর অন্য কোনও ছবিতে অভিনয় করেননি। আন্তর্জাতিক ব্রিজ খেলোয়াড় হয়েছিলেন। বিবাহ করেন দিলীপ কুণ্ডুকে। কিন্তু চল্লিশে পা দেওয়ার আগেই ঐন্দ্রিলা পরলোকগমন করেন। তাঁর অভিনীত ‘মিনি’ চরিত্রটি অমর হয়ে আছে।
রেলের কর্মচারী সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল ভবানীপুরে রূপচাঁদ মুখার্জি লেনে। যে বাড়িতে উমা দাশগুপ্তরা থাকতেন, তার দুটো বাড়ি পরেই। সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক মেয়ে চন্দনা পড়ত ইউনাইটেড মিশনারি স্কুলে। কাছেই একটি নাচের স্কুলে নাচ শিখত সে। চন্দনা যে খুব ভাল নাচত এমন নয়। পিছনের সারিতেই থাকত। আজও তাই আছে। এমন সময় দেখল একজন খুব লম্বা মানুষ দরজায় দাঁড়িয়ে তার নাচ দেখছেন। হ্যাঁ, তার দিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ভদ্রলোক।
চন্দনার কেমন যেন অস্বস্তি হল। নাচ শেষ হতে তিনি চন্দনাকে বললেন, ‘‘তোমার বাবা বাড়িতে আছেন? একবার কথা বলা যায়?’’ এমন গমগমে গলা চন্দনা কোনওদিন শোনেনি। সে ভাবল, সে আবার কী দোষ করল যে তার বাবাকে স্কুলে ডাকা হচ্ছে! এদিকে চন্দনার বাড়িতেও একই কাণ্ড। স্কুল থেকে আবার কেন ডেকে পাঠাল? সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তড়িঘড়ি এসে পৌঁছলেন স্কুলে।
সেই লম্বা ভদ্রলোক হাত জোড় করে বললেন, ‘‘নমস্কার, আমার নাম সত্যজিৎ রায়। আমি বায়োস্কোপ তৈরি করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প পোস্টমাস্টার নিয়ে একটি ছবি বানাচ্ছি। সেখানে রতনের চরিত্রের জন্য চন্দনাকে ভেবেছি। ওকে বায়োস্কোপে নিলে আপনার আপত্তি নেই তো?’’
মিশনারি স্কুলে পড়া একটি বছর দশেকের শহুরে মেয়ের মধ্যে কী করে যে ‘পোস্টমাস্টার’-এর ‘রতন’কে খুঁজে পেলেন সত্যজিৎ রায় তা একমাত্র তিনিই জানেন! ছবিটির শ্যুটিং শুরু হল ১৯৬০ সালে। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সোনারপুরের কাছে জগদ্দলে। অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়কে ‘অনিলকাকা’ বলে ডাকতেন চন্দনা। ছবি মুক্তি পেল পরের বছর।

আরও পড়ুন-এবার আটকে পড়া শ্রমিকদের ফেরাতে মহারাষ্ট্রে বিশেষ দল

রতনের ভূমিকায় অভিনয় করার পরে অনেক ছবিতে কাজ করার প্রস্তাব পেয়েছিলেন চন্দনা। কিন্তু তিনি আর অভিনয় করলেন না। স্কুল এবং কলেজ শেষ করে ১৯৭৭ সালে শিক্ষককতা করতে যোগ দিলেন তাঁরই স্কুল ইউনাইটেড মিশনারিতে। বিয়ের পরে হলেন চন্দনা মুখোপাধ্যায়। ২০১১ সালে স্কুলের চাকরি থেকে অবসর নেন। বর্তমানে থাকেন দক্ষিণ কলকাতায়।
‘অপুর সংসার’ ছবিতে অপূর্ব রায় বিজ্ঞাপন দেখে ইস্কুলে চাকরি চাইতে এসে বলে যে সে ইন্টারমিডিয়েট, তখন এক বৃদ্ধ বলেন, ‘‘বিজ্ঞাপনে কী ছিল?’’
‘‘হ্যাঁ তাতে অবশ্য ম্যাট্রিকই চেয়েছিল!’’
‘‘তাহলে ইন্টারমিডিয়েট ইন্টারমিডিয়েট করছেন কেন? ইন্টারমিডিয়েট নিয়ে ধুয়ে খাব? দশ টাকা বেতনে পোষাবে?’’
‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে বাড়ির দাপুটে বৃদ্ধ কর্তা দুই ছেলেকে (প্রসাদ মুখোপাধ্যায় আর বঙ্কিম ঘোষ) বলছেন, ‘‘এবার আমার কথা শোন, যা করেছি বেশ করেছি, না পোষায় চলে যা’’।
বৃদ্ধ এই অভিনেতা হলেন যোগেশ চট্টোপাধ্যায়। এমন মানুষও আছেন, যাঁরা হয়তো ওঁকে নামে চেনেন না, কিন্তু তাঁর সংলাপের সঙ্গে পরিচিত। আজও দারুণ জনপ্রিয় তাঁর সংলাপগুলো। ইনি মোট তিনটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। ‘অপুর সংসার’, ‘গল্প হলেও সত্যি’ আর ‘নায়ক’। কোনও ছবিতেই তিনটি অথবা চারটির বেশি দৃশ্য নেই। ‘অপুর সংসার’-এ একটি মাত্র দৃশ্য। কিন্তু এই ছোট্ট ভূমিকায় দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে দর্শকদের মনে দাগ কেটে গিয়েছেন তিনি। মাত্র তিনটি ছবিতে অভিনয় করে তিনি অমর হয়ে আছেন।
যোগেশ চট্টোপাধ্যায় যেমন তিনটি ছবিতে, সোমেন বসু মাত্র দুটি ছবিতে কাজ করেছিলেন। দুটিই সত্যজিৎ রায়ের ছবি। ‘মহাপুরুষ’ আর ‘নায়ক’। ‘নায়ক’ ছবিতে থিয়েটারে উত্তমকুমারের নাট্যগুরু ‘শংকরদা’ এবং ‘মহাপুরুষ’-এ ‘নিবারণদা’। ‘শংকরদা’, ‘অরিন্দম মুখার্জি’র জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। উত্তমকুমার আর সোমেন বোসের একটি দৃশ্য মিথ হয়ে আছে যেখানে উত্তমকুমার টাকার পাহাড়ে ডুবে যাচ্ছেন আর ‘শংকরদা…আমাকে বাঁচান…’ বলছেন, তখন রাজবেশ পরিহিত সোমেন বোস হাতটা বাড়িয়ে দিয়েও আবার টেনে নিচ্ছেন। উত্তম আস্তে আস্তে তলিয়ে গেলেন টাকার গহ্বরে। তবে ‘মহাপুরুষ’ ছবিতে সোমেন বসুর অভিনয় আরও বেশি আকর্ষণীয়। এই ছবিতে উনি অন্যতম প্রধান চরিত্রে ছিলেন। বুদ্ধির জোরে বিরিঞ্চিবাবার বুজরুকি ধরে ফেলা এবং তাঁকে তাড়ানোর কৃতিত্ব তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। ‘‘এবার কেটে পড়ুন তো প্রভু! এ তল্লাটে আর নয়’’, নিবারণদার দারুণ জনপ্রিয় একটি সংলাপ।
বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, দারুণ রসবোধ, সাবলীল অভিনয়, অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের অধিকারী সোমেন বোস মাত্র দুটি ছবিতে অভিনয় করেই বাঙালি হৃদয়ে সারাজীবনের জন্য স্থান করে নিয়েছেন।
‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর গুণময় বাগচীকে মনে রাখেননি এমন বাঙালি হাজার খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। তাঁর ‘এদিকে চারশো এদিকে চারশো’ অথবা ‘এই যে হাঁ করছি, এটাও মাস্ল’, কিংবা ‘আমাদের শরীরটা হল মন্দির’ অথবা লালমোহন গাঙ্গুলিকে কোলে তুলে নেওয়ার দৃশ্য আজও আমরা ভুলিনি। আর আমরা মুগ্ধ হয়েছি গুণময় বাগচীর দেহসৌষ্ঠব দেখে।
সালটা ১৯৭৭। মনোতোষ রায়ের কাছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যোগব্যায়াম আর ফ্রিহ্যান্ড শিখতে যেতেন। সেখানেই মনোতোষের বড় ছেলে মলয়কে দেখলেন সৌমিত্র। এমন চমৎকার স্বাস্থ্য সচরাচর বাঙালিদের মধ্যে চোখে পড়ে না। সত্যজিৎ তখন ‘জয়বাবা ফেলুনাথ-এর জন্য একজন ব্যায়ামবীর খুঁজছেন। সৌমিত্রর কাছে মলয় রায়ের বর্ণনা শুনে তাঁকে দেখা করতে বললেন সত্যজিৎ। তারপর কী করে ডানলপ থেকে এল-৯ বাসে চড়ে রবীন্দ্রসদনে এলেন, সেখান থেকে কী করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অ্যাম্বাসাডার গাড়ি চড়ে বিশপ লেফ্রয় রোডে পৌঁছলেন। বাকিটা ইতিহাস।

আরও পড়ুন-এবার আটকে পড়া শ্রমিকদের ফেরাতে মহারাষ্ট্রে বিশেষ দল

‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ মুক্তি পেল ৫ জানুয়ারি, ১৯৭৯। ছবি চলল হইহই করে। ফেলুদা, জটায়ু আর মগনলালের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হল বাঙালি দর্শক। পাশাপাশি গুণময় বাগচীও জনপ্রিয় হয়ে গেল।
‘‘সব সত্যি। মহিষাসুর সত্যি, হনুমান সত্যি, ক্যাপ্টেন স্পার্ক সত্যি, টারজান সত্যি, অরণ্যদেব সত্যি’’। এই বিখ্যাত সংলাপ রুকুর, অর্থাৎ রুক্মিণীকুমারের। ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’-এর রুকু হলেন জিৎ বোস।
জিৎ বোসকে খুঁজে পাওয়ার একটা মজার গল্প আছে। সত্যজিৎ প্রথমে রুকুর ভূমিকায় নির্বাচন করেছিলেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে। কিন্তু তাঁর মা চাননি ছেলে ফিল্মে অভিনয় করুক। তাই ছেলেকে সেলুনে নিয়ে গিয়ে ছোট ছোট করে চুল কাটিয়ে নিয়ে এসেছিলেন অঞ্জলি চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিৎ পরে সেই চুল-কাটা দেখে প্রায় আঁতকে উঠেছিলেন।
বাধ্য হয়েই নতুন ‘রুকু’ খোঁজা শুরু হল। এদিকে আউটডোরের শ্যুটিং এগিয়ে আসছে, ‘রুকু’ পাওয়া যাচ্ছে না। সত্যজিতের গোটা ইউনিট মারাত্মক দুশ্চিন্তায়। বেনারস যাওয়ার দিন সকালেও ‘রুকু’কে পাওয়া গেল না। সত্যজিৎ বলেছেন, ‘‘এতবড় ইউনিটের যাওয়া ক্যানসেল করা যাবে না। ওখানে যাওয়া যাক, তারপরে কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাবে’’।
সেদিন সকালে সত্যজিতের এক সহকারী রমেশ সেন, যিনি পুনু সেন নামেই পরিচিত, টলিগঞ্জে একটি দোকান থেকে জিনিস কিনতে দেখেন একটি ছোট ছেলেকে। পুনু সেন তাঁর পিছু নিয়ে তাঁর বাড়ি অবধি পৌঁছে যান। এই ছেলেটির নাম জিৎ বোস। জিৎ-এর মা-কে বুঝিয়ে পুনু সেন জিৎকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে। সত্যজিৎ রায় এক কথায় ‘রুকু’র ভূমিকায় নির্বাচন করলেন জিৎ বোসকে। আর সেই রুক্মিণীকুমার যে আমাদের কত প্রিয় তা আমরা সকলেই জানি।
জিৎ বোস এই একটি মাত্র ছবিতেই অভিনয় করেন। এরপর তিনি হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাশ করে বর্তমানে ভিনরাজ্যের একটি হোটেলে কর্মরত।

আরও পড়ুন-এনজেপি স্টেশনে যাত্রীদুর্ভোগ চরমে, হুঁশ নেই রেলকর্তাদের

‘ফাইট, কোনি ফাইট’। এই সংলাপটা একসময় বাঙালিদের মুখে মুখে ফিরত। একসময় কেন, ‘কোনি’ ছবি মুক্তির পরে একচল্লিশ বছর কেটে গিয়েছে। কোনির অদম্য জেতার ইচ্ছে আর ক্ষিতদার লড়াই দেখলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়। মতি নন্দীর উপন্যাস অবলম্বনে সরোজ দে পরিচালনা করেন ছবিটির। ‘কোনি’র ভূমিকায় অভিনয় করেন শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই একটা ছবি তাঁকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। কিন্তু শ্রীপর্ণাও পরবর্তীকালে আর কোনও ছবিতে অভিনয় করেননি। নিজের পড়াশোনা শেষ করে সাউথ পয়েন্ট স্কুলে চাকরি করেছেন। বর্তমানে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু ‘কোনি’ তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে। বাঙালি নিজেকে অথবা প্রিয়জনকে উদ্বুদ্ধ করতে যুগের পর যুগ বলে যাবে, ‘ফাইট, কোনি ফাইট’।

Latest article