কলকাতা হাইকোর্টের মান্যবর বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (abhijit gangopadhyay) স্বেচ্ছায় অবসর নিলেন। তাঁর কার্যকালের মেয়াদ এই বছরের অগাস্টের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ছিল। প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস আগেই অবসর গ্রহণ করলেন। এটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। অবসরের দু-তিন দিনের মধ্যে তিনি একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দিলেন। এই সম্পর্কেও বলার কিছু নেই। অবসর গ্রহণ করেই তিনি একটি বিখ্যাত সংবাদ মাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। এটাও তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু ওই সাক্ষাৎকারে তিনি এমন কিছু কথা বলেছেন, যা আপত্তিকর ও সত্যের অপলাপ। তিনি বলেছেন, এমন ব্যক্তিদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য করা হয়েছে, যাঁরা দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে যুক্ত অর্থাৎ তাঁদের দিয়ে আগে দুর্বৃত্তের দুষ্কর্ম করানো হয়েছে— তারপর তাঁদের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে! খুবই গুরুতর অভিযোগ। মাননীয় প্রাক্তন বিচারপতি এই ধরনের একটাও দৃষ্টান্ত দিতে পারেন? ২০১১-এর পর যাঁদের উপাচার্য করা হয়েছে, তাঁরা সকলেই প্রবীণ ও অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ। তাঁদের মধ্যে কে কে দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, জানাবেন কি? নিযুক্ত উপাচার্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সরকারি কলেজে ‘প্রফেসর’ পদে কমপক্ষে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ছিলেন অথবা রাজ্য সরকারের ‘শিক্ষা অধিকর্তা’ ছিলেন বা কলেজের বরিষ্ঠ অধ্যক্ষ ছিলেন। কয়েকটি নাম উল্লেখ করছি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক দেবনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক আশুতোষ ঘোষ, বিশিষ্ট রসায়নবিদ অনুরাধা মুখোপাধ্যায়, স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক গুপ্ত, অন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ঐতিহাসিক রঞ্জন চক্রবর্তী এবং স্মৃতিরঞ্জন সরকার, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বনামধন্য অধ্যাপিকা সোনালী বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দি সাহিত্যের ভারত বিখ্যাত অধ্যাপিকা সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়, অতি-বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সুগত মারজিৎ, সরকারি কলেজের ‘প্রফেসর’ বরিষ্ঠ অধ্যক্ষ এবং পরবর্তীকালে রাজ্যের শিক্ষা অধিকর্তা নিমাইচন্দ্র সাহা, সরকারি কলেজের অপর একজন বিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ ‘প্রফেসর’ ও শিক্ষা অধিকর্তা শুভশংকর সরকার, আশুতোষ কলেজের বরিষ্ঠ অধ্যক্ষ দীপক কর প্রমুখ ২০১১ সালের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে কারা কারা দুর্বৃত্ত ও কোন দুষ্কর্মের সঙ্গে জড়িত, এই অধম প্রবন্ধকারকে মান্যবর জানিয়ে দিলে বাধিত হব।
আরও পড়ুন- বাড়িতে পানীয় জলের সংযোগ, গুজরাতকে টেক্কা দিল বাংলা
শ্রদ্ধেয় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি যথার্থই বলেছেন, শিক্ষা-সংক্রান্ত মামলা তিনি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেননি। কোন বিচারপতি কোন বিষয়ের মামলা শুনবেন সেটা প্রধান বিচারপতি ঠিক করেন। শিক্ষা সংক্রান্ত দুর্নীতি উন্মোচন করতে তিনি উঠে পড়ে লাগলেন। বিচারকের আসন থেকে হুঙ্কার দিলেন, শেষ দেখে ছাড়বেন। আরও বললেন, ধেড়ে ইঁদুর ধরবেন। এ-সব কি বিচারকের কথা? বিচারক অভিযোগের সত্যাসত্যটা দেখবেন। প্রশাসনিক কোনও কাজ আইনসভা প্রণীত কোনও আইন বা ভারতীয় সংবিধান বিরোধী হলে, সেটা বাতিল করে দেবেন। কিন্তু তিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন না। তা হলে বিচার ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। এ-ছাড়া ধেড়ে ইঁদুরের আবির্ভাব কি হঠাৎ হয়েছে? ১৯৭৭-এর পর থেকে ধেড়ে ইঁদুর, নেংটি ইঁদুররা রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। কয়েকদিন আগে ‘জাগো বাংলা’ কাগজে আমি কিছু নির্দিষ্ট তথ্য তুলে ধরেছিলাম কীভাবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট আমলে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছিল। আরও কিছু তথ্য শীঘ্রই তুলে ধরব। আশা করেছিলাম, কোনও কোনও মহল থেকে প্রতিবাদ হবে, এমনকী মানহানি মামলা দায়ের হতে পারে। আমি তথ্য-প্রমাণ নিয়ে তৈরি আছি। বামফ্রন্ট আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা দলদাসে পরিণত হয়েছিল। কলকাতার উপকণ্ঠে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নানা কীর্তিকলাপ বিধানসভায় তুলে ধরেছিলেন তৎকালীন অতি-বিশিষ্ট বিরোধী নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বামফ্রন্ট আমলে শিক্ষাক্ষেত্রে দলবাজি, দুর্নীতি ও অব্যবস্থা ছিল পাহাড়-প্রমাণ। কিন্তু জনসমক্ষে আসেনি, কারণ সিপিএম অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ ও চতুর দল। পরিকল্পিতভাবে, কাগজপত্র ঠিকঠাক করে গুছিয়ে সুকৌশলে দুর্নীতি করা হয়েছিল, সেটা সাদা চোখে ধরা অসম্ভব। এ-ছাড়া সিপিএম অত্যন্ত প্রতিহিংসাপরায়ণ ও নির্মম দল। যারা সিপিএমের সমালোচনা বা বিরোধিতা করেছেন, শুধু তাঁদের উপর প্রতিশোধ নেওয়া নয়, তাঁদের পরিবারের লোকদেরও নানাভাবে হেনস্থা, অসম্মানিত করা হয়েছিল। জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। পুকুরের মাছ নষ্ট করা হয়েছিল ইত্যাদি। আমরা অর্থাৎ কলকাতা শহরের ভদ্রলোকরা এ-সব জমি যা গ্রামাঞ্চলে এই ধরনের অসংখ্য নজির আছে, যাকে বলা যেতে পারে ‘নীরব সন্ত্রাসবাদ’। হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা আছে যে কোনও অভিযোগ সম্পর্কে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করা এবং এফআরআইয়ের নির্দেশ দেওয়া। মাননীয় বিচারপতির এজলাসে যখন শিক্ষা সংক্রান্ত মামলা ছিল তখন তিনি কী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বামফ্রন্ট আমলে শিক্ষা-সংক্রান্ত দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারতেন না? তিনি বলুন তো, সিপিএমের বড় নেতা, ছোট নেতা, চামচে নেতা সকলের পুত্র-কন্যা-জামাই-পুত্রবধূ-সহ প্রায় সমস্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি পেলেন কীভাবে? সকলেই মেধাবী ও প্রতিভাবান ছিলেন? এই জবাব তাঁকে দিতে হবে, কারণ তিনি তখন উল্লেখিত কমিশনের প্যানেলভূক্ত আইনজীবী ছিলেন। সাধারণ ধারণা হল— বামফ্রন্টের আমলে সিপিএমের কৃপা ছাড়া এই সম্ভব নয়। একটি রাজনৈতিক দলে যোগদানের পর মান্যবর শিলিগুড়ির একটি সভায় দাবি করলেন, পশ্চিমবঙ্গে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করতে হবে। তিনি আইন বিশারদ। ভালভাবেই জানেন, এই দাবি অবাস্তব ও হাস্যকর, বিশেষ করে এস আর বোমমাই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর। এটা স্বীকৃত বহুবার ৩৫৬ ধারার অপপ্রয়োগ হয়েছে। এর জন্য কেন্দ্র কংগ্রেস সরকার ও স্বল্পস্থায়ী জনতা সরকার সমানভাবে দায়ী। কিন্তু বর্তমানে এই ধারার প্রয়োগ সাংবিধানিক ভাবে প্রায় অসম্ভব। জেনে বুঝে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। তবে মান্যবর সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একটি ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, সমাজের ভদ্র, শিক্ষিত ও ভাল মানুষদের বেশি করে রাজনীতিতে আসা উচিত। এর জন্য তিনি নিশ্চয়ই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে তিনি যেখানে গেছেন সেখানে ধেড়ে ইঁদুর ধরার একটু চেষ্টা করে দেখুন। ফলটা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন। সেই দিনের প্রতীক্ষায় রইলাম।