আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই।
সেই পাহাড়ের পায়ের
কাছে থাকবে গহন অরণ্য, আমি সেই অরণ্য পার হয়ে যাব, তারপর শুধু রুক্ষ
কঠিন পাহাড়।
একেবারে চূড়ায়, মাথার
খুব কাছে আকাশ, নিচে বিপুলা পৃথিবী,
চরাচরে তীব্র নির্জনতা।
আমার কণ্ঠস্বর সেখানে কেউ শুনতে পাবে না
— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
এই দৃশ্য দেখতে হলে আপনাকে প্রচূর টাকা খরচ করতে হবে না। সপ্তাহের ছুটিতে দু-তিনদিনের জন্য ঘুরে আসতে পারেন পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে (Ajodhya Pahar)। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান অথবা যেতে চান পিকনিকে, দুয়েরই আদর্শ জায়গা পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়। পশ্চিমবঙ্গের রুক্ষ লালমাটির মালভূমির মধ্যে অযোধ্যা পাহাড় হল মানবদেহের ফুসফুসের মতো। আপনাকে খুশি করার সমস্ত উপকরণই রয়েছে এই পাহাড়ে। পাহাড়ের বুকে আছে স্বচ্ছ জলের ঝিল, আছে পাহাড়ি ঝরনা, রয়েছে প্রায় হারিয়ে যাওয়া মাটির সোঁদা গন্ধ, রয়েছে শাল-পলাশের বন।
পুরাণের সঙ্গে পুরুলিয়ার অয়োধ্যা পাহাড়ের (Ajodhya Pahar) ভালরকম যোগসূত্র রয়েছে। দলমা পাহাড় ও পূর্বঘাট পর্বতমালার একটি সম্প্রসারিত অংশ হল অযোধ্যা পাহাড়। উচ্চতা প্রায় ২০০০ ফুট। পাহাড়ের মাথাটি প্রায় সমতল। পাহাড়ের মাথাটি হিলটপ হিসাবে খ্যাত। অযোধ্যা পাহাড়ের উচ্চতম শৃঙ্গটি হল গোরগাবুরু। ট্রেকিংয়ের জন্যই অযোধ্যা পাহাড় বেশি পরিচিত। এর একটা এন্ট্রি পয়েন্ট। পূর্ব দিকে সিরকাবাদ, অন্যটি পশ্চিমে বাঘমুন্ডি। দু’টি দিক দিয়েই ট্রেকিং করে পাহাড়ে ওঠা যায়। অযোধ্যা পাহাড় ভ্রমণের সবচেয়ে আদর্শ সময় হল শীতকাল। অবশ্য বর্ষাতেও অনবদ্য অযোধ্যা পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য। তবে বর্ষার জন্য আপনার ভ্রমণে কিছুটা হয়তো বিঘ্ন ঘটতে পারে। তবে যদি আপনি লাল পলাশের খোঁজে আসেন তাহলে আপনাকে মার্চ-এপ্রিলে আসতে হবে।
পড়ুন: সুপ্রিম রায়ে আপাত-স্বস্তি, তবে পুনর্বিবেচনা মানে প্রত্যাহার নয়
কীভাবে যাবেন
রেলপথে কলকাতা থেকে অযোধ্যা পাহাড় (Ajodhya Pahar) যেতে হলে আপনাকে নামতে হবে পুরুলিয়া বা বরাভূম। এখান থেকে গাড়িতে প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে আপনি পৌঁছে যাবেন অযোধ্যা পাহাড়ে। কলকাতা থেকে পুরুলিয়ার বাসও পেয়ে যাবেন। তা ছাড়া নিজস্ব গাড়িতেও অযোধ্যা পাহাড়ে আসতে পারেন।
কোথায় থাকবেন
অযোধ্যা পাহাড়ের উপরে থাকার সু-বন্দোবস্ত আছে। পাহাড়ের নিচে বাঘমুন্ডি গ্রামেও থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে পাহাড়ের উপরেই থাকার অভিজ্ঞতা হাতছাড়া না করাই ভাল। পাহাড়ের উপরে বেশ কিছু হোটেল-গেস্ট হাউস আপনি পেয়ে যাবেন। এ-ছাড়া প্রি-বুকিং করে কোয়ার্টারেও থাকতে পাবেন।
কী দেখবেন অযোধ্যা পাহাড়ে
সীতাকুণ্ড : কথিত আছে রামচন্দ্র যখন সীতাকে নিয়ে বনবাসের উদ্দেশে রওনা হন তখন ঘুরতে ঘুরতে তাঁরা চলে আসেন আজকের পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে। এখানেই রয়েছে সেই সীতাকুণ্ড, দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার কারণে তৃষ্ণার্ত সীতা জলের জন্য ছটফট করছিলেন সেইসময় তীর দিয়ে মাটি খুঁড়ের স্ত্রীর জন্য জল নিয়ে আসেন। এটি আসলে আর্টেজীয় কূপ। তপ্ত গ্রীষ্মকালে আশেপাশের নলকূপ এবং জলের অন্যান্য উৎসগুলি থেকে কখনও কখনও জল মেলে না। কিন্তু হিলটপের কাছে সীতাকুণ্ড থেকে সর্বদাই ঠান্ডা জল পাওয়া যায়।
মার্বেল লেক : অযোধ্যা হিলটপ থেকে বামনি ফলস যাওয়ার পথে ডান দিকে কিছুটা গেলেই পাহাড়ের কোলে এই জলাশয়। এমনিতে মার্বেল লেক বলে পরিচিত হলেও, আরও নাম আছে এর। কেউ বলেন পাতাল ড্যাম৷ আবার এর জলরাশির ঘন নীল রঙের জন্য নীল ড্যাম নামটিও আছে৷ পৃথিবীর চতুর্থ সর্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পুরুলিয়া পাম্প স্টোরেজ প্রোজেক্টের কাজের জন্য বিস্ফোরণ করে পাথর ভাঙতে গিয়ে সেই পাথরের খাঁজে এই লেকটি তৈরি হয়৷ যা অযোধ্যা পাহাড়ের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন ক্ষেত্র।
বামনি ফলস : অযোধ্যা পাহাড়ের সবচেয়ে আকর্ষনীয় ঝরনা হল বামনি ফলস। বিকেল পার করে সন্ধে বেলায় যখন সূর্য পাহাড়ের পিছনে ডুবতে ব্যস্ত, সেই দৃশ্য আপনাকেও ভাবুক করে তুলবে। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে এই ঝরনার দৃশ্য অপরূপ।
আপার ড্যাম-লোয়ার ড্যাম : অযোধ্যা পাহাড়ের উপর সুবর্ণরেখা নদীতে দুটি ড্যাম রয়েছে। আপার ড্যাম ও লোয়ার ড্যাম। লোয়ার ড্যাম থেকে পাহাড় ধরে উপরে উঠলেই পাওয়া যাবে আপার ড্যাম। পিকনিক করার জন্য দারুণ জায়গা। আপার ড্যামের বিশেষত্ব হল, এখানে জল সঞ্চয় করে রাখা হয়। পরে সেই জল থেকে টারবাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরি হয়, আর জল পৌঁছায় লোয়ার ড্যামে। আপার ড্যাম থেকে পুরো অযোধ্যা পাহাড়মণ্ডলকে দেখা যায়।
ময়ূর পাহাড় : আপার ড্যাম থেকে অযোধ্যা আসার পথে আপনি অবশ্যই ময়ূর পাহাড় দেখে আসবেন। সেখানে উঠে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন। ময়ূর পাহাড়ের উপরে একটি হনুমানের মন্দির রয়েছে।
ঠুরগা ফলস : বামনি ফলসের বেশ কিছু দূরেই রয়েছে ঠুরগা ফলস। দুটি পাহাড়ের মাঝখানে এক চিলতে সরু ফিতের মতো জলের ধারা । পাহাড় বেয়ে একেবারে ঝরনার নিচে নেমে যাওয়া যায় খুব সহজেই।
রামমন্দির : অযোধ্যা পাহাড়ের উপরে রয়েছে একটি রামমন্দির। মন্দিরের মধ্যে রাম, সীতা, লক্ষ্মণের বিগ্রহ রয়েছে। মন্দিরের উপরের দেওয়ালে রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনা চিত্রিত করা হয়েছে। এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে যেতে আপনার বেশ ভাল লাগবে।
চড়িদা : পুরুলিয়া যে ছৌ-নাচের জন্য বিখ্যাত, সেই ছৌ-মুখোশ এই গ্রামেই তৈরি হয়। এখানে গিয়ে আপনি মুখোশও কিনতে পারেন।
কী খাবেন
এখানকার স্থানীয় খাবারের হোটেলে আমিষ এবং নিরামিষ খাবার পাওয়া যায়। তবে এখানে বেড়াতে এসে বনমুরগির ঝোল খেতে একদম ভুলবেন না। এ-ছাড়াও সরকারি যুব আবাসে জলের ব্যবস্থা-সহ রান্নাঘর আছে। সেখানে আপনি নিজে রান্না করে দিব্যি খাওয়াদাওয়া করতে পারেন।