আকবরকে ফিরে পড়া দরকার

মুঘল আমলের সবকিছু বর্জ্য, এরকম একটা প্রচার প্রপঞ্চের শিকার আমাদের চারপাশ। বাবরি মসজিদ থেকে স্থাননামের এলাহাবাদ— সবকিছুই বর্জনের তালিকায়। এটা ইতিহাসের প্রতি, মুঘল বাদশাহদের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। এই কথাটা বলার চেষ্টা করলেন দেবাশিস পাঠক

Must read

আকবরকে (Akbar) শ্রেষ্ঠ মোগল সম্রাট বলা হয় কেন? ক্লাসে এই প্রশ্নটা উঠলেই মাস্টারমশাইরা বলতেন (এখন আর বলার দরকার পড়ে কি না জানি না, কারণ মুঘল ইতিহাসই তো হাল আমলে পাঠ্যক্রমে গুরুত্ব হারিয়েছে) তাঁর দীনইলাহি ধর্মের কথা কিংবা আওরঙ্গজেবের রাজপুত নীতির বিপ্রতীপে তাঁর রাজপুত প্রীতির কথা। সমাকলনের উল্টোদিকে অবকলন কিংবা কাছে টানার বিপ্রতীপে দূরে ঠেলা। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ তবে আকর্ষক নয়।
কিন্তু কারওকে কখনও বলতে শুনিনি সেই কথাগুলো যেগুলো আকবরের বাদশাহি দরবারের এক জেসুইট যাজক বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আকবর লোকপ্রিয় শাসক ছিলেন। কারণ, তিনি উঁচুতলার লোকদের কাছে যেমন দার্ঢ্য দেখাতে কুণ্ঠিত হতেন না, তেমনই নিচুতলার লোকদের প্রতি দয়া প্রদর্শনেও অকুণ্ঠিত ছিলেন। ধনী-নির্ধন, প্রতিবেশী-পরদেশি, আরব বেদুইন থেকে খ্রিস্টান, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। ফলে, সকলেই মনে করত সম্রাট তার পাশে আছেন।

এই রাজনৈতিক সমীকরণের সৌজন্যেই যে আকবর বাদশা ভারতের শ্রেষ্ঠ শাসকদের মধ্যে অগ্রগণ্য রূপে মান্য, এই কারণেই তিনি ‘মহামতি’ বিশেষণে বিশেষায়িত, এই সহজ সত্যটা সমকালের একজন বিদেশির মূল্যায়নে স্পষ্ট। অথচ আজও সেই মূল্যায়ন অজ্ঞাত কারণে আকবর (Akbar) বিষয়ক আলোচনায় উপেক্ষিত।

ঠিক একইভাবে অনালোচিত আকবরের ছেলেবেলা ও কৈশোরের গঠন প্রক্রিয়ার বিশেষত্ব। জালালউদ্দিন আকবর অক্ষরজ্ঞানহীন ছিলেন, এটা অনেকেই জানেন ও বলেন। কিন্তু তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই এটা তুলে ধরেন না যে, আকবরের ছেলেবেলা বাদশাহি পরিবারের বাদবাকি শাহজাদার মতো হস্তাক্ষর অনুশীলন আর অস্ত্র শিক্ষায় ব্যয়িত হয়নি। ছেলেবেলায় তিনি দৌড়াতেন উট আর কুকুরদের সঙ্গে, তাঁর খেলার সাথী ছিল পায়রার দল, শিকার করতেন বাঘ, সিংহ, চিতা আর হরিণ, পোষ মানাতেন বুনো হাতিদের। এভাবেই পশুপাখিদের সাহচর্যে তিনি আয়ত্ত করেছিলেন দৈহিক সামর্থ্য, মানসিক সাহস আর হার্দ্যিক মমত্ববোধ। এই গুণগুলোই পরবর্তী জীবনে তাঁকে বিশিষ্ট করে তুলেছিল।

আকবর (Akbar) অশিক্ষিত ছিলেন, কিন্তু শিখার প্রতি তাঁর অনুরাগের, অজানাকে জানার জন্য তাঁর আগ্রহের অভাব ছিল না। সেসবের তাগিদেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন ইবাদতখানা। এই ইবদতখানা নির্মিত হয়েছিল এমন এক সময়ে যখন ইরানে সাফাভিদদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছেন শিয়া সম্প্রদায় ভুক্ত নন, এমন মানুষজন। আর ইউরোপ থেকে বিতাড়িত হচ্ছেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী নন, এমন লোকজন। এইসব বিতাড়িত নিগৃহীতদের আশ্রয় ও আশ্বাস দিয়েছিল আকবরের ইবাদতখানা। আমরা কিন্তু সেসব বললাম না, জানালাম না। আকবর জিজিয়া কর রদ করেছিলেন। আবুল ফজল লিখছেন, এর ফলে তাঁর রাজকোষের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল। সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন, রক্ষণশীল হিন্দুদের পরোয়া না করেই। তাঁর এই সব পদক্ষেপে একালের ইতিহাসবিদ খুঁজে পেতে পারতেন ধর্ম নিরপেক্ষ আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণের ইশারা। আকবরের শাসনে মুঘল ভারত রাষ্ট্র যে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মাঝখানে নিজেকে দাঁড় করায়নি, সেই কথাটা সেভাবে আমরা কি কখনও বললাম, নিদেন পক্ষে বলার চেষ্টা করলাম?

আরও পড়ুন- ভোটদানের অধিকার খর্ব কীভাবে? যৌথ সংসদীয় কমিটির বৈঠকে প্রশ্ন কল্যাণের

আমরা তো এটাও কখনও ভাবার তাগিদ অনুভব করিনি যে একুশ শতকীয় ম্যানেজমেন্ট পড়ুয়ার কাছেও অশিক্ষিত মধ্যযুগীয় ওই মুঘল সম্রাট শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারেন। তাঁর আমির-ওমরাহদের আকবর ‘আখালক-ই-নাসিরি’ পড়তে বলতেন। বইটা পারস্যের দার্শনিক নাসির-আল-দিন আল-তুসির লেখা নীতিশিক্ষার গ্রন্থ। তাতে শেখানো হয়েছে, রাজা-রাজড়ারা কখনও কোনও বিষয়ে ব্যক্তিগত মতামত খুল্লম-খুল্লা ব্যক্ত করবে না, যাতে সেটা প্রয়োজনমতো কোনও বিতর্ক ছাড়াই বদলে প্রকাশ করা যায়। ওই গ্রন্থে শাসককে বিজ্ঞ ও বিচক্ষণদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করার কথা বলা আছে। আকবর দুটি নীতিই মেনে চলেছেন চিরকাল। দরকার মতো পরামর্শ নিয়েছেন বৈরাম খাঁর, কখনও আবার ধাত্রী মহাম অঙ্গের। বড় হতে রাজপুত রাজাদের। তাঁদের পাশে পেতে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনেও অনাগ্রহ দেখাননি। ঠিক একই ভাবে আক্রমণকারী দাসের তাঁর ওপর হামলার পেছনে মাথাটা কে,
সেটা জেনেও চুপ করেছিলেন আকবর। একেবারে যেন আধুনিক কর্পোরেট আবহে বোর্ড রুম পলিসি, যে নীতি অনুসারে ব্যবস্থাপকদের বৈঠকে বিরুদ্ধবাদী কে জেনেও চুপ করে
থাকাটাই দস্তুর।
ঝটিকা আক্রমণ বা প্রতিপক্ষকে নিজের পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে বিন্দুমাত্র আঁচ করতে না দেওয়াটা এখনকার মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। এই প্রকৌশল আকবরের আয়ত্ত ছিল। ছক ভাঙা পথে প্রতিপক্ষকে চমকে দিয়ে কীভাবে পাল্টা আক্রমণ শানানো যায়, সেটা টের পেয়েছিলেন আফগান শাসক দাউদ খান করনানি। আবার ছবিতে দেখি, চিতা বাঘকে শায়েস্তা করতে তার কান পাকড়েছেন আকবর। কিংবা টলমলে নৌকা দিয়ে বানানো সেতু। তার ওপর দিয়ে হাতির পিঠে হাওদায় চেপে আর একটা হাতিকে তাড়া করছেন বাদশাহ। সবই ছকভাঙা আক্রমণ কৌশলের
সাক্ষ্য দেয়।

সেসব না শিখিয়ে, না জানিয়ে আকবরকে স্রেফ মহামতি মুঘল বাদশা হিসেবে দেখিয়ে, পড়িয়ে, পড়ে ও পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখে আমরা যে আদতে আকবরের প্রতি অন্যায় করেছি, সেটার শাস্তি হিসেবেই বুঝি মুঘল আমলটাই ছাত্রপাঠ্য ইতিহাসে তার গুরুত্ব হারাতে বসেছে।
তথ্য ঋণ
আকবর দ্য গ্রেট মুঘল : দ্য ডেফিনিটিভ বায়োগ্রাফি— ইরা মুখোটি, (প্রকাশক : অ্যালেফ)
আল্লাহু আকবর : আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য গ্রেট মুঘল ইন টুডেজ ইন্ডিয়া— মণিমুগ্ধ এস শর্মা (প্রকাশক ব্লুমসবেরি)
আকবর দ্য গ্রেট সিইও : দি এম্পেররস থার্টি রুলস অব লিডারশিপ (প্রকাশক স্পিকিং টাইগার)

Latest article