আলিপুরদুয়ার জেলার বনাঞ্চল চিলাপাতা (Chilapata Forest)। এই অঞ্চলটি এককথায় চিরসবুজ। নানারকমের গাছ। ডালে ডালে রংবেরঙের ফুল। তাকালেই চোখের আরাম। মনে করা হয়, ডুয়ার্সের অন্যতম বড় বনাঞ্চল চিলাপাতা। অবস্থান তোর্সা নদীর পাড়েই। এই অঞ্চল দিয়ে বয়ে গেছে আরও অনেক ছোট-বড় নদী। যেমন, কালাচিনি, বুড়িবসরা, বেনিয়া।
প্রকৃতি এখানে রূপের পশরা সাজিয়ে বসেছে। তবে এই অঞ্চলে খুব বেশি মানুষের আনাগোনা দেখা যায় না। নির্জনতা ভালোবাসেন যাঁরা, তাঁরাই ঘুরেফিরে আসেন। দু-তিন দিন সময় কাটিয়ে যান।
ভোর থেকেই বনাঞ্চল মুখরিত হয়ে ওঠে পাখিদের কলকাকলিতে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। সারাদিন চলে কিচিরমিচির। ঠিক যেন পাঠশালা।
বনের মধ্যে দেখা পাওয়া যায় বিভিন্ন জন্তুর। যেমন, চিতাবাঘ, হাতি, গন্ডার, হরিণ, বাইসন ইত্যাদি। এই অঞ্চলে আছে কিংকোবরা সাপের উপদ্রব। জঙ্গলে ঘোরার সময় পা ফেলতে হয় খুব সাবধানে। অবশ্য চাইলেই জঙ্গলে যাওয়া যায় না। পারমিট করাতে হয় রেঞ্জ অফিস থেকে। তবেই দেখা যায় জঙ্গলের অপরূপ শোভা।
এখানে সাফারি চলে। সকাল ৫টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। অচেনা জঙ্গলে একা একা না ঘোরাই ভাল। আছে গাইড। বেড়ানোর সময় নিতে হয় তাদের সাহায্য। তবে চিলাপাতা জঙ্গলটি এত বড়, সব জায়গায় যাওয়া সম্ভব নয়। এমন কিছু গভীর অঞ্চল রয়েছে, যেখানে পৌঁছয় না দিনের আলো। স্বাভাবিকভাবেই পৌঁছাতে পারেনি কোনও গাইড, পর্যটক।
চিলাপাতা (Chilapata Forest) জঙ্গলে এক বিশেষ প্রজাতির গাছ দেখতে পাওয়া যায়। নাম রামগুয়া। এই গাছে আঘাত করলে নাকি রক্তের ধারা বেয়ে আসে। তবে কমে এসেছে সেই গাছের সংখ্যা।
আরও পড়ুন: তৃণমূল সাংসদের কাছে মোদির ভাই
বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই অঞ্চল। একটা সময় কোচ রাজাদের মৃগয়াক্ষেত্র ছিল এই জঙ্গল। তাঁরা দলবেঁধে শিকার করতে আসতেন। জানা যায়, চিল্লা ছিলেন কোচরাজার সেনাপতি। দুর্দান্ত শিকারি। চিলের মতো তিনি ছোঁ মেরে শত্রুকে হত্যা করতেন। তাঁর নামেই এই জঙ্গলের নামকরণ হয়েছে চিলাপাতা।
কোচ রাজাদের গড়ের ভগ্নাবশেষেরও দেখতে পাওয়া যায় চিলাপাতা জঙ্গলের মধ্যে। আছে নল রাজাদের গড়। মনে করা হয়, দুর্গটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়ের৷ প্রায় দু’হাজার বছরের পুরনো। আজও বিস্মিত হতে হয় ভগ্নপ্রাপ্ত দুর্গটি দেখে৷ আছে ‘কুনকি’ নামে একটি ওয়াচ টাওয়ার। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় সূর্যাস্ত।
চিলাপাতা ফরেস্টে আছে পাঁচটি বিট। তারমধ্যে অন্যতম মেন্দাবাড়ি। চিলাপাতার ঠাসবুনোট বনে এর অবস্থান। এখানে আছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি ইকো-ট্যুরিজম রিসর্ট। নাম ‘মেন্দাবাড়ি জঙ্গল ক্যাম্প’৷ এই রিসর্টে রাত্রিবাসে অনন্য সাধারণ অভিজ্ঞতা হতে পারে। কান পাতলেই ঝিঁঝিঁর ডাক। পাশাপাশি শোনা যায় বিভিন্ন জন্তুর ডাকও। রাতের আকাশে ফুটে ওঠে তারাদল। দিনের বেলায় মাঝেমধ্যে ক্যাম্পে ঢুকে পড়ে হরিণ।
জেনে রাখুন, মেন্দাবাড়ি জঙ্গল ক্যাম্পে কিন্তু বিদ্যুৎ নেই। জঙ্গলের আদিম রূপটি যাতে উপভোগ করা যায়, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। তাই আগে থেকে মোবাইল ফোন, ক্যামেরা ইত্যাদি চার্জ দিয়ে রাখতে হয়। ক্যাম্পে সন্ধেবেলায় আয়োজিত হয় আদিবাসী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জঙ্গল থেকে বেড়িয়ে এসে পর্যটকরা এই অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারেন। চিলাপাতা জঙ্গলেও আছে ক্যাম্প। সেখানেও করা যায় রাত্রিযাপন।
সবমিলিয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় উত্তরবঙ্গের চিলাপাতা-মেন্দাবাড়ি ভ্রমণ মন্দ লাগবে না। তবে অতিভারী বৃষ্টির মধ্যে না যাওয়াই ভালো। বেরনোর আগে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনে নেবেন। ট্রাই করতে পারেন পুজোর সময়।
কীভাবে যাবেন?
শিয়ালদহ থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস। নামতে হবে হাসিমারা রেলওয়ে স্টেশনে। অথবা উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে কোচবিহার। গন্তব্যটি হাসিমারা থেকে ১৮ কিলোমিটার এবং কোচবিহার থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে। দুই স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে যেতে হয়।
কোথায় থাকবেন?
হাসিমারা, কোচবিহারে আছে রিসর্ট, হোটেল। থাকা যায় চিলাপাতা জঙ্গল ক্যাম্পে। যোগাযোগ : ৯৪৭৪৩-৮২৪৪২। এ-ছাড়া থাকা যায় মেন্দাবাড়ি জঙ্গল ক্যাম্পেও। আগে থেকে যোগাযোগ করে গেলেই ভালো। রাতে কখনওই বাংলো চত্বর ছেড়ে বাইরে বেরোবেন না। বুনো জন্তুদের উপদ্রব আছে। ইচ্ছে হলে ভাতের সঙ্গে নদীর টাটকা বোরোলি মাছ টেস্ট করে দেখতে পারেন। ক্যাম্পের কর্মীরা সবসময় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। প্রয়োজনে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।