মহামহোৎসব

শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে প্রতিবছর দীপাবলির পরের দিন প্রতিপদ তিথিতে গিরি গোবর্ধনের পুজো হয় বৃন্দাবন মথুরা-সহ গোটা উত্তর ভারত জুড়ে। পাশাপাশি ঠিক এই সময় মহাসমারোহে পালিত হয় অন্নকূট মহামহোৎসব। এই উৎসবের অন্তরালে পৌরাণিক কাহিনি ও এর ঐতিহ্য নিয়ে লিখলেন তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক

Must read

পুজো-পার্বণের দেশ আমাদের এই ভারতবর্ষ। কত রকমের যে পুজো এবং উৎসব আছে তার কিছু আমাদের জানা আবার বেশ কিছু উৎসব একেবারেই অজানা। আজ সেরকমই এক উৎসব নিয়ে লিখব। গোবর্ধন উৎসব। নাহ্, এই উৎসবের সঙ্গে আমরা তেমনভাবে পরিচিত নই।
তবে দীপাবলির পাশাপাশি এই গোবর্ধন উৎসব পালিত হয়। দিল্লি, হরিয়ানা বিশেষত মথুরা-বৃন্দাবন-সহ গোটা উত্তর ভারতে মহাসমারোহে পালিত হয় এই উৎসব। দীপাবলির পরের দিন, কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথিতে পালিত হয় এই উৎসব।
কৃষ্ণ ভক্তরা কার্তিক মাসকে দামোদর মাস বলে থাকেন। অত্যন্ত পুণ্য এই মাস। এই মাসেই হয় গোবর্ধন উৎসব।

পৌরাণিকতা
এই উৎসবের পেছনেও রয়েছে একটি পৌরাণিক কাহিনি। সম্বৎসর ভাল ফলন ও বৃষ্টির আশায় দরিদ্র গ্রামবাসীরা দেবরাজ ইন্দ্রের পুজো করতেন। কারণ বৃষ্টি হলে ফসল ফলন ভাল হবে।
দেবরাজের পুজোয় তাদের খরচ-খরচা হত। এই খবর জেনে কৃষ্ণ গ্রামবাসীদের বারণ করেছিলেন। গ্রামবাসীরা ছোট ছোট সন্তানদের অভুক্ত রেখে ইন্দ্রের পুজো করত।
সব জেনে কৃষ্ণ বললেন, সমুদ্রের মাঝেও কিন্তু বৃষ্টি হয় সেখানে কেউ ইন্দ্ররাজের পুজো তো করেন না।
ব্রজবাসী হিসেবে আমাদের জীবিকা গো পালন। গিরি গোবর্ধনের পাদদেশে গাভীরা চরে বেড়ায়। সেখানে ঘাস খায়, পাহাড়ের গায়ে শস্য হয়, পাহাড়ের নিচে কৃষিজমিতে ফলন হয়। এইসবের কারণে আমাদের তো গিরি গোবর্ধনকে পুজো করা উচিত। ইন্দ্রকে নয়। কৃষ্ণের বারণ মেনে নিয়ে গ্রামবাসীরা সেবছর পুজো বন্ধ করেন।
এতে ভয়ানক রেগে গিয়ে দেবরাজ প্রবল বৃষ্টি দেন। মহাসমস্যায় পড়েন গোকুলবাসীরা। ব্রজবাসীদের বিপদ থেকে রক্ষা করতে কৃষ্ণ এগিয়ে আসেন। কৃষ্ণ তাঁর বাঁ হাতের কনিষ্ঠ আঙুলের ডগায় গোবর্ধন পর্বতকে তুলে রাখেন। সেই সুবিশাল পাহাড়ের পরিধি একুশ কিমি!
বৃষ্টির হাত থেকে ব্রজবাসীদের বাঁচাতে কৃষ্ণ এই কাজটি করেন।
গোবর্ধন পাহাড়ের নিচে আশ্রয় নেয় বৃন্দাবনবাসী ও গবাদি পশুরা। টানা সাতদিন এই বৃষ্টি চলতে থাকে। আর কিশোর কৃষ্ণ এক আঙুলের ডগায় সাতদিন সাতরাত ধরে গোবর্ধন পর্বতকে আটকে রাখেন। শেষমেশ নিজের ভুল বুঝতে পেরে এবং শ্রীকৃষ্ণের আশ্চর্য যোগশক্তির পরিচয় পেয়ে ইন্দ্র অনুতপ্ত হন এবং প্রবল বৃষ্টি বন্ধ করে দেন।
শ্রীকৃষ্ণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে আকাশ গঙ্গার জলে তাঁর অভিষেক করেন এবং কৃষ্ণের নাম রাখেন ‘গোবিন্দ’।

গোবিন্দের লীলা উৎসব
গোবিন্দের সেই লীলাকে স্মরণ করে দীপান্বিতা অমাবস্যার পরদিন অন্নকূট মহোৎসব (Annakut Mahotsav), গিরি গোবর্ধন এবং গোপূজা করা হয়। গোবর্ধন পর্বত এই সাতদিন ব্রজবাসীদের ও পশু-পাখিদের রক্ষা করেছিল, দীপাবলি পরের দিন গোবর্ধন পর্বতকে তাই পুজো করার রীতি। দীপাবলির পরের দিনে গোবর্ধন পুজোর আয়োজন চলে। এই গোবর্ধন পুজোর সঙ্গে হয় অন্নকূট মহোৎসব। গোবর্ধন পুজোর সঙ্গে অন্নকূট পুজো কীভাবে জড়িয়ে পড়ল সেটা এবার জেনে নেওয়া যাক।
শাস্ত্রমতে গোবর্ধন পুজোয় অন্নকূটের বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। শ্রীমৎ ভাগবত গীতার দশম স্কন্ধের নবম-দশম অধ্যায়ে ভক্ত বশ্যতা লীলা বর্ণিত আছে। কৃষ্ণের কথায় ইন্দ্রের বদলে যখন গোপবাসীরা গিরি গোবর্ধনের পুজো করেন, তখন পর্বতের মতো আকৃতি ধারণ করে সমস্ত নৈবেদ্য গ্রহণ করেছিলেন কৃষ্ণ নিজেই। সূচনা হয়েছিল অন্নকূটের। ভক্তদের বিশ্বাস, গিরিরাজ হলেন শ্রীকৃষ্ণের দ্বিতীয় অবতার। বৃন্দাবনে গোবর্ধনকে সবাই গিরিরাজ বলে ডাকে।

অন্নকূট
এই পুজোয় সামর্থ্য অনুসারে অন্নকূটের ভোগ দেওয়া উচিত বলে মানা হয়। একাধিক অন্ন-শস্যের মিশ্রণই হল অন্নকূট। পাশাপাশি এও বলা হয়ে থাকে যে, বৃন্দাবনবাসীদের গোবর্ধন পর্বতে যখন নিয়ে যান শ্রীকৃষ্ণ এবং কড়ে আঙুল দিয়ে সেই পর্বত তুলে সাতদিন সকলকে সেখানে আশ্রয় দেয়। এই সময় গোকুলবাসী বা ব্রজবাসীরা নিজের সঙ্গে যে খাদ্যসামগ্রী এনেছিলেন তার মিশ্রণ তৈরি করে নিয়ে সকলের মধ্যে বিতরণ করত। এই খাবারের স্বাদ কৃষ্ণের অত্যন্ত পছন্দ হয়। ইন্দ্র বৃষ্টি বন্ধ করলে এবং দুর্যোগ কেটে গেলে, ব্রজবাসীরা রাশি রাশি অন্ন, ছাপান্ন রকমের ব্যঞ্জন, মিষ্টি, পুলি-পিঠে, পায়েস রান্না করে স্নেহের কানাইকে খেতে দেন। সেদিন কৃষ্ণ প্রায় সাতদিনের অন্নব্যঞ্জন একদিনে ভক্ষণ করেছিলেন। সেটি প্রথম অন্নকূট।
অন্নকূটের (Annakut Mahotsav) আভিধানিক অর্থ হল, অন্নের পাহাড় বা অন্নের স্তূপ। পরবর্তীকালে এটাই প্রথা হিসেবে রয়ে যায় যে, গোবর্ধন ও কৃষ্ণকে অন্নকূটের ভোগ নিবেদন করা। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী স্বয়ং কৃষ্ণ গোবর্ধন পুজোর পর অন্নকূট উৎসব পালনের আজ্ঞা দেন। অর্থাৎ ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণ এই মহোৎসবের প্রবর্তক। তিথিটি বীরপ্রতিপদ নামেও খ্যাত।
গোবর্ধন পুজোর দিন সকালে কৃষ্ণের অভিষেক করা হয় তারপর ব্রজবাসীদের ঘরে ঘরে বিভিন্ন ব্যঞ্জন তৈরি করে তাঁর ভোগ নিবেদন করা হয়।
এই দিন মহিলারা তাঁদের বাড়ির আঙিনা গোবর দিয়ে গোবর্ধন পর্বতের আকৃতি হিসেবে তৈরি করে পুজো করেন। এরপর ফল, ফুল, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি-সহ ধূপদীপ দিয়ে যথাযথভাবে পুজো করার রীতি।
ফুলপাতা ও রঙ্গোলি দিয়েও কেউ কেউ বাড়ির উঠোন সাজান। পাশাপাশি শ্রীকৃষ্ণকে দুধ দিয়ে স্নান করিয়ে তাঁর অভিষেক করাতে হয় এরপর তাঁকে ছাপান্ন ভোগ দিয়ে অন্নের পাহাড় তৈরি করে অন্নকূট নিবেদন করা হয়। দেখবার মতো হয় এই উৎসব।

আরও পড়ুন- ভরা হেমন্তে শহরে শ্রাবন্তী

অন্নকূট সারা দেশে পালিত হলেও বৃন্দাবনে অন্নকূট মহোৎসবের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। ব্রজের ঘরে ঘরে অনুষ্ঠিত হয় এই অন্নকূট মহোৎসব। দেবতার সামনে রাখা হয় স্তূপীকৃত অন্ন-ব্যঞ্জনের পাহাড়, রকমারি শাক, ভাজা, মিষ্টি দিয়ে অন্নের পাহাড়ে গিরিরাজের চোখ মুখ আঁকা হয়। চারপাশে সাজানো থাকে ছাপান্ন রকমের নিরামিষ ব্যঞ্জন, নোনতা, মিষ্টি ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য। চলে পালাগান, হরিনাম সংকীর্তন ও গীতাপাঠ।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে অন্নকূটের উল্লেখ করেছেন। এই ছাপান্ন ভোগে থাকে— ভক্ত (ভাত), স্যুপ (ডাল), প্রলেহ (চাটনি), সাদিকা (তরকারি), দধিশাকের তরকারি, শিখারিণী, শরবত, বলকা, মোরব্বা, চিনির মিষ্টান্ন, বড়া, মধুযুক্ত মিষ্টান্ন, পুরি, মালপোয়া, জিলিপি, পায়েস, মোহনভোগ, ফল, তাম্বুল। সহস্র প্রদীপ প্রজ্জ্বলনও করা হয়ে থাকে অনেক বাড়িতে এবং মন্দিরে। এছাড়াও কেউ কেউ আবার গৃহপালিত পশু গরু-বাছুর ইত্যাদির পুজো করেন।

কলকাতায় অন্নকূট
কলকাতারও অনেক জায়গায় অন্নকূট মহোৎসব (Annakut Mahotsav) পালিত হয়। বাগবাজারের নববৃন্দাবন মন্দির ও রাধা মদনমোহন মন্দিরে হয় এই উৎসব। প্রচুর পরিমাণ অন্ন-সহ প্রায় একশোরও বেশি পদ তৈরি করা হয়। পুজো শেষে ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয় সেই অন্ন ভোগ। এছাড়া খড়দহের বিখ্যাত রাধাশ্যামসুন্দর জিউয়ের অন্নকূট উৎসব বহু প্রাচীনকাল থেকেই নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে।
নিত্যানন্দ প্রভুর পুত্র বীরচন্দ্র প্রভু শ্যামসুন্দর বিগ্রহের প্রতিষ্ঠাতা। অন্নকূটের দিন সকালে মন্দিরে একটি গরু এনে পুজো করা হয়, তারপর শুরু হয় গিরি গোবর্ধন পুজো।
মন্দিরে চতুর্দোলায় গোবর দিয়ে একটি ছোট পাহাড় তৈরি করে গিরি গোবর্ধনের পুজো আরতি করা হয়। এদিন মন্দিরে জগমোহনের অন্নের পাহাড় তৈরি করে তা মালপো মিষ্টি দিয়ে সাজানো হয়। অন্ন স্তূপের মাথায় থাকে সন্দেশের গাছ। থাকে লুচির রকমারি ব্যঞ্জনও।
গর্ভমন্দিরের চৌকাঠে একটি দোলনায় রাধা, শ্যামসুন্দর ও অনন্ত দেবকে বসিয়ে অন্ন-ব্যঞ্জন নিবেদন করা হয়। হাজার হাজার ভক্ত অন্নকূটের প্রসাদ গ্রহণ করেন।
প্রাচীন কলকাতার আরও একটি অন্নকূটের বর্ণনা পাওয়া যায় শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত গ্রন্থে। বড়বাজারে বারো মল্লিক স্ট্রিটে তারাচাঁদ ঘনশ্যাম দাসের বাড়ির গৃহদেবতা ময়ূরমুকুটধারীর অন্নকূট মহোৎসব। কথামৃতে আছে যে আঠারোশো চুরাশি সালের বিশে অক্টোবর শ্রীরামকৃষ্ণ মাড়োয়ারি ভক্ত তারাচাঁদের বাড়িতে সেই মহোৎসব দেখতে গিয়েছিলেন।

কথামৃতকারের সুন্দর বর্ণনায়…
“মাড়োয়ারি ভক্তেরা বাহিরে ছাদের ওপর ভজন গান আরম্ভ করিয়াছে। শ্রীশ্রী ময়ূরমুকুটধারীর আজ মহোৎসব। ভোগের সমস্ত আয়োজন হইয়াছে। ময়ূরমুকুটধারীকে দর্শন করিয়া ঠাকুর প্রণাম করলেন ও নির্মাল্য ধারণ করিলেন। বিগ্রহ দর্শন করিয়া ঠাকুর ভাবে মুগ্ধ।”
এ ছাড়াও শ্রীচৈতন্যের পদধূলিধন্য বরাহনগর পাঠবাড়ি, নবদ্বীপে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর সেবিত ধামেশ্বর মহাপ্রভু, গোপীবল্লভপুরে রাধাগোবিন্দ মন্দিরে অন্নকূট মহোৎসবের আড়ম্বর ও প্রাচীনত্বে সুবিশাল। শুধু জাতি-বর্ণ নয়, শ্রীকৃষ্ণের হাত ধরে শুরু হওয়া মহোৎসবকে কেন্দ্র করে শাক্ত, বৈষ্ণব মিলেমিশে একাকার।
উদাহরণ দিলে বিষয়টা একটু পরিষ্কার হবে। রানি রাসমণির কনিষ্ঠ কন্যা জগদম্বা আঠারোশো পঁচাত্তর খ্রিস্টাব্দে বারাকপুরে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আদলে নির্মিত অন্নপূর্ণা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা

অষ্টধাতুর অন্নপূর্ণা ও মহাদেব
শ্রীরামকৃষ্ণের স্মৃতি-বিজড়িত এই মন্দিরে অন্নপূর্ণা পূজার দিন হয় অন্নকূট মহোৎসব। ওইদিন সকালে কুমারী পুজো হয় প্রধান পুজো তারপরই হয় অন্নকূট। প্রচুর পরিমাণ অন্ন-সহ প্রায় ৫১ রকম পদ দেবীকে নিবেদন করা হয়।
উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুরে বলরাম ঘোষ স্ট্রিটের ভট্টাচার্যর বাড়িতে দেবী অন্নপূর্ণার অন্নকূট (Annakut Mahotsav) উপলক্ষে দেবীকে ষাট কিলো চালের অন্ন, কুড়ি কিলো চালের পোলাও, সঙ্গে একশো কুড়িটি নিরামিষ পদ ও নানারকমের মিষ্টি নিবেদন করা হয়। নিবেদন করা হয় বকফুলের বড়া, চালভাজার নাড়ু, ওলকপির ডালনা, পানিফলের ধোঁকা। এছাড়াও ভোগের তালিকায় থাকে ফুচকা, আইসক্রিম, কোল্ড ড্রিঙ্ক, চিপস, চকোলেটের মতো খাবারও।
এই বঙ্গের বাইরেও পালিত হয় অন্নকূট। ত্রিপুরার আগরতলার জগন্নাথ বাড়ি মন্দিরে অন্নকূট উপলক্ষে প্রচুর অন্ন-সহ এক হাজার রকমের পদ তৈরি করে জগন্নাথদেবকে নিবেদন করা হয়। আবার হজমিগুলিও দেওয়া হয় ভোগ হিসাবে।
ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্য, শ্রেণি, ধর্ম, শাক্ত, বৈষ্ণব মিলেমিশে ভক্তদের কাছে তাই এই বর্ণাঢ্য উৎসবের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অপরিসীম।

Latest article