অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া

প্রতিবছর মার্চের প্রথম সপ্তাহে পালিত হয় 'অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া সচেতনতা সপ্তাহ'। এটা সাধারণ অ্যানিমিয়া নয়, এক বিরল এবং জটিল রক্তের ব্যাধি। কেন হয় এই রোগ? চিকিৎসাই বা কী? লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

শুধু ভারত নয় পৃথিবীর সব দেশের মেয়েদের মধ্যে রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া সবচেয়ে কমন একটা রোগ। এই রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়ার চিকিৎসা খুব জটিল কিছু নয়। চিকিৎসা করলে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কিন্তু অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া (Aplastic anemia) বা অবর্ধক রক্তশূন্যতা এক জটিল রক্তরোগ। একে হাইপোপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়াও বলে। প্রতি বছর মার্চের প্রথম সপ্তাহে পালিত হয় অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া সপ্তাহ এবং ৪ মার্চ হল অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া দিবস। এই অ্যানিমিয়া শিশু, কিশোর, প্রাপ্তবয়স্ক সবার হতে পারে। সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতবর্ষে প্রতিবছর ২০ হাজার রোগীর মধ্যে অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া দেখা যায়। সাধারণত কৈশোর এবং ৩০ বছর বয়সে এই রোগটি সর্বাধিক দেখতে পাওয়া যায়। অ্যালেনর রুজভেল্ট এবং মেরি ক্যুরির মৃত্যুর কারণ কিন্তু এই রোগ। এই রোগে অস্থিমজ্জার কোষগুলো যথেষ্ট পরিমাণে নতুন রক্তকণিকা উৎপাদন করতে পারে না ফলে রক্তে ওই রক্তকণিকা অনেক কম থাকে। সাধারণ অ্যানিমিয়াতে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি হয় না কিন্তু অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়াতে লোহিত রক্তকণিকার পাশাপাশি শ্বেতরক্তকণিকা এবং অণুচক্রিকাও তৈরি হয় না। এই জটিল রোগ ধরা পড়ে না সহজে এবং এর চিকিৎসাও বেশ কঠিন।

কেন হয়
এই রোগের সঠিক কারণ জানা সম্ভব হয়নি। রক্তের স্টেম কোষের ক্ষতি, ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ শক্তির দ্বারা স্টেম সেলগুলির ধ্বংস, জিনগত কারণ, তেজস্ক্রিয় বিকিরণ এবং কেমোথেরাপি চিকিৎসা, পার্ভোরাইরাস ও হেপাটাইটিস-বি জাতীয় ভাইরাসঘটিত ইনফেকশন, ইত্যাদি কারণে অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া হতে পারে।

উপসর্গ
অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ার (Aplastic anemia) সঙ্গে অ্যাকিউট লিউকেমিয়া বা রক্তের ক্যানসারের উপসর্গের অনেক মিল রয়েছে। চিকিৎসকেরাই শুধুমাত্র তফাতটা বুঝতে পারেন। উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গেলে তাঁরা বেশ কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করতে দেন।
আক্রান্ত রোগীর শরীরে লোহিত রক্তকণিকার স্বল্পতার কারণে ভীষণ ক্লান্তি, দুর্বলতা, অবসাদগ্রস্ততা, বুক ধড়ফড় করা, চোখে ঝাপসা দেখা, মাথা ঘোরা, মাথা ধরা, ক্ষুধামান্দ্য, চোখ, হাত-পা, ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়।
শ্বেত রক্তকণিকার স্বল্পতার কারণে আক্রান্ত রোগী বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস সংক্রমণে ঘন ঘন ভুগতে পারেন।
অণুচক্রিকার অভাবে রোগীর নাক ও মুখ থেকে রক্তপাত, সহজে ক্ষত, ত্বকে ছোট-ছোট র্যাশ ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
এছাড়া দ্রুত এবং অনিয়মিত হার্টরেট দেখা যায়।

জটিলতা
অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া (Aplastic anemia) আক্রান্ত ব্যক্তি রোগটিকে অবহেলা করলে বা চিকিৎসা না করালে রক্তের ক্যানসার, মায়েলোডিসপ্লাসিয়া, বিভিন্ন জটিল ইনফেকশন, ইউরিনের সঙ্গে হিমোগ্লোবিন বের হয়ে যাওয়া জাতীয় জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারেন।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা
অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া বুঝতে চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা করতে বলেন রোগীকে যেমন পেরিফেরাল বাড, সিবিসি টেস্ট। এর সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট করতে বলেন চিকিৎসকেরা তা হল রেটিকুলোসাইট কাউন্ট। এছাড়া অস্থিমজ্জা বায়োপসি এবং আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা রয়েছে যা থেকে এই রোগটি ধরা পড়ে। পরীক্ষা করলে তবেই চিকিৎসক বুঝতে পারেন অস্থিমজ্জা তার নিজস্ব কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে কি না। এই অবস্থায় রোগীকে প্রতিমাসে এমনকী প্রতি সপ্তাহে প্লেটলেট এবং লোহিত রক্তকণিকা দিতে হতে পারে। অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ার চিকিৎসা শুধু দুঃসাধ্যই নয়, ব্যয়বহুলও বলা চলে।

আরও পড়ুন-শিক্ষামন্ত্রী ও অধ্যাপক-পড়ুয়াদের উপর নির্লজ্জ আক্রমণে ধিক্কার, যাদবপুরে হামলার প্রতিবাদে পথে ওয়েবকুপা

চিকিৎসা
সাধারণ অস্থিমজ্জায় রক্তকণিকা তৈরি করতে পারে এ-রকম ৩০ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ স্টেম সেল থাকে, কিন্তু অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ায় এই স্টেম সেলগুলো বেশির ভাগ নষ্ট হয়ে যায় এবং চর্বি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। আগে এই রোগ হলে সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে রোগীদের একটি জীবাণুমুক্ত কক্ষে আবদ্ধ করে রাখা হত। এখন বিভিন্ন ইমিউনোসাপ্রেসিভ থেরাপি দেওয়া হয়। এই থেরাপিতে ইমিউনোসাপ্রেসিভ ওষুধ দেওয়া হয়। এই ওষুধ বোনম্যারো বা অস্থিমজ্জাকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে।
স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট বা বোনম্যারো ট্রান্সপান্টেশন থেরাপি বা যাকে বলে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন এই রোগের চিকিৎসায় একটি কার্যকরী পদ্ধতি। এক্ষেত্রে প্রথমে রেডিয়েশন বা কেমোথেরাপির মাধ্যমে রোগগ্রস্ত অস্থিমজ্জার পরিবর্তে সুস্থ স্বাস্থ্যকর স্টেম সেল প্রতিস্থাপন করা হয়। এর ফলে আবার নতুন রক্তকণিকা উৎপাদন শুরু হয়ে যায়। এরপর ইমিউনোসাপ্রেসিভ ওষুধ দেওয়া হয় ।
এই রোগে অতিরিক্ত রক্তস্বল্পতার জন্য অনেক সময় বাইরে থেকে রক্ত দেবার প্রয়োজন পড়ে। এছাড়া ইঞ্জেকশনের মাধ্যমেও চিকিৎসা করা হয়। তবে সেই ইঞ্জেকশন বেশ খরচসাপেক্ষ।
এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক এবং অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দেওয়া হয় রোগীকে যাতে সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।

কী খাবেন/ খাবেন না
অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ার রোগীকে এমন খাবার খেতে হবে যা রক্তকণিকার উৎপাদনকে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। খাদ্যে ভিটামিন এবং আয়রনের মাত্রা বাড়াতে হবে। ভিটামিন বি টুয়েলভ এবং ফলিক অ্যাসিড রাখতে হবে। এছাড়া ফাইবার, প্রচুর খনিজ, প্রোটিন ইত্যাদি খেতে হবে। স্টার্চমুক্ত সবুজ শাক-সবজি ও ফল খেতে হবে। পালংশাক, মুসুরডাল, সয়াবিন, ছোলা ইত্যাদি খেতে হবে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল খেতে হবে। শুকনো ফল যেমন আলুবোখারা, কিশমিশ, এপ্রিকট খেতে হবে। ঘন প্রক্রিয়াজাত খাবার বা প্রসেসড ফুড এড়িয়ে চলতে হবে। নুন একেবারেই বেশি খাওয়া চলবে না। খেয়াল রাখতে প্রতিদিনের সোডিয়ামের পরিমাণ যেন ২৪০০ মিলিগ্রামের বেশি না হয়। ফাস্ট ফুড একেবারেই খাওয়া চলবে না। সারাদিনে অন্তত ৮ গ্লাস জল খেতে হবে। প্যাকেজড ফ্রুট জ্যুস যাতে চিনি থাকে, ক্যাফেইন যুক্ত পানীয়, অ্যালকোহল যুক্ত পানীয় একেবারেই এড়িয়ে যেতে হবে। কাঁচা বা আধসেদ্ধ খাবার খাবেন না।

Latest article