আয়রনম্যান গুবরে (Beetles)
গুবরে (Beetles) পোকার শক্তি মার্ভেল সিরিজের আয়রনম্যানের থেকে কোনও অংশে কম নয়। মাত্র ১৫-২৫ মিলিমিটার আকারের এই গুবরেটির ক্ষমতা তাক লাগানোর মতো। এই গুবরেটিকে কোনও গাড়ি পিষে ফেলতে পারে না। এর ওপর দিয়ে কোনও গাড়ি চলে গেলেও এটি দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। সাধারণভাবে এদেরকে একটি ছয়টি পা যুক্ত ছোট ট্যাঙ্ক মনে করা হয় যাকে নাকি পিষে ফেলা প্রায় অসম্ভব। খুব অবাক লাগছে তো? আসলে এই বৈচিত্রময় পৃথিবীর অনেককিছুই আমাদের চিরাচরিত জ্ঞানের বাইরে। তাই হয়তো এই ছোট আকারের বিস্ময়টি আমাদের এতটা অবাক করে। তাই বলে বিদেশি চলচ্চিত্রে দেখানো কোনও গল্পের মতো এই পোকাটির কিন্তু কোনও সুপার পাওয়ার নেই, তার চেয়ে বরং আছে একটা সুস্পষ্ট বৈজ্ঞানিক যুক্তি। যার ফলে কিনা এই ছোট্ট পোকাটিও আজ অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছে।
গুবরেটির (Beetles) পরিচয়
গুবরে পোকাটির আসল নাম ডায়াবলিক্যাল আয়রনক্ল্যাড বিট্ল আর বৈজ্ঞানিক নাম হল ফ্লোয়িয়োডেস ডায়াবোলিকাস। সাধারণত জুফেরেডি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত এই ক্ষুদ্র প্রাণীটির বাসস্থান উত্তর পশ্চিম আমেরিকায়, মূলত গাছের ছালেই থাকে এরা এবং এখানেই বংশবিস্তার সহ গোটা জীবন অতিবাহিত করে। এদের আরও শ্রেণিবিন্যাস করলে যা উঠে আসে, তা হল এরা প্রাণিরাজ্যের অন্তর্গত, সন্ধিপদী পর্বভুক্ত, পতঙ্গ শ্রেণি তথা কোলিওপ্টেরা বর্গের প্রাণী যার গোত্র জুফেরেডি, আমরা তা আগেই বলেছি। আর এদের প্রধান খাদ্য হল ছত্রাক। এতো গেল এদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তথা এদের খাদ্য ও বাসস্থানের কথা। এবার আসা যাক এদের দেহের গঠনে যার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে মূল রহস্য।
আশ্চর্য গঠন
সাধারণত এটি মনে করা হয় যে এই গুবরেটির (Beetles) সমস্ত শক্তি রয়েছে তার বহিঃকঙ্কালে। কারণ এদের এই বহিঃকঙ্কালের গঠনের কারসাজিতেই কোনও ভারী বস্তু বা গাড়ি এদের চট করে পিষে ফেলতে পারে না। আণুবীক্ষণিক যন্ত্রে করা পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে উঠে আসা প্রমাণ তথা ত্রিমাত্রিক মডেল থেকে বোঝা যায় এদের দেহের উপরিভাগ শক্ত খোলকে আবৃত যার উপরিতলটি সমান্তরাল। তবে আর পাঁচটা পতঙ্গের মতো এরা উড়তে পারে না। কারণ হিসেবে বলা যায় এদের পূর্বপুরুষের থাকা ডানা(এলিট্রা) কালের নিয়মে পরিবর্তিত হয়েই এদের দেহে এই শক্ত বর্মের ন্যায় গঠন সৃষ্টি করেছে। তবে এই গঠন এতটা কাঠিন্য পেল কীভাবে, কী ই বা তাদের গঠন বৈশিষ্ট্য, এই সমস্ত কিছু নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ডেভিড কাইসেইলাস এবং তাঁর সহকর্মীবৃন্দ গবেষণা চালান এবং এর ফলস্বরূপ যা জানা যায় তা হল এরা নাকি এদের দেহের ওজনের থেকেও প্রায় ৩৯০০০ গুণ চাপ বা ভার সহ্য করতে পারে। প্রমাণ বলে এরা সর্বোচ্চ ১৪৯ নিউটন চাপ সহ্য করতে পারে তবে গড় হিসাবে এর মান ১৩৩ নিউটন।
আরও পড়ুন-ইডি-সিবিআই তদন্তের নামে অতি-সক্রিয়তার নিন্দা করে সোমবার রাজ্য বিধানসভায় পাশ হল নিন্দা-প্রস্তাব
দেহের নয় যুদ্ধের ট্যাঙ্কার
এদের দেহ আসলে যুদ্ধে ব্যবহৃত ট্যাঙ্কের মতো। যার জন্য দায়ী বহিঃকঙ্কালের দুটি মূল আণুবীক্ষণিক বৈশিষ্ট্য। প্রথমটি হল- বহিঃকঙ্কালের ওপর ভাগ ও নিচের ভাগের মধ্যে এক ধারাবাহিক সংযোগ। গঠনগত দিক থেকে দেখলে দেখা যায় আসলে এদের দেহের বহিঃকঙ্কালটি ঠিক দুটি ভাগে বিভক্ত, ঠিক যেন ক্লামশেল-এর মতো কপাটযুক্ত দুটি ভাগ। যা একে অপরের ওপরে অবস্থিত।
কাইসেইলাস–এর মতে এই দুটি ভাগের বাইরের প্রান্তগুলিও একে অপরের সাথে ল্যাচ বা ছিটকিনির মতো একটি গঠনের মাধ্যমে যুক্ত থাকে। তবে এই সংযোগস্থানটির গঠনও কিন্তু পোকাটির দেহের স্থান বিশেষে পরিবর্তিত হয়। মূলত পরিবর্তন দেখা যায় এর অন্তর্গঠনে। যেমন এই প্রাণীটির দেহের সামনের অংশে যেখানে কিনা এদের দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি থাকে সেখানে যে বহিঃকঙ্কালের গঠনটি থাকে সেটির দুটি ভাগ একে অপরের সাথে খুব দৃঢ়ভাবে যুক্ত থাকে ঠিক চেনটানা দাঁতের সারির মতো। যার ফলে এই গঠনটি বাইরের অতিরিক্ত চাপকেও সহ্য করার ক্ষমতা পায়। আবার যদি এদের দেহের পেছনের অংশের দিকে লক্ষ্য রাখি তাহলে দেখা যায়, সেইসব অংশে থাকা বহিঃকঙ্কালের ভাগ দুটি সামনের দিকে থাকা অংশের মতো অতটাও দৃঢ় সংবদ্ধনে আবদ্ধ নয়, তার পরিবর্তে এদের দুটি ভাগ একে অপরের ওপর দিয়ে অনুভূমিক পাতের মতো চলাচল করে এবং এর পাশাপাশি এদের দেহের এই অংশটি অনেক বেশি সংকোচনশীল ও হয়ে থাকে। এই সংকোচনশীলতাই কিন্তু বাইরের সমস্ত চাপের বিরুদ্ধে কাজ করে দেহের ভিতরের গঠনকে অক্ষুণ্ণ রেখে প্রাণীটিকে চেপ্টে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। দ্বিতীয়ত যে মূল বৈশিষ্ট্যটি এদের শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে অন্যতম কারণ বলা হয় সেটি হল, এদের দেহে থাকা সন্ধিগুলির কাঠিন্য। এই সন্ধিগুলির অবস্থান বিচার করে দেখা যায় যে গুবরেগুলির (Beetles) দেহের দৈর্ঘ্য বরাবর সামনের দিক থেকে পিছন অবধি এরা বিন্যস্ত থেকে দেহের বামদিক ও ডানদিককে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করে রেখেছে। এই সংযোগ বরাবর উভয়দিকেই কতকগুলি ব্লেডের মতো বেরিয়ে থাকা অংশ দেখা যায়, যা একে অপরের সাথে ঠিক ‘জিগস পাজ্ল’–এর মতো গঠন তৈরি করে, দেহের এই দুটি পাশকে জোড়া লাগিয়ে রাখতে সাহায্য করে। এই ব্লেডের মতো অংশগুলি মূলত দেহকলার স্তরের সাথে এক বিশেষ প্রকারের প্রোটিনের মাধ্যমে যুক্ত থাকে, যা ঠিক আঠার কাজটি করে থাকে। এই প্রোটিন খুবই চাপ সহনক্ষম ও ক্ষয় প্রতিরোধী হওয়ায়, গুবরেটি যখন কোনও ভারী বস্তুর তলায় চাপা পড়ে যায় তখনও এই প্রোটিনের গায়ে মাত্র হালকা একটা ফাটল দেখা যায় যা কিনা মেরামতযোগ্য এবং তা সহজে মেরামত হয়েও যায়। প্রোটিনের গায়ে হওয়া এই ছোট্ট ফাটলই কিন্তু এর সাথে যুক্ত ব্লেডগুলিকে এতটা চাপ সহনক্ষম করে তোলে যে এদের ভিতরের অঙ্গগুলি কোনওভাবেই না ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে কাইসেইলাস ছাড়াও আমাদের এই তথ্যটির ব্যাখ্যা দেন ইঞ্জিনিয়ার জেসাস রিভেরা।
বিভিন্ন শিকারের হাত থেকে তথা প্রতিকূল পরিবেশ থেকে বাঁচতে গুবরেগুলির এই অদ্ভুত গঠন প্রায় সমস্ত বিজ্ঞানীকেই অবাক করে। পতঙ্গ বিশারদগণ ব্যবচ্ছেদের সময় এদের টেইসই খোলকটিকে পিনের সাহায্যে ফুটো করতে গিয়ে দেখেন যে সেই পিনটিই বেঁকে গিয়েছে আবার অনেকে এটিকে ড্রিল মেশিনের সাহায্যে ফুটো করার চেষ্টাতেও বিফল হন। এই সমস্ত তথ্যপ্রমাণ মাথায় রেখেই এই আশ্চর্য প্রাকৃতিক শক্তিকে বৈজ্ঞানিক তথা ইঞ্জিনিয়ারদের দল যে পরবর্তীকালে ক্ষয় প্রতিরোধী কোনও বস্তু বানানোর কাজে লাগাবে না তা কিন্তু ভাবাটা অযৌক্তিক হবে।