ভরা বসন্ত। প্রকৃতির গালে লেগে রয়েছে পলাশ-রং, শিমুল-রং। এইসময় মন ঘরবন্দি থাকতে চায় না। বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। সবসময় দূরে কোথাও যেতে হবে, তার মানে নেই। কলকাতার কাছে-পিঠে আছে বেশ কয়েকটি বেড়ানোর জায়গা। দু-একদিনের জন্য অনায়াসে ছুটি কাটিয়ে আসা যায়। তেমনই একটি জায়গা পূর্ব বর্ধমানের ভালকি মাচান (Bhalki Machan)।
গুসকরা বনাঞ্চলের একটি বড় অংশ জুড়েই রয়েছে ভালকি জঙ্গল। নেশা জাগানোর জন্য রূপের পশরা সাজিয়ে বসেছে পলাশ-শিমুল। সেইসঙ্গে রয়েছে দেবদারু, আমলকী, হরীতকী, শাল, সেগুনের মায়াময় হাতছানি। নির্জন নিরিবিলি পরিবেশ। নেই শব্দদানবের মস্তানি। কান পাতলেই শোনা যায় রকমারি পাখির ডাক। পাখির ছবি তুলতে চাইলে রাঙামাটির পথ ধরে চুপি চুপি চলে যেতে হবে গভীর জঙ্গলে।
নজর মিনারের অবস্থান জঙ্গল লাগোয়া। এটা মূলত পুরনো ওয়াচটাওয়ার। ভিতরে রয়েছে গভীর সুড়ঙ্গ। এটা নাকি ২৫ কিলোমিটার দূরের বর্ধমান রাজবাড়ি পর্যন্ত চলে গেছে। আবার এ-ও জানা যায়, এই সুড়ঙ্গ দুর্গাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। এই পথ নাকি বিপ্লবীরা ব্যবহার করতেন। ৫টি স্তম্ভের মাঝখানে খানিকটা জায়গা নিয়ে লোহার জালে ঢাকা একটি কুয়োর মতো রয়েছে। বর্ধমানের রাজা নাকি অবসর কাটাতে এবং শিকার করতে নজর মিনারে যেতেন। বন্দুক হাতে অপেক্ষা করতেন শিকারের জন্য। বদলেছে দিনকাল। জঙ্গল কেটে বেড়েছে বসতি। গজিয়ে উঠেছে দোকানপাট। সবমিলিয়ে এলাকাটির মধ্যে আশ্চর্য ভাললাগা ছড়িয়ে রয়েছে।
ভালকি মাচানের (Bhalki Machan) নাম নিয়েও ছড়িয়ে রয়েছে অনেক জনশ্রুতি। তাতে যেমন আছে ইতিহাসের ছোঁয়া, তেমন আছে মিথ। যে মিথটি বেশি প্রচলিত সেটা হল, অনেক আগে এই জঙ্গলে ভালুক ছিল। রাজারা ভালুক শিকার করার জন্য মাচান তৈরি করেছিলেন। তাই এই জায়গার নাম হয়েছে ভালকি মাচান। আবার আরও একটি মত হল, কাছেই আছে ভালকি গ্রাম। এই নাম থেকে এলাকার মাচাগুলোর নাম হয়েছে ভালকি মাচান।
অদূরেই আছে যমুনাদিঘি। এই দিঘিকে ঘিরে রয়েছে গোলাকৃতি সুন্দর বাগান। গাছে গাছে ফুটে রয়েছে নানারকম ফুল। বাগানে আছে কংক্রিটের বসার জায়গা। মাথার ওপর ছাউনি। পর্যটকরা চাইলে দিঘিতে মাছ ধরতে পারেন। বোটিংয়ের ব্যবস্থাও আছে। আশপাশে আছে কয়েকটি মন্দির। মন্দিরের টেরাকোটার কাজ দেখার মতো।
আরও পড়ুন: বিশ্বমঞ্চে সেরার সেরা স্বীকৃতি হাতে বাংলা
জঙ্গলের মধ্যেই রয়েছে বনবাংলো। চমৎকার এই বাংলো এবং জঙ্গলের মধ্যে নেই কোনও প্রাচীর। তাই জঙ্গলের মধ্যে রাত কাটানোর সাধ পূরণ হয় খুব সহজেই। বাংলোয় খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম এবং নির্ভেজাল আড্ডা ছাড়াও ঘুরে ঘুরে দেখা যায় শুকনো পাতা বিছনো মেঠো পথ। বসন্তের উদাসী বিকেলে পড়ন্ত রোদ এসে পড়ে গাছের পাতায়, আলো ছায়ায় তৈরি হয় অপূর্ব মায়া। এ-সবের পরশ পেতে এবং জংলি-গন্ধ গায়ে মাখতে হলে জুড়ি নেই এমন নিরীহ জঙ্গলের। হিংস্র জন্তু নেই। তবে আছে বন বিড়াল, শেয়াল, বাঁদর এবং নানা রকমের বিষধর সাপ। তাই সন্ধের পর গভীর জঙ্গলে না যাওয়াই ভাল। ভয়ানক রকমের উপদ্রব আছে দলমা হাতির। মাঝেমধ্যে সদলবলে তারা চলে আসে। তছনছ করে এলাকা।
অন্ধকারে জঙ্গলের রূপ একেবারেই অন্যরকম। জোনাকির জ্বলা-নেভা, ঝিঁঝিঁর ডাক, শুকনো পাতার মর্মরধ্বনি, পাখির ঘরে ফেরার ডাক, সব মিলিয়ে দারুণ এক আবহ রচিত হয়। শহুরে কোলাহল দূরে সরিয়ে যদি নির্জনতাকে কয়েকদিনের সঙ্গী করতে চান, তাহলে ভালকি মাচান হতে পারে আদর্শ জায়গা। ভালকি মাচান (Bhalki Machan) জঙ্গলে পিকনিকও করা যায়। কী ভাবছেন, পলাশ, শিমুলের রং গায়ে মাখতে বসন্তদিনে বেরিয়ে পড়বেন? সঙ্গে নিতে পারেন আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবদের।
কীভাবে যাবেন?
হাওড়া থেকে ট্রেনে মানকড় স্টেশন। সেখান থেকে সড়কপথে ১৩ কিলোমিটার গেলেই পৌঁছে যাবেন ভালকি মাচান। এছাড়াও বোলপুরগামী ট্রেনে গুসকরা স্টেশনে নেমে গাড়িতে যাওয়া যায় ভালকি মাচান। গুসকরা থেকে দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। বর্ধমান থেকেও যাওয়া যায়৷ সেক্ষেত্রে গাড়ি ভাড়া করতে হবে। যদি সড়কপথে যান, তবে ২ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে দুর্গাপুরের রাস্তা ধরতে হবে গলসি পর্যন্ত৷ গলসি থেকে ডানদিকের রাস্তা ধরলে পৌঁছে যাবেন মানকড়৷
কোথায় থাকবেন?
কলকাতা থেকে বর্ধমানের দূরত্ব মাত্র ৩ ঘণ্টা৷ তাই বেশিরভাগ মানুষ ভালকি মাচান পিকনিক করতে যান৷ তবে, যাঁরা দু-এক দিন কাটিয়ে আসতে চান, তাঁদের জন্য রয়েছে আউশগ্রাম পঞ্চায়েতের সাজানো অরণ্যসুন্দরী রিসর্ট৷ রিসর্ট বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ৯১৫৩৪-২০১৩৩ নম্বরে। ভাড়া : ডবল বেড রুম ১০০০ টাকা, থ্রি বেড রুম ১২০০ টাকা। নন-এসির ক্ষেত্রে। এসি রুমের ভাড়া একটু বেশি। আগে থেকে কথা বলে নেবেন।
এ-ছাড়াও যমুনাদিঘিতে রয়েছে রয়েছে রাজ্য মৎস্য উন্নয়ন নিগমের রিসর্ট৷ সেখানে থাকার সুবিধা তো রয়েছেই, সেইসঙ্গে রয়েছে পুকুর থেকে ধরা মাছের আস্বাদ পাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ৷
মাচানে থাকার এসি, নন-এসি, ডবল বেড, ট্রিপল বেড বা চার বেড সহ ১৩টি বেডের ডরমেটরি রুম ভাড়া পাওয়া যায়। খাবারের প্যাকেজ নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। উপরি পাওয়া হতে পারে আদিবাসী নৃত্য।