কিছু স্মৃতি ভোলার নয়। কিছু আতঙ্কও মোছার নয় জীবনভর। ২০২০ সালটা তেমনই। আচমকা এক ভাইরাস বিশ্ব জুড়ে মানবসভ্যতাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। মহামারী মোকাবিলায় পর্যুদস্ত হয়েছিল মানবসমাজ। ভারতবর্ষও ব্যতিক্রম নয়। পৃথিবীর প্রতিটা দেশ নিজের মতো করে থেমে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আজ তা সাময়িক মনে হলেও তখন তা অনন্তের মতোই মনে হত। কারণ সবই ছিল অনির্দিষ্টের হাতে। ‘লক ডাউন’ শব্দটা নিজেদের জীবনে আত্তিকরণের সুযোগ তখনও হয়নি শুধু ঘোষণাটা শুনেছে মানুষ। জীবিকার সন্ধানে, জীবন গড়তে হাজার হাজার ভারতবাসী ছড়িয়ে বিশ্ব কিংবা দেশেরই নানা প্রান্তে। রাষ্ট্র যখন আচমকা ঘোষণা করল নিজেকে গৃহবন্দি রাখার কথা, গৃহে ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল কাতারে কাতারে মানুষ। সে-সুযোগ, সে-ব্যবস্থা কিন্তু রাষ্ট্র করল না! পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র তখন ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ প্রতিযোগিতায় শামিল। পায়ে হেঁটে, ভুখা পেটে, কাঁধে-কোলে শিশু নিয়ে এক অমানবিক-অমানুষিক যাত্রায় শামিল হয়েছিল কয়েক লাখ মানুষ। এদের মধ্যে বেশিটাই পরিযায়ী শ্রমিক। আর্থিক অবস্থা প্রায় দিন-আনি-দিন-খাই গোছের। প্রতি মুহূর্তে প্রাণহানির চোখরাঙানি। কর্মস্থল বিতাড়িত করেছে। অন্যদিকে মহামান্য সরকার বাহাদুর দায়িত্ব নেননি। অতএব দায়িত্ব নিজের— লক্ষ্য, নিজের গৃহে ফেরা! তবে তো গৃহবন্দি রাখবেন নিজেকে!
এই লক্ষ্যপূরণ করতে গিয়েই যে ভয়াবহ ও মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিল মানুষ, তার কোলাজই ‘ভীড়’ (Bheed) ছবির নির্যাস। ‘তুম বিন’, ‘রা ওয়ান’, ‘দশ’-এর মতো ছবি তৈরির পর পরিচালক অনুভব সিনহা নিজের ছবির বিষয়ভাবনা সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলেছিলেন। বানিয়ে ছিলেন ‘আর্টিকেল ১৫’, ‘মূলক’, ‘থাপ্পড়’ এর মতো ছবি। সামাজিক ও রাজনৈতিক বার্তা যেখানে সুস্পষ্ট ও জোরালো। ‘ভীড়’ (Bheed) ব্যতিক্রম নয়। আর এই স্মৃতি এতটাই সতেজ, এখনও যে মানুষ ছবির সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা অনায়াস মিলিয়ে ফেলতে পারছেন। দিনযাপন আজ স্বাভাবিক হয়েছে কিন্তু সেই কালো স্মৃতি আজও যে তরতাজা।
না, কয়েকশো কোটির ব্যবসা করার রসদ এ ছবির নেই। সে উদ্দেশ্যে অনুভব এ ছবি তৈরি করেছেন বলেও মনে হয় না। কিন্তু বলিউড বাঁচাতে ‘পাঠান’ যেমন দরকার তেমনই ‘ভীড়’ও দরকার ইন্ডাস্ট্রির বলিষ্ঠতা রক্ষার্থে। সাই-ফাইয়ের কাল্পনিক লড়াই নেই হয়তো, আছে জীবন বাঁচানোর লড়াই। বিকিনি-বিতর্ক নেই কিন্তু আছে ঠিক-ভুল, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের জোরালো মানবিক বিতর্ক। আর আছেন অসাধারণ কিছু অভিনেতা। তাঁদের অভিনয় এ-ছবিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। মুখ্য ভূমিকায় রাজকুমার রাও। আছেন পঙ্কজ কাপুর। এ-ছাড়াও আছেন ভূমি পেডনেকর, দিয়া মির্জা, কৃতিকা কামরা, অদিতি সুবেদী, আদিত্য শ্রীবাস্তব ও আশুতোষ রানা। পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন প্রত্যেকে। তবে পঙ্কজ কাপুর ও রাজকুমার রাও অসাধারণ বললেও কম বলা হয়।
ঘরে ফেরার এই দীর্ঘ যাত্রায় ঔরঙ্গাবাদের রেলওয়ে ট্র্যাকে যে ঘটনা ঘটেছিল তা আজও মনে পড়লে শিউরে উঠতে হয়। মাইলের পর মাইল যাত্রাপথে শ্রমিকের দল রেলওয়ে ট্র্যাক ধরে হাঁটা দিচ্ছিল বাড়ির পথে। সেটাই সহজতম মনে করে। সে-ছাড়া বেশিরভাগ রাজ্যের সীমানা বন্ধ করে দেওয়াও কারণ। জানা ছিল, সমস্ত রকম পরিবহণ বন্ধ। তার মানে ট্রেন-চলাচলও বন্ধ জেনে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত শরীরে রেল লাইনেই ঘুমিয়ে পড়েছিল অনেকে। রাতের অন্ধকারে পণ্যবাহী ট্রেনের তলায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে থেমে গিয়েছিল তাদের ‘গৃহ’বন্দি হবার আশ! অনুভব এই ঘটনা দিয়ে হৃদয় চেরা শুরু করেছেন।
আরও পড়ুন- রাজ্যে বিরোধী দলগুলোর সীমাহীন রাজনৈতিক ভণ্ডামি
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও নিজের চেষ্টায় পুলিশ অফিসার হয়েছে সূর্য (রাজকুমার), পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যের সীমানায় আটকে রাখার দায়িত্ব তার। কিন্তু সীমানায় আটকে থাকা অসহায় মানুষগুলোর জন্য কোনও পরিষেবাই প্রায় না পেয়ে মরিয়া হয়ে ওঠে সে। প্রোটোকল নয়, মানুষকে বাঁচাতে প্রয়োজন মানবিকতা। আর এই ভাবনাই তাকে অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার সামনাসামনি করে। দিয়া মির্জা অন্যদিকে, উচ্চবিত্ত এক মহিলা-চরিত্রে কিন্তু একই রকম অসহায় নিজের মেয়েকে অন্য রাজ্য থেকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে। অন্যদিকে এই অতিমারিতেও যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ছেদ পড়েনি তাদের অন্যতম যেমন চিকিৎসক, তেমনই সাংবাদিক। ভূমি পেডনেকর এক চিকিৎসকের চরিত্রে আর কৃতিকা কামরা সাংবাদিকের চরিত্রে, যারা ফ্রন্টলাইনে সমানে লড়ে গেছেন।
পুরো ছবিটি সাদা-কালোয় হওয়ায় অভিঘাত যেন বেশি। বিষয়ও স্পর্শকাতর। ইদানীং ‘বয়কট গ্যাং’-এর প্রাদুর্ভাব যে হারে বেড়েছে, তাতে ছবি-মুক্তিতে কোনও বাধা না পড়ে সেই আশঙ্কায় অনুভব প্রথম ট্রেলারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যে ভাষণটির ঝলক রেখেছিলেন, তা বাদ দিয়ে দেন কিছুদিন পরেই। স্পষ্টতই জানিয়েছিলেন তিনি, ‘এ ছবি মানুষের কথা বলে, তাই মানুষের সেটা দেখা দরকার। অযথা বিতর্কে তাতে বাধা পড়ুক চাইনি!’