সমাধি, জলপ্রপাত এবং মন্দিরের শহর সাসারাম। অবস্থান বিহারে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে খুব দূরে নয়। শহরটি ঘিঞ্জি। পায়ে হেঁটে ঘুরলে সহজেই অচেনাকে চেনা যায়, অদেখাকে দেখা যায়। আরও একটি কারণে সাসারাম (Bihar sasaram) জনপ্রিয়। এই শহরে রয়েছে শেরশাহের মকবরা। ফরিদ খান ছিলেন প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের অধীনে বিহারের সাসারাম অঞ্চলে এক সামান্য জাগিরদারের পুত্র। কম বয়স থেকেই তিনি ছিলেন অসাধারণ তেজি ও সাহসী। বিহারের জঙ্গলে বাঘ মেরে ফরিদ খান পরিচিত হন শের খান নামে। ১৫৩৯ সালে চৌসার যুদ্ধ ও ১৫৪০ সালে কনৌজের যুদ্ধে হুমায়ুনকে হারিয়ে দিয়ে দিল্লির সিংহাসনে বসেন শের খান। তারপর তিনি শেরশাহ উপাধি পান। এর বছর পাঁচেক পর, ১৫৪৫ সালে কালিঞ্জের দুর্গ আক্রমণের সময় অগ্নিদগ্ধ হন। তিন দিনের মাথায় তাঁর মৃত্যু হয় এবং তাঁকে সাসারামে (Bihar sasaram) সমাহিত করা হয়।
সুশাসক ছিলেন। জি টি রোড তৈরি করেছিলেন শের শাহ। এই রাস্তার উপর অবস্থিত সাসারাম। শহরটি তাঁর স্মৃতি বিজড়িত। আছে বেশকিছু দর্শনীয় স্থান।
শের শাহের সমাধি
বিশাল পুকুরের মাঝে কৃত্রিম দ্বীপ। সেখানেই রয়েছে শের শাহের সমাধি। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘পানি রোজা’ নামে পরিচিত। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া রয়েছে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে। বেলেপাথরে তৈরি স্মৃতিসৌধ। যার পূর্ব-পশ্চিম ১২০০ ফুট ও উত্তর-দক্ষিণ ৯০০ ফুট বিস্তৃত। তার মাঝে তৈরি জলাশয়ে রয়েছে শেরশাহের সমাধি। এই সৌধের প্রবেশদ্বারের উত্তর দিকে আছে আরও একটি রাস্তা। পাথর দিয়ে তৈরি সেই পথ মূল সৌধকে প্রবেশদ্বারের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এই মকবরার ভিতরে শেরশাহের পাশাপাশি তাঁর পরিবারের অনেকের সমাধিও রয়েছে। কৃত্রিম দ্বীপে পৌঁছোনর জন্য একটা সাঁকোর মতন হাঁটা পথ আছে।
হাসান শাহের সমাধি
শেরশাহের মকবরার পূর্ব প্রান্তে রয়েছে শেরশাহের বাবা হাসান শাহের সমাধি। এটি ‘সুখা রোজা’ নামে পরিচিত। এর অবস্থান কিন্তু জলে নয়। বরং ডাঙায়। তাই নাম সুখা রোজা। হাসান শাহের মকবরাটি একটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। যার চার কোণে চারটে গম্বুজ আকৃতির ছতরি। তিন দিকের দেওয়ালের মাঝে আছে খিলান যুক্ত প্রবেশ দ্বার। পশ্চিম দেওয়ালে প্রবেশ দ্বারের কাছে আছে একটা ছোট মসজিদ। মকবরার ভেতরে হাসান শাহের কবরের সঙ্গে আরও বেশ কিছু কবর আছে। তবে মকবরার গেটে তালা। তাই ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। হাসান শাহের মকবরাটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে আছে। তবে এর রক্ষণাবেক্ষণ খুব একটা ভাল নয়।
আরও পড়ুন- রাজ্যপালের দেওয়া পুরস্কার ফিরিয়ে দিল লুমিনাস ক্লাব
ইসলাম শাহের অর্ধসমাপ্ত মাকবরা
ঘুরে দেখা যায় শেরশাহের ছেলে ইসলাম শাহের অর্ধসমাপ্ত মাকবরা। ইসলাম শাহ সেলিম শাহ নামেও পরিচিত ছিলেন। এই মকবরা বড় রাস্তার অন্য পারে অবস্থিত। শেরশাহের মকবরার মতোই এর নকশা। শোনা যায় তার চেয়েও বড় পুকুর ও মকবরা তৈরির পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু প্রথম স্তরের পর আর কাজ এগোয়নি। অর্ধসমাপ্ত থেকে যায়। বর্তমানে পুকুর ও মকবরার অবস্থা খুবই করুণ। কয়েকটা খিলানওয়ালা দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। সেখানে খোলা আকাশের নিচে অনেক কবর। শেরশাহ ও হাসান শাহের মকবরার স্থপতি ছিলেন আলিওয়াল খান। আলিওয়াল খানের মকবরাটি তিনি নিজেই নির্মাণ করেন এবং সেটিও সাসারামে অবস্থিত। সাসারামে আছে একটি পরিত্যক্ত দুর্গ। সবজি বাজারের মধ্যে এর অবস্থান। স্থানীয় লোকেরা বলে খণ্ডহর কিলা। কেল্লাটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধুঁকছে।
মন্দির ও জলপ্রপাত
সাসারামের (Bihar sasaram) আশেপাশে রয়েছে অনেক মন্দির এবং পাহাড়, জলপ্রপাত। সীতাকুণ্ড, মাঝেরকুণ্ড, ধুঁয়াকুণ্ড, তুতলা ভবানী জলপ্রপাত দেখার জন্য প্রচুর পর্যটক ছুটে যান। পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে জলধারা। প্রবাহিত হয় পাথুরে জমির উপর দিয়ে। জলপ্রপাতগুলো একে-অপরের থেকে প্রায় ২ কিলোমিটারের ব্যবধানে রয়েছে। এই জলপ্রপাতের রাস্তাতেই রয়েছে ৫১ পীঠের এক পীঠ তারাচণ্ডীর মন্দির, তুতলা ভবানী মন্দির ইত্যাদি। বহু মানুষ দর্শন করেন ও পুজো দেন। সাসারাম শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে, দুর্গাবতী নদীর উপরে গড়ে উঠেছে দুর্গাবতী ড্যাম। সেখান থেকে আরও ৬০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে তেলহার কুণ্ড জলপ্রপাত। রোহতাস মালভূমির উপর কৈমুর পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে এই জলপ্রপাতটি। মিশেছে দুর্গাবতী নদীতে। এ ছাড়া এখানে রয়েছে কর্কটগড় জলপ্রপাত ও মুণ্ডেশ্বরী মন্দির।
কীভাবে যাবেন?
হাওড়া ও সাসারামের মধ্যে আছে অনেক ট্রেন। সময় লাগে ১০ ঘণ্টার মতো। রাতের ট্রেনে যাতাযাত করলে সময় বাঁচবে। হাওড়া-মুঘলসরাইয়ের মাঝে সাসারাম একটি জনবহুল রেলস্টেশন।
কোথায় থাকবেন?
সাসারামের পোস্ট অফিস অঞ্চলে রয়েছে কিছু সাধারণ হোটেল। ভাড়া নাগালের মধ্যে। পোস্ট অফিস মোড় অঞ্চলে আছে বেশকিছু স্ট্রিট ফুডের দোকান। বিক্রি হয় বিহারের জনপ্রিয় খাবার লিট্টি। লিট্টির সঙ্গে আছে আলু চোখা বা বেগুন ভর্তা। আর আছে নন ভেজ লিট্টি। লিট্টির সঙ্গে চিকেন ও মাছের হালকা ঝোলওয়ালা তরকারি মন্দ লাগবে না। পাশাপাশি আছে অনেকগুলো হোটেল। মধ্যাহ্ন এবং নৈশভোজ সারা যায়। দু-চারদিনের জন্য ঘুরে আসুন।