গ্রাম-বাংলার প্রবীণারা প্রায়শই একটা কথা বলে থাকেন। ‘নিজের বেলায় আঁটিসুটি, পরের বেলায় দাঁতকপাটি’। অস্যার্থ, নিজের বেলায় সব ঠিক, অন্যের ক্ষেত্রে সেগুলোই সমলোচনার যোগ্য।
ইন্দ্রপ্রস্থ দিল্লি। তার রাজনৈতিক সংঘাতের চূড়ান্ত পর্ব আসন্ন, সেখানকার বিধানসভা নির্বাচনে। ইন্দ্রপ্রস্থ দখলের সেই মহারণের প্রাক্কালে মোদিপক্ষের আচরণ দেখে ওই গ্রামীণ বুড়ি-বাক্য মনের কোণে ঘাই মারছে, অবিরত।
যে যে বিষয়গুলো রাম-বাম-কং-দের চোখে একটা বিষম বিদ্রুপোযোগী ছিল, কিন্তু সর্বতোভাবে বিরোধিতার মুরোদ হয়নি কারও, যে যে পদক্ষেপগুলো ওদের কাছে উপহাস্যাম্পদ ছিল, কিন্তু নির্বাচকদের স্বার্থ বিবেচনা করলে আদৌ উপেক্ষণীয় নয়, সেগুলোই এবারকার ইন্দ্রপ্রস্থ সমরে পদ্মপক্ষের শঙ্খ, গদা, সুদর্শন চক্র। আর সেটা লক্ষ্য করেই, বুক ঠেলে উঠে আসছে কথাটা, ‘নিজের বেলায় আঁটিসুটি’ ইত্যাদি।
বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা ইন্দ্রপ্রস্থের বুকে ‘উন্নয়নের পথ’ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি (ইনক্লুসিভ পলিটিক্স)-র ভিত গড়ার লক্ষ্যে যে ‘সংকল্প পত্র’ (পড়ুন ‘নির্বাচনী ইশতেহার’) প্রকাশ করেছেন, তাতে মহিলাদের আড়াই হাজার টাকা করে মাসিক ভাতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নারীর সশক্তিকরণের জন্য পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার চালু করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সেই জনহিতকর প্রকল্পকে ‘ভিক্ষের দান’ বলতে ছাড়েননি। মহিলা ভোটাররা বিজেপির মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছিল। সেই চরম অভিজ্ঞতার পরম আলোকে দীপ্র বিজেপি মধ্যপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রে যথাক্রমে ‘লাডলি বহেনা’ ও ‘লড়কি বহিন’ যোজনা চালু করে ভোটযুদ্ধে ফসল তুলেছে।
এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই অসন্তুষ্ট আপ। নিখরচতায় বিদ্যুৎ, জল ও বাস পরিষেবা প্রদানের ঘোষণা করে তারাও মমতা ব্যানার্জির মতো মোদি শাহদের বিদ্রুপ ও সমালোচনার শিকার হয়েছিল। অরবিন্দ বেজরিওয়াল তাই চাইছেন, জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি নিয়ে মিথ্যে মশকরার জন্য বিজেপি এবার প্রাকাশ্যে ক্ষমা চাক। আপ সরকার যেসব প্রকল্পের জন্য এতদিন ধরে সমালোচিত হচ্ছে বিজেপি-র নির্বাচনী ইশতেহারে যদি সেগুলোই থাকে, তবে তো এই দাবি ওঠাটাই স্বাভাবিক। দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনা বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহার তো পরোক্ষে মমতা-কেজরিওয়ালদের বিচক্ষণতার প্রতি, তাঁদের জনহিতকর প্রকল্পের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন। বিজেপি সেটা অস্বীকার করবে কোন আক্কেলে? অবস্থা দেখে শঙ্খ ঘোষের কবিতার একটা পঙ্ক্তি মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিজেপির আত্মোপলব্ধি, ‘বুঝতে একটু দেরি হয়, কোনটা পথ, কোথায় বা যাব’।
এই আবহে নাড্ডা তো প্রকাশ্যে জানাতে বাধ্য হয়েছেন, এবারের নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতায় এলে তারাও দিল্লিতে কেজরিওয়ালের প্রকল্পগুলো চালু রাখবে। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ‘খয়রাতি নীতি’র নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখাটাই এখন নরেন্দ্র মোদির গ্যারান্টি। আপদের নীতিই মোদির বাঁচার জন্য খড়কুটো।
খয়রাতি বা রেওড়ি বলে এতদিন ব্যঙ্গ বিদ্রুপ সমালোচনার তির নিক্ষিপ্ত হত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ কেজরিওয়ালদের লক্ষ্য করে। আমাদের যেমন পুজোতে- উৎসবে বাতাসা বিলির রেওয়াজ আছে, হিন্দি বলয়ে তেমনই বাতাসার বিকল্প হল রেওড়ি। তিল আর গুড় দিয়ে তৈরি সস্তার মিঠাই। সেই রেওড়ি ছড়িয়েই এবার ভোটে লড়তে চলেছে বিজেপি, দিল্লিতে।
কাদের মধ্যে বিলি হবে নগদ অর্থ? প্রাপকের তালিকায় মহিলা থেকে বয়স্ক নাগরিক, সবাই আছেন। সর্বস্তরের নাগরিককে ছুঁতে চাইছে বিজেপি।
শুধু মহিলাদের মাসিক ভাতা ২,৫০০ টাকা করা নয়, পাশাপাশি গ্যাসের দাম ভর্তুকি দিয়ে ৫০০ টাকা করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে বিজেপি। হোলি আর দেওয়ালিতে নিখরচায় মিলবে একটা করে সিলিন্ডার। বয়স্ক নাগরিকদের অবসরকালীন ভাতা ২০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫০০ টাকা করার প্রতিশ্রুতিও আছে তাদের ঝুলিতে।
এখানেই উঠছে প্রশ্ন। যদি কেজরিওয়ালের বিনা ভাড়ায় বাসে যাতায়াতের সুযোগ নিশ্চিত করাটা আপদের অপব্যয় হয়, তবে মোদিজিদের এসব প্রকল্প বাবদ খরচও তো অনর্থক ব্যয়ের বোঝা। সরকারের ব্যয়ের বোঝার ওপর শাকের আঁটি। আর তাই যদি হবে, তবে বিচক্ষণ বুদ্ধিমান মোদিপক্ষ সেই পথে হাঁটছেন কেন? মানুষের আস্থা পেতে বিজেপির রেওড়ি-রাজনীতি ঠিক আর মানুষের আস্থা ধরে রাখতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা অরবিন্দ কেজিরিওয়ালদের নগদ সুবিধা সরাসরি হস্তান্তরের রাজনীতির ওপর নির্ভর করাটা অনুচিত, এ আবার কেমন কথা! এ তো, এক কথায় দ্বিচারিতা।
আরও পড়ুন- ভিড় বেড়েছে বক্সায়, পর্যটক নিরাপত্তায় কঠোর প্রশাসন
এই দ্বিচারিতা স্পষ্টতর হয় যখন দেখি ও জানি, যে বিজেপি দিল্লিতে কেজরিওয়ালের নিখরচায় বাস পরিবহণ পরিষেবা চালু রাখতে আগ্রহী, তারাই পশ্চিমবঙ্গের বাস পরিষেবার ক্ষেত্রে ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছে। এরাজ্যে বাসে ভর্তুকি তুলে দিয়ে সরাসরি। সরকারি কর্পোরেট সংস্থার হাতে বাস পরিবহণ ব্যবস্থার রাশ তুলে দিতে চায় তারা।
এই পরস্পর বিরোধী অবস্থান বুঝতে ও বোঝাতে একটি গবেষণাপত্রের কথা বলা প্রয়োজন।
সম্প্রতি কে কে কৈলাস এই জনকল্যাণমূলক সামাজিক প্রকল্পের ভোট রাজনীতিতে অভিঘাত নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। ২০২৪-এ প্রকাশিত ‘দ্য পলিটিক্স অব ওয়েলফেয়ার : দ্য বিজেপি অ্যান্ড দ্য ডিসার্নিং ভোটার’ শীর্ষক ওই গবেষণাপত্রে স্পষ্ট বলা হয়েছে, মাঝখানে যাকে ‘রেওড়ি রাজনীতি’ বলে ব্যঙ্গ করছিল বিজেপি সেটা ভারতে স্বাধীনতার পর থেকেই চালু ছিল। সামাজিক শক্তিগুলো সবসময় আর্থ -সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে। তাই গরিবি হটানোর উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অঙ্গ ছিল এই ধরনের জনকল্যাণকর ব্যবস্থা। পরে যখন বাজার অর্থনীতি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ব্যবস্থাটাকেই নড়বড়ে করে দিল, তখন ক্রমাগত বাড়তে থাকা আয় বৈষম্যের প্রতিষেধক হিসেবে এই ধরনের ‘খয়রাতি’ দরকার হয়ে পড়ল। আয় বৈষম্যের বিরাট হাঁ বোজাতে অর্থনৈতিক সংস্কারের অনস্বীকার্য উপাঙ্গ হয়ে উঠল এই ধরনের প্রকল্পগুলো।
কে কে কৈলাস আরও দেখিয়েছেন, নগদ সুবিধা হাতে পেলেই যে ভোটাররা গদগদ হয়ে দাতা রাজনৈতিক দলকে ভোট দেবে, তেমনটা মোটেই নয়। যদি ভোটারের আর্থিক অবস্থা সন্তোষজনক হয় আর পাশাপাশি ওই ধরনের সামাজিক প্রকল্পের সুবিধা তিনি বিশেষ কোনও প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পান তবে সুবিধা প্রদানকারী সরকার বা রাজনৈতিক দল প্রতিপক্ষের থেকে অন্তত ১৫ শতাংশ অধিক সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে। আর যদি ভোটার তাঁর নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকেন, তবে সহজে এধরনের সুবিধা পাওয়া গেলেও তিন বিরোধী পক্ষে ভোট দেন। এটাই দস্তুর। কৈলাস আলোচনার উপসংহার টেনেছেন এই বলে, সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পের (বা খয়রাতির) সুবিধাভোগীরা এখন আর নিষ্ক্রিয় গ্রহীতামাত্র নন, তাঁরা এখন বিচক্ষণ উপভোক্তা হয়ে উঠেছেন।
এই চালচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে বিজেপির ঢোঁক-গেলা, ডিগবাজি খাওয়া, এসব দেখে পূর্বোল্লিখিত গ্রামীণ প্রবচন ছাড়াও, শঙ্খ ঘোষেরই কবিতার চারটে লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে।
“হঠাৎ কখনো যদি বোকা হয়ে যায় কেউ, সে তো নিজে আর / বুঝতে পারে না। কেউ যদি বুঝতই তাহলে তো বুঝদারই / বলা যেত তাকে। তাই যদি, তবে / তুমিও যে বোকা নও কীভাবে তা বুঝবে বলো তো?”
বুঝদার বিজেপি কি তবে বুঝতে পারছে, তারা বোকা বনে গিয়েছে? আর সেজন্যই…