মেয়েদের ব্রতকথা বাংলার ও বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্রত কী এবং সেটা মেয়েদের কথাই বা কেন? সামান্য আয়োজনে, কিছু প্রাপ্তির আশায় ভক্তিভাবের যে একান্তই নিজের ধর্মাচরণ তাই তো ব্রত। সময়ের সঙ্গে নিষিদ্ধ হয়েছে বেদপাঠ, আগল পড়েছে জ্ঞানের দোরে। অথচ ধর্ম ছাড়া সমাজ হবে না। একটা চাকা যদি স্থাণু হয়ে থাকে অপর চাকা যতই চেষ্টা করুক সমাজ-যান কিছুতেই এগোবে না। তাই জ্ঞানরাশি নতুন করে ঢোকানো হল মহাকাব্যে— যুদ্ধের রথকে ট্রাফিক সিগনালের লাল আলোতে আটকে রেখে সারথি ও রথির মধ্যে হল জ্ঞানের চালাচালি। উদেশ্য সফল কিন্তু ভাষায় সীমাবদ্ধ। তার পরে ভক্তিরসে জারিত মহাপুরাণ। সেসবও তো ভাষার পাঁচিলের ওপারে। বাঙালি মেয়েদের একান্ত অন্তঃপুরের নিভৃতে ছিল ব্রতকথা। ব্রতকথার মধ্যে ভাগগুলো ছিল এরকম— কুমারী মেয়েদের ব্রত, সধবা নারীর ব্রত, সধবা-বিধবা নির্বিচারে মেয়েদের অর্থাৎ মায়েদের ব্রত। খুব কম ব্রতই আছে যা স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের পালনীয়। অর্থাৎ ধর্ম সবার হলেও ব্রত যেন অন্তঃপুরের নিভৃতবাসীদের মনের কথা।
ব্রত কথাটির সাধারণ অর্থ নিয়ম, সংযম। বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ এই বাংলা। এমন মাস খুব কমই আছে এই বাংলায়, যার কোনও-না কোনও মাসে কোনও ব্রতের অনুষ্ঠান হয় না। মূলত নারীর কামনা-বাসনা পূরণের জন্য কৃত সম্পাদনই ব্রত। অর্থাৎ কোনও কিছুর কামনা প্রার্থনায় নারীসমাজ আন্তরিকভাবে যে সকল ক্রিয়াচার পালন করে। তা-ই অবনীন্দ্রনাথের মতে— কিছু কামনা করে যে অনুষ্ঠান সমাজে চলে তাকেই বলি ব্রত।
ব্রত একক ক্রিয়া অনুষ্ঠান নয়, একের কামনা দশের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে ব্রতের অনুষ্ঠান। ব্রতের মধ্যে সর্বদা একটা কামনা প্রকাশিত হয়। কামনা-বাসনার বাস্তব রূপায়ণের জন্যই ব্রতের আয়োজন। বাংলা ব্রত বা বাংলার মেয়েলি ব্রতের কতকগুলো পর্যায় থাকে, আহরণ, আচরণ, কামনাজ্ঞাপন, ব্রতকথা, শ্রবণ ইত্যাদি। আহরণ অর্থে, ব্রতে যা যা লাগবে তা সংগ্রহ করা। অর্থাৎ উপকরণ সংগ্রহ। ব্রতের উপকরণকে উপাচারও বলে। সাধারণত ব্রতের উপকরণ বা উপাচারের মধ্যে পড়ে— ঘট, আম্রপল্লব, ফুল, দূর্বা, ধান, প্রদীপ, তুলসী, বেলপাতা, সিদ্ধি, হরীতকী, তিল, দধি, মধু ইত্যাদি হল ব্রতের উপকরণ। বাংলার ব্রতের উপকরণগুলি এ-দেশীয় আর্থ-সামাজিক পরিবেশ সংস্কৃতির এক সুচিত্রিত প্রেক্ষাপট।
শাস্ত্রীয় ব্রত ভারতে আর্যদের অনুষ্ঠান পুরাণ ভেঙে এই ব্রতের উদ্ভব, আচার-নিয়মের নিষ্ঠাও ব্রতের মূল লক্ষ্য। অন্যদিকে, মেয়েলি ব্রত ভারতের নিবাসীদের অনুষ্ঠান, মেয়েলি ব্রতের উদ্ভব বৈদিক নয়, এর মধ্যে একটা জাতির প্রাণের কথা, একটা স্বপ্ন যেন মূর্তরূপ পেতে চায়। বেদ, পুরাণের চেয়েও পুরনো এইসব লৌকিক ব্রত অনুষ্ঠান।
শাস্ত্রীয় ব্রত পুরুষতান্ত্রিক আর্য সভ্যতার অবদান, আর মেয়েলি ব্রত মাতৃতান্ত্রিক অনার্য সমাজের সৃষ্টি-আর্য-পূর্ব সমাজে এর উদ্ভব। ব্রতের সঙ্গে পুজো উপাসনার বিস্তর ফারাক। পুজো উপাসনায় দেবীকে পুষ্টি ও খাদ্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ভোগের আড়ম্বর পুজোর অঙ্গ। উপবাস যেন ব্রতের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। বৈদিক সূক্তের সঙ্গে মেয়েলি ব্রতের চাওয়া-পাওয়া কামনায় মিল থাকলেও বৈদিক অনুষ্ঠান মূলত পুরুষদের আর ব্রত অনুষ্ঠান মেয়েদের। বৈদিক ঋষিরা যেখানে চাচ্ছেন ইন্দ্র আমাদের সহায় হোন, তিনি আমাদের বিজয় দিন, শত্রুরা দূরে পলায়ন করুক ইত্যাদি। আর বাঙালি মেয়েরা চাইছে পতিব্রতা হব, সংসার পরিজনে সুয়ো হব, আচরণে লক্ষ্মী হব, সময়ে পুত্রবতী হব।
আরও পড়ুন- ভরা হেমন্তে শহরে শ্রাবন্তী
বাংলার ব্রত বাঙালি মেয়েদের নিজস্ব ধর্মাচরণ পদ্ধতি। জ্ঞানের বাড়াবাড়ি নেই, আড়ম্বরের কড়াকড়ি নেই, নেই কঠিন সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণে জিভের জড়াজড়ি। এক অটল বিশ্বাসে প্রগাঢ় ভক্তিতে দেবতার কাছে সামান্য কিছু চাহিদা। একটু সিঁদুর-আলতা, একটু গোবর, দুধ, গাছের চেনা ফলপাকুড় আর ফুল, সাথে থাকে অন্তরের আকুলতা— সন্তানকে রক্ষা করার আকুলতা, বাণিজ্য থেকে স্বামীকে সুস্থ শরীরে ফেরানোর আকুলতা, বাপ-ভাইয়ের সুস্থ শরীর থাকার আকুলতা আর সর্বোপরি সতীন না থাকার আকুলতা এবং স্বামীর পূর্বে দেহত্যাগের আকুলতা। সেই চিরন্তন আলো বা চুম্বকের ধর্মের মতোই আকুলতাগুলো কিন্তু একই ভাবে সমকালীন।
ব্রত কিন্তু বাংলার নিজস্ব কৃষ্টি। আর্য আগ্রাসনের পূর্ব সময়ের ভারত তথা বাংলার ইতিহাসের সাক্ষী সেই সিন্ধু সভ্যতা। সেখানেও সিঁদুর মাখানো মাটির পুতুল পাওয়া গেছে একাধিক। এগুলো ব্রতের সাক্ষ্য দেয়। বাংলার ব্রতকথায় আছে সেঁজুতি ব্রত, দশপুতুল ব্রত যেখানে ব্রতীকে মাটির পুতুল গড়ে পুজো করতে হয়। কিন্তু উৎসব পুজোর মতো সেটা সাড়ম্বরে নিরঞ্জন হয় না। সে-যুগের ব্রতধারা বয়ে নিয়ে চলেছে আজও বাংলার কোনও নারী, বৈশাখ মাসে গঙ্গাস্নান করে অশ্বত্থ গাছে জল দেওয়ার মধ্যে। এই ব্রত থেকেই কি ব্রাত্য শব্দের সৃষ্টি? আর তাই কি গঙ্গারিডাই সভ্যতার মানবকুল ব্রাত্য আর্য?
একটা সময় কুমারী ব্রত হিসেবে পুণ্যপুকুর, দশ পুতুল, সেঁজুতি ব্রত অবশ্য পালনীয় ছিল মেয়েদের মধ্যে। সধবাদের মধ্যে এয়ো সংক্রান্তির ব্রত, কুলুই মঙ্গলচণ্ডী ব্রত, সুয়ো দুয়ো, ইতু, জয়মঙ্গলবার ব্রত বেশ জনপ্রিয় ছিল। উপকরণ সামান্য, গৃহে এবং চারপাশে পাওয়া যায়, সেইভাবে ব্রাহ্মণের ভূমিকা নেই। আড়ম্বরহীন এইসব ব্রতের মূল চাহিদা, স্বামীসোহাগী হওয়া, সতীনের সর্বনাশ, ভাইয়ের মঙ্গল, পুত্রবতী হওয়া এবং সধবা অবস্থায় মারা যাওয়া।
সেঁজুতি ব্রতে প্রায় পঞ্চাশ রকমের ছবি আঁকা হত মাটিতে, তারপর তাতে মন্ত্র পড়ে ফুল দিয়ে পুজো। যেমন হাতা আঁকা হল, মন্ত্র হবে হাতা হাতা হাতা খা সতীনের মাথা। বঁটি আঁকা হবে, ফুল দিয়ে পুজো করতে হবে। মন্ত্র হবে বঁটি, বঁটি, বঁটি, সতীনের শ্রাদ্ধে কুটনো কুটি। সাধনার এই সহজ পথের সবচেয়ে বড় হল বিশ্বাস। পুণ্যপুকুর ব্রতে মাটিতে একটি গর্ত কাটতে হবে। গর্তের চারপাশে মাটির পাড়, সেখানে কড়ি, হলুদ গাঁথা। গর্তের মাঝে বেলকাঁটা পোঁতা। কাঁটায় ফুল সাজিয়ে কুমারী বালিকা পুজো করবে। সামনে একটি থালায় একটু বাতাসা। মন্ত্র হবে— পুণ্যপুকুর পুষ্পমালা/ কে পুজেরে সকাল বেলা?/ আমি সতী লীলাবতী/ সাতভাইয়ের বোন ভাগ্যবতী/ স্বামীর কোলে পুত্র দোলে/ মরণ হয় যেন একগলা গঙ্গাজলে। বৈশাখ মাসে প্রতিদিন এইভাবে করে চার বছর পর আসবে উদযাপন। ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা হিসেবে একটি রুপোর বেলকাঁটা আর যৎকিঞ্চিৎ কাঞ্চনমূল্য। বিশ্বাস কত গভীর হলে ভাবা যায় যে এরকম করলে সত্যিই একটা আদর্শ নারীর হওয়ার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে!
সময় পেরিয়ে যায়, বদলায় চাহিদা, বদলায় প্রেক্ষাপট। আজকের নারী উচ্চশিক্ষিত, স্বাবলম্বী। ব্যস্ততার জীবনে হাঁটুমুড়ে বসে দল বেঁধে ব্রতকথা শোনার সময় নেই তার। আধুনিক রাম ও ঈশ্বর তাকে বাঁচিয়েছে, নতুন জীবন দিয়েছে। বহুবিবাহ নিষিদ্ধ, তাই সতীন কেটে আলতা পরার চাহিদাও তার নেই। শুধুমাত্র মঙ্গল কামনার ব্রত বলে টিকে আছে জয় মঙ্গলবার, জামাইষষ্ঠী ইত্যাদি কয়েকটি আর শস্যের প্রতীকে বেঁচে আছে ইতু। ধনসম্পদের চাহিদা চিরকালীন, তাই বারোমেসে লক্ষ্মীব্রত টিকে গেল এ-যাত্রায়।
এই বানভাসি আধুনিকতায়/ধর্মের বোধ অপ্রয়োজনে বাদ পড়ে যায়। যখন ধর্মের আলোচনা হয় বড়ই জটিল আবর্তে ঢুকে যায় মন। ভঙ্গুর নদীর চরের মতো ধর্মের নীতি দ্রুত ভেঙে যায়। অথচ পাল্টায় না অ্যাসিডের কিংবা চুম্বকের ধর্ম। বাক্য ও মনের অতীত কিছুতেই মনকে ছুঁতে পারে না তাই সেটা বাদ পড়ে যায় স্বভাবতই। অনিষ্টের দোহাই দিয়ে এর পরে খোঁজ চলে ইষ্টের। এক এক ধর্মগুরু এসে জানিয়ে যান তাঁর উপাস্যই আদি। কাঁচা মন, বোঝানোর গুণে যখন বাঁশির সুরে মন দেয় তখন আর একজন বোঝান অসির ধারের গুরুত্ব। অসিতে মন-প্রাণ সমর্পণ করতেই আর একজন বোঝান কর্তার ইচ্ছেয় অসি চলে— চালচিত্রে তাঁর আবশ্যিক উপস্থিতি। ধর্ম সবসময় ধরে রাখতে পারে না, ভেঙে টুকরো করে দেয় কখনও। বাপপিতিমোর ভিটেয় পা রাখতে লাগে পাসপোর্ট। ধর্মের আচার অনুষ্ঠান, রীতিনীতি আর কঠিন কিছু সংস্কৃত মন্ত্রের মাঝে আবর্তিত হয়, ধাক্কা খায় আত্মরূপের সন্ধান। খোঁজ চলে সহজ কিছু পথের যা মন ছুঁয়ে যায় অনায়াসে। মাটির গন্ধমাখা সে-সাধনপথের নাম ভক্তির পথ। পথ দেখায় সহজ প্রাণের কথা— মেয়েদের ব্রতকথা।
যোগ্যতমের উদ্বর্তন তত্ত্বে বলে টিকে থাকে যোগ্যরাই। ব্রতের ক্ষেত্রেও তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে ব্রতের চাহিদা সমকালীন সেগুলোই টিকে আছে আজও।