গরমে, ঘামে এখন সব্বাই কাহিল। ছিটেফোঁটা বৃষ্টির অপেক্ষায় মানুষ যেন চাতক পাখি। প্রচণ্ড তাপে শুকিয়ে যাচ্ছে ফসল। দেখা দিচ্ছে খরা। এমন অবস্থায় সামান্য বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে বা মাঠে-ঘাটে পড়লে মনে হচ্ছে এর চেয়ে শান্তির বুঝি আর কিছু নেই। কেমন হত যদি আমরা যখন চাইতাম তখনই ঝরিয়ে নিতে পারতাম একটু বৃষ্টি। আবার বেশি বৃষ্টি ভাল না লাগলে ঠিক জলের কলের মতো তা বন্ধও করে দিতে পারতাম। শুনতে অবাক লাগলেও এমন যুগান্তকারী প্রযুক্তির আবিষ্কার হয়ে গেছে— যার নাম ক্লাউড সিডিং (cloud seeding)।
মানুষ কী না পারে! নিয়ন্ত্রণ করতে পারে আসমুদ্রহিমাচল— আকাশ, বাতাস এমন কী বৃষ্টিও। প্রকৃতির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা তাদের কাছে নতুন নয়। মানবজাতির এই সীমাহীন অগ্রগতির অন্যতম উদাহরণ হল ক্লাউড সিডিং বা কৃত্রিম বৃষ্টি। সম্পূর্ণ না হলেও বৃষ্টির ওপর মানুষ কিছুটা আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছে এই ক্লাউড সিডিংয়ের (cloud seeding) মাধ্যমে।
কী এই ক্লাউড সিডিং (cloud seeding)
ক্লাউড সিডিং হল এমন একটি প্রযুক্তিগত ধারণা যা হেলিকপ্টার বা ড্রোনের মাধ্যমে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে। আকাশে বৃষ্টির অনুপযোগী মেঘগুলোর উপর কেমিক্যাল ছড়িয়ে দিয়ে সময়ের আগেই বৃষ্টি ঝরিয়ে ফেলার পদ্ধতিকেই কৃত্রিম বৃষ্টিপাত বলে।
প্রাকৃতিক বৃষ্টি
কৃত্রিম বৃষ্টির আগে জানতে হবে প্রাকৃতিক বৃষ্টি কীভাবে হয়। সূর্যের প্রবল তাপে সমুদ্র, নদী, পুকুরের জল বাষ্পীভূত হয়ে উপরে উঠে অসংখ্য ধূলিকণার সঙ্গে মিশে জমাট বেঁধে যায়। সেই জলীয় বাষ্পই মেঘে পরিণত হয়। ট্রপোস্ফিয়ার স্তরে এই মেঘগুলো ঘনীভূত হতে হতে ভারী হয়ে যায় এবং একটা সময় পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে পৃথিবীতে নেমে আসে। তাহলে বৃষ্টির হওয়ার আসল কারণ হল মেঘের ঘনীভবন।
তাহলে ক্লাউড সিডিং কী করে
ট্রপোস্ফিয়ারে থাকা মেঘগুলোকে যদি সময়ের আগেই কৃত্রিমভাবে ঘনীভূত করা যায় তাহলে তৎক্ষণাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। ক্লাউড সিডিং মূলত এই কাজটাই করে। বিমান, রকেটের সাহায্যে মেঘের উপর ড্রাই আইস (জমাটবাঁধা কার্বন ডাইঅক্সাইড), সিলভার আয়োডাইড, পটাসিয়াম আয়োডাইড, তরল প্রোপেন গ্যাস, এমনকী পটাসিয়াম ক্লোরাইড (লবণ) ছড়িয়ে দিলে তা মেঘগুলোকে দ্রুত ঘনীভূত হতে সহায়তা করে এবং যার ফলে বৃষ্টি শুরু হয়। একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বৃষ্টির পাশাপাশি কৃত্রিম তুষারপাত ঘটানো হয়।
ক্লাউড সিডিং আবিষ্কর্তা
মেঘের মধ্যে তরল কার্বন ডাইঅক্সাইড ছড়িয়ে দিলে বৃষ্টিপাত হতে পারে— এমন ধারণা প্রথম দিয়েছিলেন জার্মান-আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার লুইস গথম্যান, ১৮৯১ সালে। পরবর্তীতে ১৯৩০-এর দশকে তিন ইউরোপীয় বিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়েগনার, টর বার্গনর ও ওয়াল্টার ফিনডেসেন শীতল মেঘের মধ্যে বরফের স্ফটিক ছড়িয়ে দিয়ে কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের কথা বলেন, যার একটি তাত্ত্বিক রূপরেখাও দেন।
ইতিহাস অনুযায়ী ‘ক্লাউড সিডিং’ প্রথম আবিষ্কর্তা মার্কিন রসায়নবিদ ভিনসেন্ট শায়েফার। তাঁকেই ক্লাউড সিডিং-এর জনক বলা হয়। প্রথম কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের সফল ব্যবহারিক প্রয়োগ তিনি করেছিলেন ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিকের গবেষণাগারে।
সেই বছরেই শায়েফার এবং আরেক নোবেলজয়ী মার্কিন বিজ্ঞানী আরভিং ল্যাংমুর মিলে নভেম্বর মাসে বার্কশায়ারের পাহাড়ি এলাকায় ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে সফলভাবে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটাতে সক্ষম হন। যা মানব ইতিহাসে প্রথম যুগান্তকারী অধ্যায়। আসলে ওই তিন ইউরোপীয় বিজ্ঞানীর দেওয়া রূপরেখাটিকেই প্রমাণ করেছিলেন শায়েফার এবং ল্যাংমুর। আশ্চর্যের বিষয় হল এটাই যে, শায়েফারের রসায়নবিদ্যায় কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিই ছিল না। কোনওদিন হাইস্কুলের গণ্ডি পেরোননি তিনি।
ক্লাউড সিডিং-এর সীমাবদ্ধতা
বর্তমানে ক্লাউড সিডিং করানোর জন্য সিলভার আয়োডাইডই সবচেয়ে বেশি কার্যকর। যদিও বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ রয়েছে, যে, এই পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে প্রতিবেশী দেশগুলিতেও জলবায়ু পরিবর্তন ঘটতে পারে। নষ্ট হতে পারে পরিবেশের ভারসাম্য। ক্লাউড সিডিং-এর মাধ্যমে আবহাওয়ার অবস্থা পরিবর্তন করার ক্ষমতা সীমিত। মেঘের ধরন এবং বায়ুমণ্ডলের অবস্থা সম্পর্কিত কিছু শর্ত পূরণ করলে তবেই এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত সম্ভব। এই পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে এমনটা ভাবা ভুল হবে যে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে যখন-তখন বৃষ্টিপাত ঘটানো সম্ভব। নাসার জলবায়ু-বিষয়ক উপদেষ্টা গ্যাভিন স্মিডের মতে এত টাকা ব্যয় করে এই পদ্ধতির দ্বারা জলবায়ুর পরিবর্তন করার চেষ্টা করা খুব একটা লাভজনক এবং ফলপ্রসূ নয়।
থাইল্যান্ড ক্লাউড সিডিং : বর্তমানে বহু দেশ শস্য উৎপাদনে ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি কাজে লাগাচ্ছে। কৃষিক্ষেত্রে ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি ব্যবহার করার দৌড়ে সবার চেয়ে এগিয়ে থাইল্যান্ড। থাই সরকার ১৯৫৫ সাল থেকে সরকারিভাবে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানোর প্রকল্প চালিয়ে আসছে যা প্রধানত দেশটির বৃষ্টিনির্ভর শস্যগুলো রক্ষায় কাজে আসছে।
ইন্দোনেশিয়া : ২০২০-র জানুয়ারিতে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় প্রবল বর্ষণ ও ভূমিধসে ৩ দিনেই প্রায় ৪৩ জন মানুষ প্রাণ হারায়। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আশঙ্কা করা হয়েছিল আরও অন্তত দু’সপ্তাহ ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। ইন্দোনেশীয় সরকার সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমাতে দ্রুত যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার মধ্যে হল ক্লাউড সিডিং। দাবানলের হাত থেকে বাঁচতে ইন্দোনেশিয়া প্রায়ই ‘ক্লাউড সিডিং’ করে।
চিন : বিগত বছরে রকেটের মাধ্যমে বায়ুস্তরে সিলভার আয়োডাইড পাঠিয়ে কৃত্রিম বৃষ্টি তৈরি করেছে চিন। সমগ্র চিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ফসলের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। সেই কারণে কয়েকটি বিশেষ ভাবে চিহ্নিত এলাকায় কয়েক হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে কৃত্রিম বৃষ্টির ব্যবস্থা করছে চিন। খরার হাত থেকে বাঁচতে এমন ব্যবস্থা নিয়েছে তারা।
দুবাই : সংযুক্ত আরব আমিরশাহির বিজ্ঞানীরা ক্লাউড সিডিংয়ের মাধ্যমে বৃষ্টিপাত সম্পন্ন করেছিলেন। তবে তাঁরা ক্ষতিকর কেমিক্যালের পরিবর্তে ব্যবহার করেছিলেন ‘ইলেক্ট্রিক চার্জ’ যা অনেক জলবিন্দুকে এক করে বড়-বড় বৃষ্টির ফোঁটায় পরিণত করে। কারণ ওই দেশের জলবায়ুতে বড়-ফোঁটার বৃষ্টিপাত অত্যন্ত জরুরি। দুবাইয়ের মতো দেশেই ক্লাউড সিডিং প্রক্রিয়া সফল হওয়া সম্ভব। কারণ এই ক্লাউড সিডিং-এর জন্য মেঘ থাকা অত্যন্ত জরুরি। দুবাই-এর শুষ্ক জলবায়ুর কারণে এর ওপরে ভারী ভারী মেঘের আস্তরণ থাকে সবসময়। সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ১৯৯০-এর দশক থেকে ক্লাউড সিডিং শুরু করেছে এবং ২০১৯ সাল পর্যন্ত অন্তত পক্ষে ১৮৫ বার ক্লাউড সিডিং পদ্ধতি ব্যবহার করে আবহাওয়ার পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে।
আমেরিকা : মেঘ ভেঙে বড় ঝড় এবং সাইক্লোনের দাপট ঠেকাতে আমেরিকাও এই পদ্ধতির ব্যবহার করেছে।
আরও পড়ুন- পুতিনের সঙ্গে বৈঠক, তারপরই অসুস্থ বেলারুশ প্রেসিডেন্ট