সোজা কথাটা সহজিয়া শক্তিতে বলে দিয়েছেন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (CM Mamata Banerjee)।
ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে নয়, অপক্রিয়ার স্বরূপ উদঘাটনের প্রণোদনায়।
“চাকরি তো দেওয়া দরকার, খেয়ে নেওয়া নয়।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (CM Mamata Banerjee) সহজ-সরল জীবনের প্রতিভূ। কথার মারপ্যাঁচে নিজেকে আটকে রাখতে চান না কখনও। তাই, সত্যিটা একেবারে চাঁচাছোলা ভাষায় তাঁর মন্তব্য হয়ে ধরা দেয়। তাঁর উপলব্ধি তাতে বিম্বিত হয়। এটাই একশো শতাংশ মমতায়ানা। এটাই নির্বিকল্প মমতাবাদ।
আঁতেল সাজা ভণ্ড রামরেডদের জীবন জটিলতা সেই সহজিয়া সুরটা না পারে ধরতে, না পারে বুঝতে। তাই ওরা থেকে যায় ওপারে। বাংলা ওদের থেকে মুখ ফিরিয়েই থাকে। যেমনটা হল এই ডিসেম্বরের পড়ন্ত দিনেও।
২০২৩ সালের ১২ মে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ মামলার রায় ঘোষণা করেছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি বর্তমানে বিজেপির সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ সেই রায় বাতিল করে দিল কলকাতা হাইকোর্টেরই ডিভিশন বেঞ্চ। বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি ঋতব্রতকুমার মিত্র সুস্পষ্টভাবে জানালেন, ৩২ হাজার চাকরিপ্রার্থীর কাজ থাকছে।
বিচারপতিরা একবারও বলেননি, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়নি। কিন্তু সে-দুর্নীতি মিডিয়া ট্রায়ালে যেভাবে দেখানো হয়েছে, ঘণ্টাখানেকের কুমন আসরে যে ভঙ্গিতে, যেসব ইশারায় পরিবেশিত হয়েছে, আদতে ততটা ব্যাপ্তি তার ছিল না। ৩২ হাজার নিয়োগে ইডি, সিবিআই দুটি সংস্থার তদন্তে সর্বসাকুল্যে ২৯৪ জনকে গ্রেস নম্বর দেওয়া হয়ছিল বলে জানানো হয়েছে।
অর্থাৎ, দুর্নীতির অভিযোগ যেমন মিথ্যে নয়, তেমন তার বহর মোটেও বেশি নয়। ৩২ হাজারের ১ শতাংশও নয় ২৯৪। ১ শতাংশেরও কম নিয়োগ নিয়ে ধোঁয়াশা বিতর্কের কারণে ৩২ হাজার পরিবারকে বিপন্ন করাটা কি মানবিক! সিঙ্গল বেঞ্চ বলেছিল ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু তার সপক্ষে কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি কেউ। বরং, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ বারবার বলে এসেছে, দু-একটা ভুল প্রথমে হলেও পরে শুধরে নেওয়া হয়েছে। অবিশ্বাসের বাতাবরণ সৃষ্টিতে ব্যস্ত থাকায় সেকথায় কর্ণপাত করেনি অনেকেই। সেটা কি ঠিক হয়েছে?
এই জিজ্ঞাসা থেকেই ৩২ হাজার মানুষের চাকরি বাতিলের রায় বাতিল হয়েছে ন্যায়ের দরবারে। মিডিয়ার যে-অংশ রোজ রামরেডদের সান্ধ্যকালীন অধিবেশন বসায় চ্যানেলে চ্যানেলে, তারা এই রায়ে বেজায় বিপন্ন। ‘দাবি এক, দফা এক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (CM Mamata Banerjee) পদত্যাগ’ বলে যারা পথ দখলের রাজনীতিতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিল, সেইসব চিল শকুনরাও বিষাদগ্রস্ত। মুখ বাঁচাতে তারা বারবার একটা কথাই বলার চেষ্টা করছে। দুর্নীতির ওপরে মানবিকতাকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই এই রায়। দুর্নীতি যে দূরবিন দিয়েও দেখা যাচ্ছে না, অণুবীক্ষণ লাগছে, সেকথা বলছে না। এই সূত্রে আর একটি বিষয়ও আড়ালে চলে যাচ্ছে। কিছু মানুষের দুর্নীতির জন্য সকলের চাকরি কেড়ে নেওয়া যায় না, এটা যেমন ঠিক, তেমনই উচ্চ ন্যায়ালয়ের বিচারপতি তদন্তকারী আধিকারিকের ভূমিকায় নেমে ফেলুদা বা ব্যোমকেশ বক্সী সেজে তাঁর রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা পূরণ করবেন, সেটাও অনুচিত।
আরও পড়ুন-ঝাড়গ্রামে চন্দ্রিমার বার্তা, ভোটার তালিকা ও ‘দিদির দূত’ অ্যাপ নিয়ে গাফিলতি চলবে না
চাকরিখেকো বিচারপতি তাঁর আইন বিষয়ক লাল পার্টির গুরুর প্ররোচনাতেই সম্ভবত সেই কম্মোটিও করেছিলেন। ইন ক্যামেরা কোর্ট বসিয়ে দু-পাঁচ জনের সাক্ষ্য নিয়ে নাকি বুঝে গিয়েছিলেন, ইন্টারভিউ এবং অ্যাপটিটিউড টেস্ট ছাড়াই হাজার হাজার ব্যক্তির চাকরি হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজ্য দুর্নীতির সাগরে পরিণত হয়েছে, এই ভ্রান্ত ধারণা বাজারজাত করার জন্য একটা এরকম হাতিয়ারের দরকার ছিল। তাই, তাই-ই, রজ্জুকে সর্প হিসেবে দেখিয়ে বিচারকের আসনে বসে রাজনীতির লক্ষ্য পূরণের ব্যবস্থা হয়েছিল। ৩২ হাজার যুবক-যুবতীর জীবন জীবিকা বিপন্ন করে, রাজ্যের নামে কুকীর্তির অপপ্রচার চালিয়ে, সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে লুটেপুটে খাওয়ার আয়োজন হয়েছিল।
সংবাদ মাধ্যমের একাংশ এই সত্যটা চেপে রাখার জন্য, তারস্বরে সম্প্রচার করছে বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণ, ‘এত দিন চাকরি করেছেন ৩২ হাজার শিক্ষক। তাঁদের পরিবারের কথা ভেবে আদালত চাকরি বাতিল করছে না।’
কিন্তু মিঁউ মিঁউ করেও বলছে না, হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি ও বর্তমানে গেরুয়া পার্টির সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সেদিন কী করেছিলেন, সে কথা। সেদিন একদল অভিযোগ করেন, পর্ষদের নিয়ম অনুযায়ী, পরীক্ষার্থীদের ইন্টারভিউয়ের সময় তাঁদের ‘অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট’ নেওয়ার কথা। কিন্তু, বহু ক্ষেত্রেই সেই ‘অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট’ নেওয়া হয়নি। উপরন্তু কিছু জনকে আবার বেশি নম্বর দেওয়া হয়েছে। এরপরেই লৌহ বাসরে ছিদ্রের খোঁজ পেয়ে বিচারপতি গোয়েন্দাপ্রবরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বিচারকার্য ফেলে রেখে তদন্তে নামেন, যেটা তাঁর এক্তিয়ার-বহির্ভূত কর্ম। বিভিন্ন জেলায় যাঁরা পরীক্ষার্থীদের ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন, তাঁদের তলব করে গোপন জবানবন্দি নথিবদ্ধ করেন প্রাক্তন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় আর তার ভিত্তিতেই চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেন। তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘এই পুরো নিয়োগপ্রক্রিয়া কলুষিত। দুর্গন্ধে ভরা। প্রচুর বেকার যুবক চোখের জল ফেলছে এই দুর্নীতির কারণে, তাই সাংবিধানিক আদালত চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না।’
এবার এঁরা কী বলবেন? স্বীকার করবেন তো, সেদিন তাঁদের বোঝায় ভুল ছিল না, বোঝানোয় ইচ্ছাকৃত গলদ ছিল। প্রায় ত্রুটিশূন্য একটা প্রক্রিয়াকে ‘কলুষিত, দুর্গন্ধে ভরা’ বলে প্রতিষ্ঠিত করার তাড়নায় তাঁরা সেদিন তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে, চাকরি খেয়ে, ‘ভগবান’ সেজে রাক্ষসের ভূমিকা পালন করতে ইতস্তত করেননি। অভিজিৎ পরবর্তীকালে নিজমুখেই স্বীকার করেছেন, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একটাই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপসারণ। সেই উদ্দেশ্য পূরিত হবে ভেবেই তিনি লাল জামা ছেড়ে গেরুয়া খাতায় নাম লিখিয়েছেন। আর তারও আগে নানা দুরভিসন্ধিমূলক রায়দানের মাধ্যমে রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে একটা অস্থিরতা তৈরির চেষ্টায় মেতেছিলেন। বিকাশ উকিলের পার্ষদবৃন্দ অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে তাঁকে মদত জুগিয়ে গিয়েছেন। এবার কী হবে এঁদের? জনতার দরবারে ওঁদের অপদস্থ হওয়াটা এখন বোধহয় সময়ের অপেক্ষামাত্র।
পরিশেষে, এইসব চিল-শকুনের উদ্দেশ্যে একটাই কথা— হে সুপ্রিয় কৃতঘ্নের দল! ন্যায়ালয়ে পর্যুদস্ত হওয়ার পর ছুঁড়তে শুরু করুন আপনাদের তীক্ষ্ণ তির, অশ্রাব্য মিথ্যে আর প্রতিহিংসার বুলেট। কিন্তু আকাশে ওড়াওড়ি বন্ধ করে ডানা আপনাদের গোটাতেই হবে। কারণ, এখনও মাটির বুকে জেগে আছেন এক অতন্দ্র প্রহরী, আশার মশাল হাতে। নাম তাঁর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আগামীর অনিবার্য উচ্চারণ ওই নামটাই।
এখনও গৈরিক মিথ্যা দানব খেতে পারেনি আমাদের তাবৎ সঞ্চয়। অর্গল ভেঙে হীনবলের দল লাল কিংবা গেরুয়া পোশাকে গিলতে পারেনি বাংলার যাবতীয় গৌরবের রূপ। এখনও অখণ্ড বিশ্বাসে জেগে আছে একটা উচ্চারণ। ‘সত্যমেব জয়তে’।

