আজ সেই লেখিকার কথা বলব যিনি তাঁর লেখা দিয়ে মুহূর্তে ছুঁয়েছিলেন স্বপ্নকে। যার বই থেকে রয়্যালটি বাবদ প্রথম আয় হয়েছিল মাত্র ৩০ ডলার। যা তাঁর জলের বিল মেটানোর জন্যই শুধু যথেষ্ট ছিল। শুরুতে না ছিল কোনও প্রকাশক, না ছিল এজেন্ট এমনকী ছিল না কোনও মার্কেটিং স্ট্রাটেজিও— যা একটি বইকে তথাকথিত বেস্টসেলারের তালিকায় যুক্ত করতে পারে। কিন্তু তাঁর কাছে ছিল অগুনতি পাঠকের ভালবাসা যা তাঁকে ২০২৪ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘বেস্ট সেলিং’ ঔপন্যাসিকের তকমা এনে দিয়েছে। সেই লেখিকা হলেন কোলিন হুভার (Colleen Hoover) বা তাঁর পাঠককুলের কাছে অতি-পরিচিত ও জনপ্রিয় কোহো।
তিনিই এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘বেস্ট সেলিং’ ঔপন্যাসিক। বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় অন্যান্য খ্যাতনামা যেসব লেখকের একাধিক বই রয়েছে, তারাও হুভারের মতো এত বেশি পাঠক পায়নি। শুধু জনপ্রিয় বললে ভুল বলা হবে, এতটাই জনপ্রিয় যে জেমস প্যাটারসন এবং জন গ্রিশাম-এর মতো বিখ্যাত দু’জন লেখকের বিক্রি হওয়া বইয়ের সংখ্যা যোগ করলেও তা এই লেখিকার বিক্রি হওয়া বইয়ের সমান হতে পারবে না। গত তিন বছরে হুভার যেভাবে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছেন তা ঠিক যেন স্বপ্নের মতো। টিকটকের একটি সাহিত্য সম্প্রদায় আছে,যার চলতি নাম বুক টক! এই বুক টকে কোলিন হুভারেরই জয়জয়কার। বুক টকের সুপারিশে কোলিনের নাম ছড়িয়েছে সর্বত্র— তাই তো যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমস সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া পেপারব্যাক ফিকশন বা পেপারব্যাক সংস্করণে প্রকাশিত উপন্যাসের যে তালিকা বানায় সেই তালিকায় সেরা ১০টি বইয়ের মধ্যে হুভারেরই বই রয়েছে একটা বা দুটো নয়, মোট ছ’টি। এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে ২০১৬ সালে প্রকাশিত তাঁর ইট ‘এন্ডসউইথ আস’ নামক বইটি— যার প্রায় তিন মিলিয়ন কপি সারা পৃথিবীতে বিক্রি হয়েছে। বেস্ট সেলারের তালিকায় একজন লেখকের এতগুলি বই থাকা অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার। শুধুমাত্র ২০২২ সালেই তাঁর বই বিক্রি হয়েছে ৮.৬ মিলিয়ন। ‘এনপিডি বুকস্ক্যান’-এর হিসাব অনুযায়ী, এই সংখ্যা বাইবেলের চেয়েও বেশি। বুক টক-এ তার কাজ সংক্রান্ত আলোচনা নিয়ে প্রায় ৪৪ মিলিয়নেরও বেশি পোস্ট রয়েছে এবং গুডরিডসে যে সকল লেখকদের ফলো করা হয় তাদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানাধিকারিণী।
কলিনের (Colleen Hoover) জন্ম ১১ ডিসেম্বর, ১৯৭৯ সালফার স্প্রিংস, টেক্সাসে। তাঁর যখন ২ বছর তখন এক রাতে বাবার চিৎকার শুনে জেগে উঠে দেখেছিলেন যে তাঁর মায়ের দিকে টেলিভিশন ছুঁড়ে মারছেন বাবা আর আঘাত পেয়ে মা মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন। এর কিছুদিন পরই তাঁর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। পরবর্তীতে হুভার জানতে পারেন, তাঁর বাবা মদ্যপ ছিলেন এবং মাকে নির্যাতন করতেন। এরপর হুভারের যখন ৪ বছর বয়স তখন তাঁর মা আবার বিয়ে করেন। সেই জীবনের অভিজ্ঞতাই কিন্তু ‘ইট এন্ডস উইথ আস’-এর পরতে পরতে লিলির জীবনের মাধ্যমে পাঠকের সামনে তিনি তুলে ধরেছেন। একজন লেখক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করার আগে তিনি ছিলেন সমাজকর্মী এবং শিক্ষক। পেশাজীবনে একজন সমাজকর্মী হিসেবে তিনি ঘণ্টায় ৯ ডলার আয় করতেন। ২০১১ সালের নভেম্বরে হুভার প্রকাশের কোনও ইচ্ছা ছাড়াই তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘স্ল্যামড’ লেখা শুরু করেন। বইটা ছিল প্রাপ্তবয়স্ক তরুণদের জন্য লেখা উপন্যাস। ভাবতে অবাক লাগে ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে হুভার নিজ উদ্যোগে উপন্যাসটি প্রকাশ করেছিলেন যাতে তার মা উপন্যাসটি পড়তে পারেন। সেই থেকে যাত্রা শুরু। প্রথম প্রকাশিত সেই বইয়ের রয়্যালটি হিসেবে শুরুতে ৩০ ডলার পেয়ে তিনি খুবই খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু ৭ মাস পর তাঁর ওই উপন্যাস নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলারের তালিকায় জায়গা করে নেয়। সে বছর গ্রীষ্মের আগেই তাঁর আরো দুটি বই বেস্ট সেলার তালিকায় স্থান পায়। অন্য বইটি ছিল স্ল্যামড-এর সিক্যুয়েল, যার নাম ‘পয়েন্ট অফ রিট্রিট’। এরপর তিনি পেশা ছেড়ে দিয়ে একজন ফুল টাইম লেখক হিসেবে লেখালেখি শুরু করেন।
আরও পড়ুন-অন্তঃপুর থেকে আন্তর্জালে প্রেম
সাধারণত বিখ্যাত লেখকরা যে কোনও নির্দিষ্ট কোনও ঘরানাকে কেন্দ্র করে বই লেখেন। কিন্তু হুভার সেই ছক ভেঙে অন্য পথে হেঁটেছেন। তাঁর লেখায় বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক, সমসাময়িক বিষয় উঠে এসেছে। যেমন প্রেম, সাইকোলজিকাল থ্রিলার, মাদকাসক্তি, গৃহহীনতা এবং দারিদ্র ইত্যাদি। তাঁর বইগুলিকে তাই বিশেষ কোনও শ্রেণিতে ফেলা যায় না। হুভার কিন্তু কোনও একটি মাত্র ঘরানাকে কেন্দ্র করে নিজের ব্র্যান্ড তৈরি করেননি। বিভিন্ন ঘরানাতেই নিজের সৃষ্টিশীলতা ছড়িয়েছেন। তাই কলিং হুভার আজ নিয়েই স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ব্র্যান্ড। কলিন তাঁর নিজের দায়িত্ব তিনি নিজেই নিয়েছেন। কোনও ধরাবাঁধা প্রকাশকদের সঙ্গে যুক্ত থাকেননি।
হুভারের অনেক বই অনেক আগে প্রকাশিত হয়েছিল। এখন সেসব বেস্ট সেলারের তালিকায় জায়গা করে নিচ্ছে। প্রকাশনা জগতে এমন ঘটনা বিরল।
সোশ্যাল মিডিয়া আজ প্রত্যেকটি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে হুভারও তার ব্যতিক্রম নন, তিনি অত্যন্ত সুচারুভাবে সোশ্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়েছেন। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর ৩.৯ মিলিয়ন ফলোয়ার আছে। সেখানে তিনি বিভিন্ন বিষয়ের ভিডিও প্রকাশ করে দর্শক ও শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছেন। তাছাড়া সময়ও যেন তাঁর পক্ষেই ছিল। লেখক জীবনের শুরু থেকেই তাঁর অনেক ভক্ত থাকলেও ঠিক মহামারীর সময়ই তাঁর বইয়ের বিক্রি অনেক বেড়ে যায়। কারণ এ সময়ে সামাজিক মাধ্যম টিকটক-এ তাঁর বই পাঠকদের মাঝে সাড়া জাগায়। এখন পর্যন্ত #colleenhoover হ্যাশট্যাগ-এর ভিউ সংখ্যা ২.৪ বিলিয়নের চেয়েও বেশি। এই লেখিকা কিন্তু তাঁর ভক্তদের প্রাধান্য দিতে পিছপা হন না। প্রতিবছর ‘বুক বোনানজা’ নামের একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেন, যা মূলত তাঁর লেখা রোমান্স ঘরানার উপন্যাসের পাঠকদের সঙ্গে দেখা করার জন্য এক বুক সাইনিং অনুষ্ঠান। এই দিন পাঠকদের সঙ্গে তিনি দেখা করেন এবং এই অনুষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত অর্থ তিনি দান করেন। কোহর্টস-দের কাছে হুভারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হচ্ছে ধর্মীয় তীর্থযাত্রায় যাওয়ার মতো একটা বিষয়।
হুভার নিজের প্রথম বই নিজে প্রকাশ করার মাধ্যমে তাঁর লেখকজীবন শুরু করলেও ধীরে ধীরে যখন তাঁর বই প্রচুর বিক্রি হওয়া শুরু করল, প্রকাশকদের কাছে হুভারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে লাগল আর তখন হুভার, জেন ডিস্টেল নামের একজন লিটেরারি এজেন্টের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেন ও অ্যাট্রিয়া প্রকাশনীর কাছে তাঁর প্রথম ২টি উপন্যাসের স্বত্ব বিক্রি করলেন। অ্যাট্রিয়া প্রকাশনী তাঁর তৃতীয় বইটির স্বত্ব কিনতে চাইলেও হুভার তাঁর তৃতীয় বই নিজেই প্রকাশ করার স্বাধীনতাটুকু চেয়েছিলেন। সেই ভাবনা অনুসারে পরে নিজেই প্রকাশ করেন। এই বই-ই নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর বেস্ট সেলারের তালিকার প্রথম স্থান দখল করে নেয়। অ্যাট্রিয়া অবশ্য পরে গিয়ে এই বইটির স্বত্বও কিনে নেন।
হুভার (Colleen Hoover) নিজে কখনও ভাবেননি তিনি একজন বেস্ট সেলিং লেখক হবেন। তাই তাঁর জীবনে যে সাফল্য এসেছে তা নিয়ে তিনি ভীষণ খুশি। তবে তিনি তাঁর সাফল্য নিয়ে একথাও ভাবেন যে এইসব খ্যাতি একদিন তো শেষ হয়েই যাবে, তাই তিনি এই খ্যাতি শেষবিন্দু অবধি উপভোগ করতে চান। তিনি তাঁর এই সাফল্য উপভোগ করুন আর পাঠকগণের কাছে আরও অনেক বেস্টসেলিং উপন্যাস উপহার দিতে থাকুন এই আশাটুকুই রইল।