সিপিআই (এম) তার দলের কর্মীদের নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টিও তো আকাশ থেকে পড়া কোনও বস্তু নয়। এই সমাজ থেকেই উদ্ভূত একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সুতরাং সমাজের কাছে তারও কিছু দায় আছে— তারও কিছু জবাব দেওয়ার থাকে।
অজন্তা বিশ্বাসের শাস্তির প্রশ্নেই কথাটি সামনে এসেছে। অজন্তার লেখাতে যেমন ফুলরেণু গুহ আছেন, আছেন কনক মুখোপাধ্যায়ের মতো কংগ্রেস বা কমিউনিস্ট নেত্রীরা, তেমনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা আছে। যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখিকা সিঙ্গুর আন্দোলনকে দেখিয়েছেন, তাতে সিপিআই (এম)-এর আপত্তি আছে। ফলে শাস্তি পেতে হবে। বিগত ১০ বছরে বাংলার রাজনীতির সাধারণ ইতিহাস লিখতে গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাদ দিয়ে কে লিখতে পারবেন আমার জানা নেই।
আরও পড়ুন: শিল্প সংক্রান্ত সব সমস্যার সমাধানের আশ্বাস পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের
সমস্যা হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বারা ঘোষিত যে কোনও জনমুখী কর্মসূচিকে নিয়ত বিদ্রুপ করে থাকেন সিপিআই (এম) নেতারা। সেটা খাদ্যসাথী, স্বাস্থ্যসাথী, ছাত্রদের ক্রেডিট কার্ড, দুয়ারে রেশন, দুয়ারে সরকার— যা-ই হোক না কেন, কোনও অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে একটা তাত্ত্বিক আলোচনা তাঁরা ফেঁদে বসেন। মা-বোনেদের মাথার ওপর দিয়ে তা বেরিয়ে যায়— তাঁরা গিয়ে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের সামনে লাইন দেন। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের জনমুখী কর্মসূচির সমালোচনা করার ফলে মানুষ যে ক্রমেই সঙ্গছাড়া হচ্ছে সেটা তাঁদের খেয়াল আছে বলে মনে হয় না।
ওদিকে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিবিদদের মধ্যে নিয়মিত লেখালেখির অভ্যাস খুব কম। মহাত্মা গান্ধীর রচনাবলি ১০০ খণ্ড পার হয়েও শেষ হয়নি। লেনিন সাহেব তাঁরও বেশি। এই দু’জনের কথা আগে বললাম কারণ, এঁরা কেবল লেখেননি। দেশটাও পাল্টে দিয়েছেন। সুভাষ বোসের রচনাভাণ্ডার বিশাল। ইএমএস নাম্বুদিরিপাদের রচনাবলি মালায়ালি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে ১০০ খণ্ডে। তিনিও একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর প্রকাশিত পুস্তকসংখ্যা ১১৫টি ছাপিয়ে গেছে।
তাহলে যারা সি পি আই এম করেন, তাঁরা নিজ দলের মুখপত্র ছাড়া আর কোথাও লিখতে পারবেন না?
মনে পড়ছে, একবার ‘দেশ’ পত্রিকায় দীর্ঘ ইন্টারভিউ দিলেন তৎকালীন সিপিআই (এম) রাজ্য সম্পাদক । শুধু তাই নয় সে-বছরই ‘দেশ’ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় প্রবন্ধ লিখলেন তিনি। তিনি অনিল বিশ্বাস। পার্টি মহলে হইচই পড়ে গিয়েছিল। একটা ‘বুর্জোয়া’ সাময়িকীতে পার্টির রাজ্য সম্পাদক কেন লিখবেন এই প্রশ্নে। গোপনে কী হয়েছিল তা জানি না, প্রকাশ্যে অনিল বিশ্বাসকে শাস্তি পেতে হয়নি। তবে আর তিনি লেখেননি। জ্যোতি বসুও দীর্ঘ ইন্টারভিউ দিলেন ‘দেশ’ পত্রিকায়। পার্টির মধ্যেকার অন্তর্বিরোধও তিনি সেই কথপোকথনে বলেছিলেন। তখন সিপিআই(এম) নেতাদের একটা অংশ বলতে থাকেন— সুযোগ পেলে তাঁরাও লিখবেন। আবার খোলসে ঢুকে গেল সব। বাইরে লেখা বন্ধ।
সিপিআই(এম)-এর দিল্লির নেতারা এ ব্যাপারে খানিকটা বোধ হয় অন্য মত পোষণ করেন। একসময় সীতারাম ইয়েচুরি একটি ইংরেজি দৈনিকে নিয়মিত ‘লেফটহ্যান্ড ড্রাইভ’ বলে কলাম লিখতেন। অবশ্য তার অন্যতম কারণ পার্টির সাপ্তাহিত ‘পিপলস ডেমোক্র্যসি’তে তাঁর কোনও লেখা ছাপা হত না। সাপ্তাহিক কাগজটি প্রকাশ কারাতদের দখলে ছিল। ‘দি হিন্দু’ কাগজে নিয়মিত লিখছেন প্রকাশ কারাত, বৃন্দা কারাত, সুভাষিণী আলি। সেখানে অবশ্য সীতারামের প্রবেশ নিষিদ্ধ। প্রভাত পট্টনায়ক নিয়মিত লিখছেন কলকাতার ‘টেলিগ্রাফ’ দৈনিকে। কোনও কাগজই কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির কাগজ নয়। এগুলো কোনও পার্টির কাগজও নয়। কিন্তু সিপিআই(এম)-র কথায় এগুলো সব ‘বাজারি’ কাগজ। ‘বুর্জোয়া’ কাগজ। এখানে লেখা যাবে। আর ‘জাগোবাংলা’য় লিখলে অজন্তা সাসপেন্ড হবেন? আসলে সিপিআই(এম) এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকে না— হাঙর ঢাকতে চেষ্টা করে। ফল মাথা ঢাকে তো পা উদোম হয়ে যায়। দিশেহারা, পালফাটা নৌকা নিয়ে যাত্রা করেছেন নেতারা। তীর নয় খড়কুটোর সন্ধানে।
আরও পড়ুন: বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বনির্ভরতার পথে রাজ্য, জানালেন অরূপ
সিপিআই(এম)-র ব্যাপারস্যাপারই এইরকম। যাকে দেখতে পারবেন না তাঁকে হয় গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা না মানা, পার্টির নির্দেশ না মানা অথবা অন্য কোনও অজুহাতে তাড়ানো হবে। সাইফুদ্দিন চৌধুরি বা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় তার প্রমাণ। এঁদের তুলনায় অজন্তা খুব ছোট একজন অধ্যাপিকা। কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে , সম্ভবত তাঁর পিতৃ পরিচয়ের জন্য। তিনি কিছু সত্যি কথা লিখে ফেলেছেন। ‘জাগোবাংলা’য় কেন লিখেছেন, এটা একটা ছুতো। আসলে লেখার মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা কেন করা হয়েছে এবং যেটা সত্যি, সেটার জন্যই শাস্তি। কোনও দল যদি কূপমণ্ডূক হয়ে থাকতে চায় তা হলে কারও কিছু বলার নেই। করারও নেই। তবে অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।
হঠাৎ মনে পড়ছে বিজেপি নেতা, প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী প্রয়াত যশবন্ত সিনহা মহম্মদ আলি জিন্নার ওপর বই লিখে, কয়েকটি স্বাধীন মতামত দিয়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। দলের সভায় সিমলায় গিয়ে তাঁকে ঘাড়ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল। অজন্তা বিশ্বাসকে শাস্তির মুখে ফেলে, বিজেপি এবং সিপিআই(এম) আর একবার নিজেদের এক আসনে বসিয়ে ফেলল।