চৈত্র সেল আসলে বর্ষশেষের স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল। লাল পার্টির (CPM) স্টক ফুরিয়ে গিয়েছিল এক যুগ আগেই। রাজ্যের শাসক পক্ষ শাসন ক্ষমতা হারানো মাত্রই তাঁদের বিধায়ক সংখ্যা শূন্য। আর এক যুগ পর, দেখা গেল, বামফ্রন্টেরই একটি পার্টি রাজ্য দলের মর্যাদাও খুইয়েছে।
এমতাবস্থায়, দহন জ্বলায় জ্বলতে থাকা চৈত্রে জগাই-মাধাই-গদাই-রা সব একযোগে হুক্কা-হুয়া রবে আকাশবাতাস অস্থির করে তুলেছে। ভাব খানা এমন যেন রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে বিগত বারো বছরে ভয়ানক একটা বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে।
কিন্তু কমরেড! স্মৃতির ঝাঁপি যদি খুলে বসি একবার, তবে যে পালাবার পথ পাবেন না, সে-কথা কখনও ভেবে দেখেছেন?
বামাচারী তান্ত্রিকের রক্তবর্ণ পোশাকে সজ্জিত হয়ে প্রথম যখন সরস্বতীর শবাসনে নষ্ট-সাধন শুরু করেছিল, তখন বাংলার যুক্তফ্রন্ট শাসন। সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত তাঁর ‘তবু মনে রেখো…’ স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থে লিখেছেন সে-কথা।
অধ্যাপক হরপ্রসাদ মিত্র তখন হিন্দু হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট। হরপ্রসাদবাবু বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। সিপিএম হোস্টেলে একদল বাইরের ছেলেকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তারা হোস্টেলের পশ্চিম দিকের একতলার ঘরে বোমা আর অ্যাসিড বাল্ব বানাত। খাদ্য আন্দোলনের উত্তেজক মুহূর্তে ওইসব বোমা আর বাল্ব ব্যবহার করা হত। হরপ্রসাদ মিত্র এসব সহ্য করতে রাজি ছিলেন না। তিনি চাইলেন বহিরাগতদের হোস্টেল থেকে বের করে দিতে। সিপিএম-এর মদতপুষ্ট সেই উচ্ছৃঙ্খল ছাত্ররা হরপ্রসাদবাবুর কোয়ার্টারের দরজায় বাইরে থেকে তালা দিয়ে দিল।
এখানেই তাদের কীর্তি শেষ নয়।
হরপ্রসাদবাবুদের কুশপুতুল পোড়ানো হল বাইরে। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। চলছে রাজনৈতিক স্লোগান। তারই মাঝখানে একদন ছাত্র, যাদের বয়স ১৮ থেকে ২০, তারা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে প্রস্রাব ত্যাগ করে সেই কুশপুতুলের আগুন নেভাল। ‘যুগান্তর’ সে-সময় পুরো ঘটনাটার রিপোর্ট করেছিল।
প্রেসিডেন্সির তদানীন্তন অধ্যক্ষ ড. সনৎ বসু। তিনি হিন্দু হোস্টেলের কয়েকজন ছাত্রকে এই ঘটনার জেরে বহিষ্কার করলেন। গভর্নিং বডির সুপারিশেই তাঁর এই পদক্ষেপ। প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হল প্রেসিডেন্সিতে। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সিঁড়ির কাছে ঘেরাও করা হল সনৎবাবুকে। পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলল সেই ঘেরাও কর্মসূচি।
গভর্নিং বডির জরুরি মিটিং বসল সন্ধেয়। বাইরে থেকে ঢুকে পড়ল বামপন্থী ছাত্ররা। গভর্নিং বডির সদস্যদের রাত একটা পর্যন্ত ঘেরাও করে রাখল তারা। মুখ্যমন্ত্রী তখন প্রফুল্লচন্দ্র সেন। পুলিশ লাঠিচার্জ করে গভর্নিং বডির সদস্যদের ঘেরাও মুক্ত করল।
এই ঘটনার কয়েক মাস পর ভোটে ক্ষমতায় এল প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার। ক্ষমতায় এসেই বামপন্থীরা ড. সনৎ বসুকে চাপ দিতে শুরু করল, ওই বহিষ্কৃত ছাত্রদের ওপর থেকে বহিষ্কারের আদেশ প্রত্যাহার করতে হবে। সনৎবাবু সেই চাপের কাছে নতিস্বীকার করলেন না। ১৯৬৯-এ দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতাসীন হল। হওয়া-মাত্র সনৎবাবুর ওপর ফের চাপ সৃষ্টি করা শুরু হল। ১৯৬৯-এর এপ্রিলে সনৎবাবু রাইটার্স বিল্ডিংয়ে তাঁর পদত্যাগপত্রটি পেশ করলেন। কিন্তু ছাত্রদের বহিষ্কারের আদেশ প্রত্যাহার করলেন না।
আরও একটি ঘটনা।
মুখ্যমন্ত্রী তখন জ্যোতি বসু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সন্তোষ ভট্টাচার্য। শিক্ষা দফতরের সচিব তখন ড. অশোক চট্টোপাধ্যায়।
গোপনসূত্রে অশোকবাবু জানতে পারলেন বঙ্গেশ্বরের একমাত্র পুত্রের জ্যেষ্ঠ কন্যার কয়েকজন সহপাঠিনীকে ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। অশোক জয়েন্ট এন্ট্রাস পরীক্ষায় দু-তিন বছর আগেকার রেকর্ড দেখতে চাইলেন। দেখলেন ১৯৮৪-’৮৫-র পরীক্ষার্থীদের রোল নম্বরের রেকর্ডে বেশ কিছু রোল নম্বরের পাশে ত্রিভুজ আঁকা কিংবা যোগচিহ্ন বসানো।
কেন এরকম? কারণ জানতে চাইলেন ড. অশোক চট্টোপাধ্যায়। কোনও সদুত্তর পেলেন না। তখন উচ্চশিক্ষা দফতরের সচিব হিসেবে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা পরিচালনকারী কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিলেন এরপর থেকে যেন রোল নম্বরের তালিকায় কোনও নম্বরের পাশে কোনও সাংকেতিক চিহ্ন না থাকে। সব রোল নম্বর যেন একইরকম থাকে। সেই নির্দেশ মেনে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা হল ১৯৮৮ পর্যন্ত।
জুলাই, ১৯৮৮-তে ড. চট্টোপাধ্যায় তাঁর দফতরে পৌঁছে দেখতে পেলেন একটা মুখবন্ধ খাম তাঁর টেবিলে পড়ে আছে আর তাতে ‘Extra Urgent’ কথাটা লেখা। খাম খুলে অশোক জানতে পারলেন। তাঁকে পশুপালন দফতরের সচিব পদে বদলি করা হয়েছে।
অশোকবাবু সরাসরি জ্যোতিবাবুর কাছে জানতে চাইলেন, ‘‘স্যার, গতকাল সন্ধে সাতটা পর্যন্ত আপনার সঙ্গে কাজ করেছি, কই, আপনি তো একবারও বলেননি যে আমাকে সেক্রেটারি নিয়ে কাজ করতে আপনার অসুবিধা হচ্ছে, আর, আপনি এ-কথাও জানাননি যে আমাকে আপনি আর সেক্রেটারি পদে চান না।’’ জ্যোতিবাবু কোনও উত্তর দিতে পারেননি। বলেছিলেন, ‘‘আমার তো কোনও অসুবিধা হয়নি কখনও, কিন্তু ওরা সবাই কী সব বলছিল, তাই এই সব…।’’
এই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত লিখেছেন, ড. অশোক চট্টোপাধ্যায়কে উচ্চশিক্ষা দফতরের সেক্রেটারির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য হল, ‘জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় রোল নম্বরের কারচুপি আবার ফিরিয়ে আনা’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমি একজন খবরের কাগজের রিপোর্টার হিসেবে ওই অফিসারের কাছে চিরকৃতজ্ঞ যে এই রাজ্যের একটা সাংঘাতিক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ফলাফল রোল নম্বরের কারচুপির দ্বারা কতটা প্রভাবিত করা যায় সেই জঘন্য মার্কসবাদী কৌশলটি ধরে ফেলেছিলেন।’
এ-সব কথা আলোচিত হলে একটাই প্রবাদ মস্তিষ্কের কোটরে ঘুরপাক খেতে থাকে— ‘শ চুহে খাকে বিল্লি হজ কো চলি’।
আরও পড়ুন:রাজ্য সভাপতির সামনেই দলের নেত্রীকে খুনের চেষ্টার অভিযোগ