সিত্রাং-এর (Cyclone Sitrang) অর্থ গাছের পাতা। আসন্ন ঘূর্ণিঝড়ের নাম। যেসব ঘূর্ণিঝড়ের (Cyclone Sitrang) গতিবেগ ঘণ্টায় ৭৪ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায় তাদের জন্যই বিশেষ নাম বরাদ্দ করা হয়। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিকাল অর্গানাইজেশনের আওতায় ১১টি সতর্কতা কেন্দ্র এখানে একটি প্রক্রিয়া চালু করেছে যার দ্বারা বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঝড়ের নামের তালিকা গ্রহণ করা হয়। প্রয়োজনমতো প্রস্তাবিত এই নামগুলির থেকে বেছে নেওয়া হয় একটি। ভারত মহাসাগরের উত্তরাঞ্চলে উদ্ভূত ট্রপিক্যাল সাইক্লোনের নামের তালিকা আঞ্চলিক কমিটির কাছে পাঠানোর দায়িত্ব রয়েছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মায়ানমার, ওমান,পাকিস্তান এবং থাইল্যান্ডের উপর। সম্প্রতি এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে ইরান, কাতার, সৌদি আরব, ইয়েমেন এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি।
সিত্রাং (Cyclone Sitrang) ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ
থান্ডারস্ট্রম (সেল) বা বজ্রঝড়ের উৎপত্তিতে একটি তাপগতির উৎস বায়ুমণ্ডলের যে কোনও জায়গায় (জল, স্থল, পাহাড় ইত্যাদি) মাত্র ১০ কিলোমিটার ব্যাসের হলেই সম্ভব। এক্ষেত্রে, পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির জন্য উৎপন্ন বল-এর (কোরিওলিস ফোর্স) কোনও সহায়তার প্রয়োজন নেই। কোনও বিশেষস্থানে এর স্থায়িত্ব একঘণ্টা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থান্ডারস্ট্রম সেলের গতিপথ প্রস্থে ৫০ কিলোমিটার ও দৈর্ঘ্যে ৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। থান্ডারস্ট্রম সেল একটি মাত্র ঊর্ধ্বগতি সম্পন্ন মেঘবলয় আবৃত থাকে। আর নিম্নগতি সম্পন্ন মেঘ ও বৃষ্টি চতুর্দিকে অথবা বজ্রঝড়ের গতিপথের দিকে হয়। এই কারণে বজ্রঝড়ের গতিপথ গণিতের সাহায্যে নির্ণয় করতে ‘গ্র্যাভিটি ওয়েভ সমীকরণ’ ব্যবহার করতে হয়।
নানা দেশে নানা নাম
ভারতে সাইক্লোন, জাপান, চিনে টাইফুন, ফিলিপিন্সে বাগুইও, অস্ট্রেলিয়াতে উইললি-উইলিস, নর্থ আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান আইল্যান্ড-এ হারিকেন।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণ
প্রথমত, যে কোনও সমুদ্রের ওপর বায়ুমণ্ডলে একাধিক তাপগতির উৎসস্থল থাকা একান্ত প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, কোরিওলিস ফোর্স-এর সহায়তা নিতান্ত প্রয়োজন। যেহেতু কোরিওলিস ফোর্স-এর পরিমাণ বিষুবরেখায় শূন্য এবং মেরুতে সর্বাধিক, সে কারণে ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তিস্থল বিষুবরেখা থেকে অন্তত ৫০০ কিলোমিটার দূরে আর সমুদ্রসমতলের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি হতে হবে। কেননা রৈখিক তাপগতিকে ঘূর্ণগতিতে পরিবর্তন করতে এই দুয়ের যুগলবন্দি একান্ত প্রয়োজন। নিরবচ্ছিন্ন তাপগতি অব্যাহত রাখার জন্য সমুদ্র গভীরতা ১৫০ ফুটের বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয়। সাধারণত সমুদ্রের ওপর গতিপথ প্রস্থ ৫০০ কিলোমিটারের বেশি আর দৈর্ঘ্যে অন্তত ২০০০ কিলোমিটার। স্থায়িত্ব ২-৩ দিনের বেশি।
আরও পড়ুন-দাদার সঙ্গে চরম অন্যায় হয়েছে ওকে পাঠানো হোক আইসিসিতে
নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়
একাধিক তাপগতির উৎসস্থল শৃঙ্খলাবদ্ধ হওয়া সময়সাপেক্ষ, সে জন্য এর অগ্রগতি খুব ধীরগতিতে হয়।
হালকা নিম্নচাপ : ৩০ কিমি প্রতি ঘণ্টা, নিম্নচাপ : ৩১-৪৫ কিমি প্রতি ঘণ্টা, গভীর নিম্নচাপ : ৪৬-৭৩ কিমি প্রতি ঘণ্টা, সাইক্লোন : ৭৪-১০০ কিমি প্রতি ঘণ্টা, ভয়ানক সাইক্লোন : ১০১-১৩৫ কিমি প্রতি ঘণ্টা, অতি ভয়ানক সাইক্লোন : ১৩৬-১৭০ কিমি প্রতি ঘণ্টা, চরম ভয়ানক সাইক্লোন : ১৭১-২২০। এরপরে আরও গতিবেগ বাড়িয়ে সুপার সাইক্লোন অবস্থাতে আসে।
ঘূর্ণিঝড়ের আকৃতি
বাস্তবে ঘূর্ণিঝড় একটি উলম্ব বিশাল গামলা আকৃতি মেঘবলয়ের সমষ্টি আর এক্ষেত্রে ঊর্ধ্বগামী মেঘবলয়ের স্তরের সংখ্যা, শক্তি অনুযায়ী একাধিক হতে পারে। একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত অঞ্চল (২০ কিমি ব্যাস)কে ঘূর্ণিঝড়ের আই (eye) বলে। এরই চারিদিকে মেঘবলয়টি আই ওয়াল যেখানে বায়ুর অনুভূমিক ঘূর্ণন গতি প্রায় শূন্য আর ঊর্ধ্বমুখী গতি অত্যাধিক। আই-এর অনুভূমিক গতি সাধারণত ৩০ কিমি প্রতি ঘণ্টা। এই গামলা আকৃতি মেঘবলয়ের শক্তি অনুযায়ী উচ্চতা ৮ থেকে ১৮ কিলোমিটারও হতে পারে। সর্বোচ্চস্থানে ঘন সিরাস মেঘের আস্তরণে আবৃত থাকে। যে কারণে পুরো FIR (ফ্লাইট ইনফরমেশন রিজিওন)-এর সমস্ত এয়ারপোর্টের উড়ান বন্ধ রাখা হয়।
জলোচ্ছ্বাস
সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ, ঘূর্ণন গতির সঙ্গে সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসের জন্যও হয়। মাঝারি আকারের সাইক্লোনে এই জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ৩০ ফুটের বেশি হতে পারে। আর ঘূর্ণিঝড়ের (eye) আই ওয়াল-এর কাছে যদি অমাবস্যার ভরা কোটাল বিন্দু [সাব মুন (স্যাটেলাইট)] হয় তাহলে এই জলোচ্ছ্বাস আরও ২০ ফুট বেশি হতে পারে। যা কিনা ঘূর্ণিঝড় আয়লাকে প্রলয় রূপ ধারণ করিয়েছিল ২৫ মে ২০০৯ সালে। সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ আজও ভুলতে পারেনি।
টর্নেডো
অন্যদিকে মেরুঅঞ্চলে তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা অনেক কম আর কোরিওলিস ফোর্স যথেষ্ট বেশি তাই বায়ুপ্রবাহের গতি তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি। এখানে মেরুপ্রবাহ, যা ভীষণ ঠান্ডা শুষ্ক আর ভারী বাতাসের সাথে সমুদ্রবায়ু যা অপেক্ষাকৃত গরম, আর্দ্র বাতাসের সংঘাতে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি করে। এই ঘটনাকে বায়ুমণ্ডলের তাপগতীয় ফ্রন্টাল ডাইনামিক্স বলে। কোরিওলিস ফোর্স ভীষণ বেশি হওয়াতে, খুব অল্প জায়গায় ভয়ানক শক্তিশালী মেরুঝড় উৎপন্ন করে। এই মরুঝড় প্রকারান্তরে এক্সট্রা ট্রপিকাল অঞ্চলে (ল্যাটিচুড ৩০ ডিগ্রি -৬০ ডিগ্রি) টর্নেডোর আকার ধারণ করে। ভয়ানক বিধ্বংসী টর্নেডোর ঘূর্ণন গতিবেগ ভূখণ্ডের ওপরেই ৩০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টারও বেশি হয়। ঘূর্ণিঝড় ও টর্নেডো একাধিক তাপগতির উৎসের চাপে সংঘবদ্ধ হয়, তাই এদের প্রকৃতি কম্প্রেসিভ। এদের গতি ও অবস্থান সাউন্ড ওয়েভ সমীকরণ থেকেই নির্ণয় করা হয়। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ইদানীং আবহাওয়ামণ্ডলের গতি-প্রকৃতির নানা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে, তাই অদূর ভবিষ্যতে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ নাও থাকতে পারে।
পূর্বানুমান
কথিত আছে, জার্মান সর্বাধিনায়ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভে আবহাওয়ার দুর্গতির জন্য বিমানবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি রোধে বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইনকে আবহাওয়ার পূর্বানুমান করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু NWP (নিউমারিকাল ওয়েদার প্রেডিকশন) সম্বন্ধে সমস্ত কিছু জানা সত্ত্বেও তিনি সম্মত হননি। কারণ সেই সময় ডিজিটাল নিউমারিক্যাল কম্পিউটিং পাওয়ার প্রায় ছিল না বললেই চলে।
বর্তমানে টেকনোলজি সেই প্রয়োজনীয় অভাব পূরণ করেছে। স্টেট অফ দ্য আর্ট রাডার, ভূ সমালোয় ও মেরুকেন্দ্রিক কৃত্রিম উপগ্রহ তথ্য সমেত মিডিয়াম রেঞ্জ নিউমারিক্যাল ওয়েদার প্রেডিকশন, আজকাল আবহাওয়ার পূর্বানুমানে আর কোনও সন্দেহের অবকাশ রাখে না। বঙ্গোপসাগরে আগত ২৪-২৫/১০/২০২২ ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস, মিডিয়াম রেঞ্জ নিউমারিক্যাল ওয়েদার প্রেডিকশন মডেল প্রতিনিয়ত উপস্থাপন করে যাচ্ছে আরও বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই। প্রাথমিক গতিবিধি থেকে আসন্ন সিত্রাং-এর শক্তি সম্বন্ধে অনেকেই উদ্বিগ্ন।