হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে দুর্গা শব্দের অর্থ হল ‘দ’ অক্ষর যিনি দৈত্য বিনাশ করেন, উ-কার যিনি বিঘ্ন নাশ করেন, রেফ অর্থাৎ যিনি রোগ নাশ করেন, ‘গ’ অক্ষর যিনি পাপ নাশ করেন এবং আ-কার হল যিনি শত্রু নাশ করেন। একসঙ্গে করলে এর অর্থ দাঁড়ায়— দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। তিনি অদম্য এবং অজেয়।
এই দশহাত-দেবীকে (Devi Durga) নিয়ে এক মহাবিস্ময়, ঘোরতর রহস্য আজও রয়ে গেছে মানুষের মনে। ভিন্নমতে তিনি দুর্গ নামের অসুরকে বধ করেছিলেন তাই তিনি দুর্গা। চণ্ডীতে দেবী দুর্গা হলেন মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতীর সমন্বিত রূপ এবং দেবী পার্বতীর উগ্র অবতার। তিনি মহামায়া নামেও পরিচিত। এই গ্রন্থে বলা আছে দুর্গা অসুর শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করার জন্য একটি উগ্র রূপ ধারণ করেন, যা চণ্ডী নামে পরিচিত। চণ্ডী এবং দুর্গা একই দেবীর বিভিন্ন রূপ, যেখানে চণ্ডী হলেন যুদ্ধ ও বিনাশের প্রতীক, আর দুর্গা হলেন রক্ষা ও প্রতিপালনের প্রতিমূর্তি। তিনি জগৎ-পালিকা আদ্যাশক্তি ও সনাতনী।
পুরাকালে মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালবাসী ত্রাহি ত্রাহি রব করছেন। স্বর্গের দেবতারা একপ্রকার বিতাড়িত হয়ে ব্রহ্মা, শ্রীবিষ্ণু ও মহাদেবের কাছে সাহায্য প্রার্থনায় উপস্থিত হলেন। তখন প্রবল পরাক্রমশালী মহিষাসুরকে বধ করার জন্য ত্রিদেব তাঁদের তেজ এবং সমস্ত দেবতার অংশ থেকে এক অপূর্ব নারীর সৃষ্টি করলেন। তিনি দেবী দুর্গা। সেই দেবীর দশহাত। নারী তো সৃষ্টি হল কিন্তু যে কাজের জন্য, তাঁর সৃষ্টি তার কী হবে! মহিষাসুরের সঙ্গে লড়াই করবেন কীভাবে! তাঁর কাছে অস্ত্র কোথায়? কোথায় বা যুদ্ধসাজ? যুদ্ধে তিনি যাবেনই বা কীসে! বাহন কোথায়? এই সময় দেবতারা তাঁকে অস্ত্র, অলংকার, বস্ত্র দিয়ে সাজান।
তার পরবর্তীতে মর্ত্যে দুর্গাপুজোর প্রচলন নিয়ে নানান কাহিনি আমরা দেখতে পাই।
শ্রীশ্রী চণ্ডীতে বর্ণনা করা হয়েছে প্রাচীনকালে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য সর্বহারা হয়ে নিজেদের সবকিছু ত্যাগ করে বনে চলে যান। বনের মধ্যে তাঁরা মেধা মুনির দেখা পেলেন। সেই ঋষি সব শোনার পর তাঁদের বলেন, বিশ্ব সংসারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জগতের পালন কর্তা বিষ্ণুর যে মহামায়া শক্তি তারই প্রভাবে এই রকম হয়। সেই মহামায়া প্রসন্না এবং বরদা হলে মানবের মুক্তি লাভ সম্ভব। মুনির উপদেশ পেয়ে সুরথ ও সমাধি মাটির প্রতিমা গড়ে ৩ বছর কঠোর তপস্যা করলেন তখন দেবী তুষ্ট হয়ে তাদের দেখা দেন এবং মনোবাঞ্ছনা পূর্ণ করেন। পরবর্তীতে বসন্তকালে তিনি মাতৃ আরাধনায় বাসন্তী পুজোর প্রচলন করেন।
রামায়ণ অনুসারে শারদীয়া দুর্গাপুজো বা অকালবোধনের সূচনা করেছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। তিনি রাবণের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধার করার জন্য লঙ্কা যাওয়ার আগে অকালবোধন করে শরৎকালে দুর্গার পুজো করেন। রামচন্দ্রের আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বর দেন দেবী (Devi Durga)।
দেবী দুর্গার যুদ্ধাস্ত্রের মহিমা অপরিসীম। এর নানা ব্যাখা রয়েছে। বেদ, পুরাণ, শাস্ত্র অনুযায়ী পৃথিবীর দশ দিকের প্রতিভূ এই দশ হাত। পুরাণে বলা আছে কুবের, যম, ইন্দ্র, বরুণ, ঈশান, বায়ু, অগ্নি, নৈঋত, ব্রহ্মা ও বিষ্ণু এই দশ দিক থেকে মহিষাসুরকে বধ করার উদ্দেশ্যে দেবী দুর্গার দশটি হাত সৃষ্টি করেছিলেন। দুর্গার বাম চোখ চন্দ্রের প্রতীক, ডান চোখ সূর্যের। কপালের নেত্র অগ্নির প্রতীক। দেবীর আবির্ভাবের পর দেবীকে সুসজ্জিত করার জন্য দেবতারা অস্ত্র প্রদান করেন। দেবতারা শুধু যে দেবীকে অস্ত্র দেন তা নয়, দেবীর শরীরের বস্ত্র, অলংকারও দেবতারা প্রদান করেন। তাই দেবী দুর্গাকে দশপ্রহরণধারিণী বলা হয়ে থাকে। প্রতিটি অস্ত্রের আলাদা গুরুত্ব এবং বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখাও রয়েছে।
ত্রিশূল
দেবাদিদেব মহাদেব দেবীকে (Devi Durga) প্রদান করেছিলেন তাঁর ত্রিশূল। যা ত্রিকাল দণ্ডস্বরূপ। এই ব্রহ্মাস্ত্রেই দেবী মহিষরূপী অসুরকে বধ করেছিলেন। শাস্ত্র মতে ত্রিশূল হল ত্রিগুণের প্রতীক। এই ত্রিগুণ হল সত্ত্বগুণ, রজঃগুণ এবং তমঃগুণ।
সত্ত্বগুণ হল সাত্ত্বিকগুণ বা অর্থাৎ সন্ন্যাসীর মতো নিরহংকার, ত্যাগের প্রতীক। রজগুণ বা রাজসিকগণ যা মনুষ্যকুল বা জীবকুলের গুণ। অর্থাৎ, মানুষ যেমন শোক, লোভ, মায়া, মোহ, কাম, দুঃখ দ্বারা সর্বদা জর্জরিত থাকে। এই গুণ জীবকুলের মায়াস্বরূপ। জীবনের মোহ আচ্ছন্ন করে রাখে চরাচরকে। বিলাস, ব্যসন এগুলো রাজসিকতার প্রকাশ।
তমঃগুণ হল রাক্ষস বা ঋণাত্মক শক্তির প্রকাশ। সব ধ্বংসের মূলে রয়েছে এই গুণটি। ক্রোধ, লোভ, মিথ্যা, বিলাসিতা, প্রতারণা, চুরি, হত্যা ইত্যাদি অপরাধমূলক কার্যকে বলে। আর এই ত্রিগুণাতিত হল ত্রিশূল। ত্রিশূলের মধ্য ভাগের ফলাটি সত্ত্বগুণের প্রতীক এবং বাকি দুই দিকের সমান উচ্চতার ফলা দুটো রজঃগুণ ও তমঃগুণের প্রতীক।
চক্র
ভগবান বিষ্ণু দেবী দুর্গাকে চক্র বা সুদর্শন চক্র প্রদান করেন। স্বয়ং দেব বিশ্বকর্মা সুদর্শন চক্র নির্মাণ করেছিলেন শ্রীবিষ্ণুর জন্য। ‘সু’ অর্থাৎ সুন্দর আর ‘দর্শন’ অর্থাৎ দৃশ্যমান। সুদর্শনচক্র হল ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীকস্বরূপ। যে চক্রে ব্রহ্মাণ্ড ঘুরছে। যার কেন্দ্রবিন্দু থেকে সমস্ত তেজশক্তি সঞ্চারিত ও বিচ্ছুরিত হয়ে চলেছে। এই ব্রহ্মাণ্ড হল ঠিক চক্রের মতো আকার বিশিষ্ট। জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য এই সুদর্শন চক্রের সৃষ্টি। দেবতাদের অসুর বিনাশের আকুতি দেখে স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু চক্রটি দেবী দুর্গাকে প্রদান করেন। চক্র দেবীর ডান হাতে থাকে। দেবী প্রকৃতিস্বরূপা আদ্যাশক্তি। তিনি ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রণকর্ত্রী। অর্থাৎ কাল বা সময় এবং ব্রহ্মাণ্ড যার মধ্যে বিকশিত জীবজগৎ তার মূল চালিকাশক্তি হলেন দেবী দুর্গা।
গদা বা কালদণ্ড
মা মহামায়াকে মহিষাসুর নিধন যজ্ঞের উদ্দেশ্যে গদা প্রদান করলেন স্বয়ং ধর্মরাজ যম। এই গদা ‘কালদণ্ড’ নামেও পরিচিত। দেবী দুর্গার (Devi Durga) বামহাতে গদা বা কালদণ্ড থাকে। গদা হল কাল বা মহাকালের প্রতীক। মহা প্রীতি ও আনুগত্যের প্রতীক। শাস্ত্রমতে গদা মানুষের মোহকে চূর্ণ করে। এই কাল বা মহাকালের দ্বারাই গোটা জগৎসংসার নিয়ন্ত্রিত। তাই কালের প্রতি আমাদের সর্বদা অনুগত থাকতে হয়। দেবী দুর্গার হাতে গদা বা কালদণ্ডকে এক সম্মোহনী শক্তি হিসেবে দেখা হয়। মহিষাসুরকে বধ করার উদ্দেশ্যে বা সম্মোহিত করার জন্য গদা বা কালদণ্ড খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অস্ত্র ছিল।
খড়্গ
শ্রীশ্রী চণ্ডীতে দেবী চামুণ্ডার উল্লেখ রয়েছে। যিনি অসুর নিধনকালে হয়েছিলেন রক্তবর্ণা। সেই রক্তবর্ণা দেবী খড়্গ দিয়ে অশুভের নাশ করেন। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে যে ৪৮ মিনিট সময় থাকে সেই সময় মা দুর্গাকে ১০৮টি শস্য, পুষ্প, বিল্বপত্র ও দীপ সহকারে দেবী চামুণ্ডারূপেই আরাধনা করা হয়। সাধারণত বলি প্রদান এই সময় হয়। খড়্গ হল বলি প্রদানের অস্ত্র।
খড়্গ হচ্ছে ষড়রিপু দমনের প্রতীক। খড়্গ হল বলি প্রদানের অস্ত্র। বলির এখানে অর্থ হল মনের যত অশুভ কু সেই বিবেক-বুদ্ধির নিধন। সহজে বলতে গেলে আমাদের যে ষড়রিপু কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য তার দমন এবং নিজের আত্ম শক্তিকে পরিশুদ্ধির প্রক্রিয়া। দেবীর ডান হাতে থাকা খড়্গ যা পরম মোক্ষেরও প্রতীক। মোক্ষ হল মুক্তির পথ। যা মানবজীবনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই খড়্গ আমাদের অভয় প্রদান করে।
আরও পড়ুন-রাজনৈতিক হত্যা?
ধনুর্বাণ বা
তির-ধনুক
পবন দেব ইতিবাচক শক্তির প্রতীক হিসেবে মা দুর্গাকে দিয়েছিলেন তির-ধনুক। দেবী দুর্গার (Devi Durga) বাম হাতে ধনুর্বাণ বা তির-ধনুক থাকে। দেবীর হাতে এই দুই অস্ত্র তাঁর শক্তিরূপকেই বর্ণনা করে। ধনুক শক্তির প্রতীক আর তির গতিশক্তির প্রতীক। তাই যুদ্ধে জয় পেতে বা লক্ষ্য স্থির রাখতে তীর-ধনুক কাল্পনিক লক্ষ্যভেদের অস্ত্র হিসেবে দেবীর হাতে সজ্জিত থাকে। ধনুর্বাণ লক্ষ্যস্থির করে সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোকে নির্দেশিত করে। এর অন্য ব্যাখা হিসেবে আমরা বলতে পারি জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের পরীক্ষার মুখে ফেলে দেয় তাই লক্ষ্য,স্থির থাকলে যে কোনও যুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব।
শঙ্খ
বরুণদেব দেবীকে প্রদান করলেন শঙ্খ। যা জাগরণের প্রতীক। পুরাণ মতে, শঙ্খ থেকে যে শব্দের উৎপত্তি হয় তার থেকেই জীবজগতের সমস্ত প্রাণের সৃষ্টি হয়। শঙ্খ বা শাঁখ দেবী দুর্গার বাম হাতে থাকে। এটি ঠিক অস্ত্র নয়। সমগ্র জীবজগতের স্পন্দনস্বরূপ এই অস্ত্র দেবীর হাতে সজ্জিত থাকে। যুদ্ধের সময় শঙ্খ বাজিয়ে যুদ্ধের সূচনা হত। পুরাণমতে, পৃথিবী সৃষ্টির সময় জলমগ্ন ছিল আর তখন শ্রীবিষ্ণু একটি শঙ্খের রূপধারণ করে সমুদ্রের গভীর তলদেশে অবস্থান করেছিলেন। এই শঙ্খধ্বনির মধ্য দিয়েই মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন দেবী দুর্গা। এর বৈজ্ঞানিক ব্যখা হল অ্যামিবা নামক এককোশী জলজ প্রাণীর মধ্যেই প্রথম প্রাণের স্পন্দনের সাড়া মিলেছিল। শাঁখ একধরনের জলজ সামুদ্রিক শামুক গোত্রীয় প্রাণীর দেহকোষ থেকে নির্মিত। তাই শাঁখ হিন্দুধর্মের জগৎ সৃষ্টির প্রাণের প্রথম স্পন্দনস্বরূপ।
ঘণ্টা
দেবীর বাম হাতে থাকে ঘণ্টা। দেবরাজ ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত ঘণ্টা অস্ত্রটি দেবীকে প্রদান করেন। শঙ্খের মতোই ঘণ্টার ধ্বনিতে যুদ্ধের সূচনা হয়। শাঁখ-ঘণ্টার মিলিত নিনাদে অশুভ শক্তির বিনাশের কাল ঘোষিত হয়ে থাকে। ঘণ্টা আসুরিক শক্তিকে দুর্বল করে। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে বর্ণিত আছে দেবী মহিষাসুরকে যখন যুদ্ধের জন্য আহ্বান করেছিলেন তখন তিনি অট্টহাসি হেসেছিলেন এবং শাঁখ ও ঘণ্টার ধ্বনিতে তাদের যুদ্ধের প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছিলেন। শব্দ এমন তরঙ্গ যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। সেই সুদূরপ্রসারী শব্দ তরঙ্গ বার্তা বাহক হিসেবেও কাজ করে।
শাস্ত্র অনুযায়ী একটি স্তোত্রে বলা হয়েছে ‘সা ঘণ্টা পাতু নো দেবি পাপেভ্যো নঃ সুতাম্ইব’। অর্থাৎ ভক্তরা মায়ের কাছে প্রার্থনা করছে, মা তোমার ওই যে ঘণ্টা অসুরদের তেজ হরণ করেছিল আমরাও সেই ঘণ্টার শরণাপন্ন হচ্ছি, আমাদের পাপকে সেই ঘণ্টা যেন হরণ করে নেয়।
বজ্র
দেবীর বাম হাতে থাকে বজ্র। দেবরাজ ইন্দ্র দেবী দুর্গাকে বজ্র প্রদান করেন। বৌদ্ধ ধর্মে জাগতিক বন্ধন থেকে চেতনাকে মুক্ত করতে বজ্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। হিন্দু মতে দেবীর বজ্র মিথ্যা ও অজ্ঞতাকে ধ্বংস করে। বজ্র দৃঢ়তা এবং সংহতির প্রতীক। আমাদের ব্যবহারিক জীবনে ও চরিত্রে কঠোর সংযমের প্রয়োজন। সেই সংযম এবং সংহতি সব মানুষের কাম্য। তাই দেবীর হাতে বজ্র শোভা পাচ্ছে।
সর্প বা নাগপাশ
সর্প বা নাগপাশ বিশুদ্ধ চেতনার প্রতীক। কুলকুণ্ডলিনী শক্তির প্রতীক এই সাপ। অনন্তনাগ দেবীকে দিয়েছিলেন দেন সর্প বা নাগপাশ। ভিন্নমতে মহাদেব দিয়েছিলেন তাঁর নাগকে। দেবী দুর্গার বাম হাতে নিচের দিকে সর্প বা নাগপাশ থাকে। আসুরিক প্রবৃত্তি লাঘব এবং মনে বিশুদ্ধ চেতনার বিকাশে দেবী দুর্গার হাতে সর্প বা নাগপাশ শোভা পায়। দেবী যখন মহিষরূপী অসুরকে নিয়ন্ত্রণ করতে ক্লান্ত তখন ক্ষণে-ক্ষণে রূপ পরিবর্তনকারী ছলনাময় অসুরকে এক মাত্র নাগপাশেই আবদ্ধ করে তার কেশ বাম মুঠোয় ধরেছিলেন। আর নাগপাশে জর্জরিত অসুর বুঝতে পারেন যে তিনি দেবীর নিকট বন্দি হয়েছেন।
পদ্ম, অক্ষমালা ও কমণ্ডলু
দেবী দুর্গাকে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারীও বলা হয়। পদ্ম আলোর প্রতীক। দেবী দুর্গাকে পদ্ম, অক্ষমালা, কমণ্ডলু প্রদান করেন প্রজাপতি ব্রহ্মা।
হিন্দুশাস্ত্রের প্রায় সব দেবদেবীদের অধিষ্ঠান প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর। পদ্মকে সর্বশক্তির আধার ধরা হয়। পদ্মফুলের জন্ম পাঁকেও হয় এর গূঢ় অর্থ হল অন্ধকার থেকে আলোর পথে উত্তরণ। সেই উত্তরণের প্রতীক হল পদ্ম। এছাড়া দেবী দুর্গার দক্ষিণ হাতে থাকে অক্ষমালা ও কমণ্ডলু। অক্ষমালা ও কমণ্ডলু পবিত্রতার প্রতীক।
দেবীর বাহন সিংহ
পুরাণ শাস্ত্র অনুযায়ী পর্বতরিজ হিমালয় তাঁকে দেন সিংহ বাহন। সংস্কৃত শব্দ ‘বাহ’ অর্থ হল বহন করা। বাহন শব্দটির আক্ষরিক অর্থই হল বহন করে যে। সিংহ হল ধর্ম, শক্তি, সুরক্ষা, দৃঢ়তা ও ক্ষমতার প্রতীক। আবার এই নিয়ে একটা অন্য গল্প আছে। দেবী পার্বতী হাজার বছর ধরে তপস্যা করেছিলেন শিবকে স্বামী হিসাবে পেতে। তখন একটি সিংহ তাঁকে খেতে আসে। কিন্তু দেবীকে তপস্যায় দেখে চুপটি করে সে বসে থাকে। এরপর অনেক বছর কেটে যায় দেবী তপস্যারত আর সিংহও নড়ে না, চড়ে না। একদিন দেবীর ধ্যান ভাঙে। কথিত আছে যেহেতু সিংহটি বহু বছর অপেক্ষা করেছিল সেহেতু দেবী তাকেই বাহনরূপে গ্রহণ করেন।
এরপর দেবীকে অলঙ্কারে ভূষিত করলেন কুবের, সূর্যদেব। তাঁরা দেবীকে (Devi Durga) কাঞ্চন বর্ণের সৌন্দর্যময় দ্যুতি প্রদান করেন। সবকিছু মিলিয়ে দেবী হয়ে ওঠেন অপার রূপের প্রতীক। বিশ্বকর্মা প্রদান করেন দুর্ভেদ্য কবচ-কুণ্ডল ও অক্ষয় বস্ত্র। এতে দেবীর সুরক্ষিত হয়ে উঠেন। দেবতাদের মিলিত তেজ আর শক্তিতে দেবী দুর্গা হয়ে ওঠেন বলীয়ান। অসুর নিধন করে মহিষাসুরমর্দিনী রূপ লাভ করেন তিনি।