কিংবদন্তি ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ লুক গদার স্বেচ্ছামৃত্যু (Euthanasia) বেছে নিয়েছিলেন। মহাভারতের পিতামহ ভীষ্ম বর পেয়েছিলেন স্বেচ্ছামৃত্যুর। আর বিশ্বচলচ্চিত্রের পিতামহ গদার বেছে নিয়েছিলেন স্বেচ্ছামৃত্যু। একাধিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন গদার। বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। যদিও তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যু বরণের কথা পরে প্রকাশ পেয়েছিল। জীবনের ইতি টানতে সুইজারল্যান্ড গিয়েছিলেন ‘ব্রেথলেস’-এর এই নির্মাতা। কারণ সুইজারল্যান্ডে কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে ‘অ্যাসিস্টেড সুইসাইড’ বা চিকিৎসকদের সহায়তায় জীবন নাশের সিদ্ধান্ত আইনত বৈধ। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন আসে পিতামহ ভীষ্মের ইচ্ছেমৃত্যু ‘ইউথেনেশিয়া’রই নামান্তর নয়তো। সবটাই প্রশ্নাতীত বিষয়।
পৃথিবীর কয়েকটি দেশ স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকারকে বৈধতা দিয়েছে। সুইজারল্যান্ড ছাড়াও নেদারল্যান্ডস, কানাডা, বেলজিয়াম, কলোম্বিয়া, জার্মানি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, হাওয়াই, ক্যালিফোর্নিয়া ও নিউ জার্সি প্রভৃতি।
সম্প্রতি নেদারল্যান্ডে স্বেচ্ছামৃত্যুর (Euthanasia) একটি ঘটনা আলোড়ন তুলেছে বিশ্ব জুড়ে। অসহনীয়, দুরারোগ্য মানসিক রোগ থেকে নিষ্কৃতি পেতে ২৮ বছরের এক ডাচ তরুণী জোরায়া টার বিক ২০২০ সালে নিষ্কৃতি মৃত্যুর আবেদন করেছিলেন। অবশেষে মিলেছে সেই ছাড়পত্র। এই মে মাসেই তিনি পেয়েছেন স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমোদন।
খবরটা নিয়ে এত হইচই শুরু হবার কারণ মানসিক কারণে নিষ্কৃতিমৃত্যুর ঘটনা বিশেষ ঘটতে দেখা যায়নি এর আগে।
এই ঘটনার তিন মাস আগেই ওই দেশেরই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দ্রায়াস ভন এজেট এবং তাঁর স্ত্রী ইউগিনি স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এজেট। কয়েকবছর আগে এজেটের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় তারপর থেকে তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। গুরুতর অসুস্থ ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীও। দীর্ঘ অসুস্থ সেই জীবন থেকে নিষ্কৃতি পেতে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন করেছিলেন তাঁরা। যন্ত্রণার জীবন আর নিতে পারছিলেন না। অবশেষ মেলে অনুমতি এবং ফেব্রুয়ারিতে পৃথিবী ছেড়ে পাড়ি দেন তাঁরা। যদিও প্রধানমন্ত্রীর এই ঘটনাটি বিরল নয়। কারণ নেদারল্যান্ডসে দম্পতিযুগলের স্বেচ্ছামৃত্যু যেন একটা ট্রেন্ড হয়ে উঠেছে। একসঙ্গে মৃত্যুবরণ করছেন অনেকেই। ২০২১ সালে ১৬ জন দম্পতি এবং ২০২২ সালে ২৯ জন স্বামী-স্ত্রী স্বেচ্ছামৃত্যুর (Euthanasia) আবেদন করেন। শেষের তালিকায় ছিল নেদারল্যান্ডসের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর স্ত্রীর নামও। নেদারল্যান্ডস বিশ্বের কয়েকটি দেশের মধ্যে অন্যতম যে দেশ শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি মানসিক অসুস্থতার জন্য স্বেচ্ছামৃত্যুকে বৈধতা প্রদান করেছে । স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করা যেন সে-দেশের আম ঘটনা হয়ে উঠছে। এজেট এবং তাঁর স্ত্রীর ইচ্ছামৃত্যুর কয়েক মাসের মধ্যেই সামনে এল জোরায়ার ঘটনা। তাঁর বয়স অল্প এবং পরীক্ষানিরীক্ষায় দেখা গেছে সে শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ।
ভারতের ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট কিছু শর্তসাপেক্ষে আইনসঙ্গত করেছে স্বেচ্ছামৃত্যুকে (Euthanasia)। তাতে ‘সম্মানজনক মৃত্যু জীবনের অধিকার’ বলে মন্তব্য করা হয়। সেখানে প্যাসিভ ইউথেনেশিয়া বা পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যুকে আইনিভাবে বৈধ বলা হয়েছে। পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যু তখনই প্রয়োগ করা যায় যখন কোমায় থাকা কোনও ব্যক্তিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার মতো আর কোনও অবস্থা থাকে না। সেই সময় তাঁর লাইফ সাপোর্ট খুলে দিয়ে সাধারণ পদ্ধতিতে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করেন চিকিৎসকরা। এমনকী, তাঁর ওপর ওষুধ প্রয়োগও বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে মাত্রাতিরিক্ত পেইনকিলার দেওয়া হয়। এর ফলে শ্বাসকষ্ট হয়ে মৃত্যুর দিকে ঢোলে পড়েন রোগী। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, এই পেইনকিলার একদিকে রোগীর ব্যথা প্রশমনে কাজ করে, অন্যদিকে হৃদযন্ত্র ক্রমশ দুর্বল করে দেয়। ফলে, সময়ের আগেই মৃত্যু হয় রোগীর। তবে ভারতীয় সংবিধানও কিন্তু মানসিক অসুস্থতার জন্য স্বেচ্ছামৃত্যুকে (Euthanasia) সম্মতি দেয়নি। কারণ কয়েক বছর আগে বেঙ্গালুরুর এক মহিলা দিল্লি হাইকোর্টের কাছে আবেদন করেছিলেন, তাঁর ৪৮ বছর বয়সি নয়ডাবাসী এক বন্ধুর জন্য, যাতে সুইজারল্যান্ড গিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করা থেকে তাঁকে বিরত রাখা যায়৷ কারণ সেই দেশে এটি বৈধ৷ ২০১৪ সাল থেকে ক্রনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোমে ভুগছিলেন সেই বন্ধুটি। এটি একটি দুরারোগ্য মানসিক ব্যাধি। স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ বলেন এটা মানবাধিকার লঙ্ঘন, কাউকে মেরে ফেলার অধিকার কারও নেই। কেউ ভাবেন আমার জীবন আমার সিদ্ধান্ত। কিন্তু মৃত্যু কি কখনও সিদ্ধান্ত হতে পারে!
আরও পড়ুন- নজরুল সাহিত্যে নারী
বার্গম্যানের ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ ছবিতে নাইট মৃত্যুকে দাবায় হারাতে চেয়েছিল। যদি জিজ্ঞেস করা যায় দেখা যাবে এই ইচ্ছে প্রতিটা মানুষের মনেই সুপ্ত। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুর মধ্যে শ্যামকে দেখেছিলেন। তাই তিনি লিখেছিলেন ‘মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান’ মৃত্যু যখন দোর গোড়ায় শ্যাম তখন কোথায়! এমন দর্শনে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস নেই। মৃত্যুর ভাবনাতেই মৃত্যু এসে পড়ে। মরার চিন্তা আতঙ্কের। এই সুন্দর পৃথিবীতে একটা ইতর প্রাণীও বেঁচে থাকতে চায়। তাহলে এমন কী পরিস্থিতি তৈরি হয় যে মৃত্যুকেই মুক্তির একমাত্র পথ বলে মনে হয়। কখন কাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে সেই মৃত্যু যা জীবনের চেয়ে সুখের। স্বেচ্ছামৃত্যু বা ইউথেনেশিয়া। ইউথেনেশিয়া’ শব্দটি এসছে গ্রিক শব্দ ‘ইউ’ এবং ‘থানাতোস’ (Euthanasia) থেকে। ‘ইউ’ শব্দটির অর্থ সহজ এবং ‘থানাতোস’ কথাটির মানে মৃত্যু অর্থাৎ ‘ইউথেনেশিয়া’ শব্দটির মানে দাঁড়াচ্ছে ‘সহজ মৃত্যু’। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত কোনও ব্যক্তি যখন চরম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তখন তাঁর মনে হয় একমাত্র মৃত্যুই হয়তো তার সব কষ্ট লাঘব করতে পারে। সে তখন চায় মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করতে। নিষ্কৃতি পেতে চায়। পেতে চায় স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার। চিকিৎসকদের সহায়তায় যন্ত্রণাহীন সেই জীবন নাশের পদ্ধতি হল ইউথেনেশিয়া।
জোরায়া টার বিক-এর ক্ষেত্রে কী ঘটল? যিনি একটা সময় নিজে পেশাদার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হতে চেয়েছিলেন, কেন তিনি এই বয়সেই তাঁর এই সুন্দর জীবনটাকে শেষ করে দিতে চাইলেন? আসলে জোরায়া বহু বছর ধরে ক্রনিক ডিপ্রেশন এবং উদ্বেগজনিত ট্রমার পাশাপাশি আনস্পেসিফায়েড পার্সোনালিটি ডিজ-অর্ডারে ভুগছিলেন। অটিজমও ছিল জোরায়ার। এছাড়াও ছিল বেশ কিছু জটিল মানসিক সমস্যা। এসব সমস্যা থাকার কারণে নিজের আবেগ ও তার প্রকাশের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকত না তাঁর। যদিও একদিনে এই চরম সিদ্ধান্তে আসেননি জোরায়া। এমন জটিল মানসিক সমস্যায় তিনি ভুগছেন শৈশব থেকেই। চিকিৎসা করতে তিনি এবং তাঁর পরিবার কোনও কার্পণ্য করেনি। নিজেকে সুস্থ করে তুলতে বিভিন্ন থেরাপি এবং মেডিকেশনের সাহায্য নিয়েছিলেন। দুরারোগ্য মানসিক ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে ইলেকট্রো কনভালসিভ থেরাপি অর্থাৎ ইসিটি-র তিরিশটার ওপর সেশনও নিয়েছিলেন। একদিন-দু’দিন নয়, লড়াই চালিয়েছেন দশবছর ধরে। জোরায়ার প্রেমিক তার জীবনে আসার পর তিনি ভেবেছিলেন এবার হয়তো এই মানসিক সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। এক-এক সময় আত্মহত্যা করার কথাও ভেবেছেন কিন্তু জোরায়ার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আত্মহত্যা করেন। সেই বন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের যন্ত্রণা, দুর্দশা তাঁকে ভীষণরকম বিধ্বস্ত করে দেয়। তাই নিজের পরিবারকে এমন আচমকা কোনও আঘাত দিতে চাননি জোরায়া। চিকিৎসার শুরুর দিকে ভীষণ আশাবাদী ছিলেন। ভেবেছিলেন এবার হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবেন। ইসিটি ট্রিটমেন্ট শেষ হয় ২০২০ সালের অগাস্ট মাসে তারপর আর কোনও চিকিৎসা বাকি ছিল না। বুঝতে পারেন রোগ মুক্তির কোনও আশাই নেই। জোরায়ার বক্তব্য অনুযায়ী ওই বছর ডিসেম্বরেই তিনি ইচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানান। ইচ্ছামৃত্যুর প্রসিডিওর খুব দীর্ঘ। অ্যাসিস্টেড ডাইং-এর পদ্ধতির জন্য খুবই কম সংখ্যক চিকিৎসক রয়েছেন তাই জোরায়াকে ওয়েটিং লিস্টে থাকতে হয়েছে। আবেদন মঞ্জুর হতে সময় লেগে গেছে সাড়ে তিনবছর। এই প্রসঙ্গে জোরায়া বলেন, ‘প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে একটানা লড়েছি। ভয় পেয়েছি, অপরাধবোধেও ভুগেছি বহুবার কিন্তু ইতস্তত করিনি, পিছিয়ে আসিনি। আমার পরিবার, বন্ধু প্রেমিক রয়েছে তাঁদের কষ্ট আমি বুঝি না এমনটা নয়, তবু আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড়। এ জীবন থেকে আমায় নিষ্কৃতি পেতেই হবে।’ যদি এখনও জোরায়ার মেডিক্যাল টিম বারবার তাঁকে জিজ্ঞেস করে চলেছে তিনি ইচ্ছামৃত্যু নেবেন সেই বিষয় নিশ্চিত কি না। যে কোনও মুহূর্তে এই চরম সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারেন। জোরায়া তবু অনড়। কিন্তু কীভাবে মৃত্যুবরণ করবেন তিনি? জানা গিয়েছে নির্দিষ্ট দিনে মেডিক্যাল টিম আসবে তাঁর বাড়িতে। চিকিৎসক ঘুমের ইঞ্জেকশন দেবেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি কোমায় চলে যান। তারপর হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা বন্ধের ওষুধ দেওয়া হবে। বিষয়টি এমন হবে, তিনি মনে করবেন ঘুমিয়ে পড়ছেন। সম্পন্ন হবে মৃত্যুপ্রক্রিয়া।
এই সময় একমাত্র তাঁর প্রেমিককে ঘরে থাকার অনুমতি দিয়েছেন জোরায়া দিনে দিনে বেড়ে চলেছে স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রবণতা। নিয়মের গোড়াও শিথিল। কিন্তু অধিকার রয়েছে বলেই কি বাঁচার চেষ্টা ছেড়ে দেওয়া কাম্য! আইনি বৈধ হলেই কি কেড়ে নেওয়া বেঁচে থাকার অধিকার। এমন বার্তা আগামী প্রজন্মকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করবে না এমনটা কেই-বা বলতে পারে!