ফলদায়িনী ফলহারিণী দেবী কালিকা

জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিই হল ফলহারিণী অমাবস্যা। এই দিনটির বিশেষ আধ্যাত্মিক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। এই দিনেই রামকৃষ্ণ মঠ ও আশ্রমে ষোড়শী পুজো হয়। কেন ফলদায়িণী ও ফলহারিণী? এই তিথি পালনে কেন সর্ববাসনা পূরণ হয় লিখলেন তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক

Must read

শক্তির দেবী হিসাবে দেবী কালিকার আরাধনা করেন শাক্ত বাঙালিরা। হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে, তন্ত্র মতে যেসব দেব-দেবীর পুজো করা হয় তাদের মধ্যে কালীপুজো অন্যতম।
কালী শব্দটি কাল শব্দের স্ত্রীর রূপ, যার অর্থ হল কৃষ্ণ বর্ণ বা গুরু বর্ণ।
চতুর্ভুজা দিগম্বরী দেবী, ঘোর কৃষ্ণবর্ণা, এলোকেশী ভীষণ রূপা। অথচ এই দেবীর কাছেই জগৎ সংসারের শান্তি নিহিত রয়েছে। তিনি মাতৃস্বরূপা দেবী কালিকা।
কালীপুজো সাধারণত অমাবস্যাতেই হয়ে থাকে।
অমাবস্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস। অমাবস্যাকে শুভ-অশুভ শক্তি প্রভাবের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। এই দিনে কিছু বিশেষ মন্ত্র ও মা কালীর পুজো করা হয়। এক-এক মাসের অমাবস্যা তিথির এক-এক রকম মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব রয়েছে।
জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে ফলহারিণী কালীপুজো হয়। দীনদয়াময়ী, অকূলের ত্রাণকর্তী মা সবসময়ই ভক্তকে আশীর্বাদ দেন। তবু নির্দিষ্ট তিথিতে দেবীর আরাধনা করলে বিশেষ ফল লাভ হয়।
সেই বিশেষ তিথি হল ফলহারিণী অমাবস্যা তিথি।
দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট, তারাপীঠ তো বটেই এছাড়া যে কোনও মা কালীর মন্দির এবং অনেক গৃহস্থ বাড়িতেও এই দিনে দেবীর বিশেষ পুজো করা হয়।
মোক্ষফল প্রাপ্তির জন্য এই অমাবস্যার বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে।
এই দিন দেবীকে বিভিন্ন মরশুমি ফল দিয়ে পুজো (Falharini Kali puja) করার রীতি।
জ্যৈষ্ঠ মাসে নানা ফলের সমাহার। যে কোন মরশুমি ফল নিবেদন করে এদিন দেবী মায়ের কাছে মনোস্কামনা জানান ভক্তরা। এমনও মানা হয় যে, মনোস্কামনা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত নিবেদনের বিশেষ ফলটি খাওয়া নিষেধ।
ইচ্ছে পূরণের পর সেই বিশেষ ফলটি গঙ্গায় ভাসিয়ে পুজোর আয়োজনের পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতেরা।
এই দিন সাধকরা নিজেদের কর্মফল অর্পণ করেন দেবীর চরণে। বিশ্বাস করা হয়, এতে দেবী ভক্তের জীবনে অশুভ কর্মফল দূর করেনএবং জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি নিয়ে আসেন।
জীবকে তিনি যা দেন তা তাদের কর্মফল অনুসারী দেন।
এই দিনে বিশেষ রূপে দেবী পুজোর আরাধনার নিয়ম। বলা হয় জীবকে তিনি যা দেন তা তাদের কর্মফল অনুসারেই দেন। মানুষ কেবলমাত্র কর্ম করার অধিকারী। কিন্তু কর্মের ফল দান করার অধিকার একমাত্র বিধাতা স্বরূপা দেবী কালিকার। যে কোনওই কর্মেরই দুটি ফল আছে। কুকর্ম করলে কুফল, সুকর্মের সুফল। ফলহারিণী অমাবস্যায় দেবী সন্তানদের সুকর্মের জন্য আশীর্বাদ করেন। অন্যদিকে সন্তানের কুকর্মের জন্য অশুভ ফলের প্রভাব থেকে সন্তানদের রক্ষা করেন। অশুভ কর্মকালের বিনাশ হয় বদলে শুভ ফলপ্রাপ্ত হয়। তাই এই অমাবস্যায় দেবী ফলহারিণী মা রূপে পূজিতা হন।
ফলহারিণী কালীপুজোর দিন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীসারদা মাকে সাক্ষাৎ ষোড়শীজ্ঞানে পুজো করেন। এটা জগতের ইতিহাসে এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ঠাকুর সংসারে নারীর স্থান ও দাম্পত্যের এক যুগান্তকারী দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছিলেন এই বিশেষ দিনেই। ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শনে এই এক অভূতপূর্ব অতুলনীয় ও বিরলতম ঘটনা।

আরও পড়ুন-টোকিওতে প্রয়াত বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধার্ঘ্য অভিষেকের

দাম্পত্য ভালবাসার এক নতুন রূপের উন্মোচন দেখল আপামর পৃথিবীবাসী। অমাবস্যার থেকে সরস্বতী পুজোর যেন চোখে আঙুল দিয়ে গোটা সমাজকে দেখাল যে সংসারে নারীর স্থান কোথায় এবং তাদের প্রকৃত স্বরূপ কী।
সন্তানের নিজের জন্মদাত্রীকে দেবী জ্ঞানে পুজোর কথা আমরা শাস্ত্রে দেখেছি। কিন্তু সহধর্মিণীতে বেদিমূলে বসিয়ে দেবী জ্ঞানে উপাচার-সহ পুজো এ এক নজিরবিহীন ঘটনা।
তন্ত্রচর্চার মূলই হল আধার শক্তি। সেই শক্তিকে কেন্দ্র করেই থাকে মহামায়ার দশটি বিশেষ রূপ। এরাই দশমহাবিদ্যা। তৃতীয় মহাবিদ্যা দেবীর রূপ হল ষোড়শী।
ধ্যান মন্ত্র অনুযায়ী তিনি ষোলো বছরের বালিকার স্বরূপ দেবী মহামায়ার এই বিশেষ রূপকে নিজের স্ত্রীর মধ্যে কল্পনা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। ভক্তি নিয়ে অমাবস্যায় দেবীর পুজো করেছিলেন।
‘শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গে’ পাওয়া যায় সেই রাতের পুজোর বর্ণনা ——
‘১২৮০ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের অর্ধেকের উপর গত হইয়াছে। আজ অমাবস্যা ফলোহারেনি রাধিকা পূজার পুণ্যদিবস। সুতরাং দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে এক বিশেষ পর্ব উপস্থিত। ঠাকুর শ্রীশ্রী জগদম্বাকে পূজা করিবার মানসে আজ বিশেষ আয়োজন করিয়াছেন। ওই আয়োজন কিন্তু মন্দিরে না হইয়া তাঁহার ইচ্ছানুসারে গুপ্তভাবে তাঁহার গৃহেই হইয়াছে। পূজাকালে দেবীকে বসিতে দিবার জন্য আলিম্পনভূষিত একখানি পীঠ পূজকের আসনের দক্ষিণ পার্শ্বে স্থাপিত হইয়াছে।
সূর্য অস্তগমন করিল। ক্রমে গাঢ় তিমিরাবগুণ্ঠনে অমাবস্যার নিশি সমাগতা হইল। ঠাকুরের ভাগিনেয় হৃদয়কে অদ্য রাত্রিকালে মন্দিরে দেবীর বিশেষ পূজা
করিতে হইবে সুতরাং ঠাকুরের পূজার আয়োজনে যথাসাধ্য সহায়তা করিয়া সে মন্দিরে চলিয়া যাইল এবং রাধাগোবিন্দের রাত্রিকালে সেবা পূজা সমাপনান্তর দীনু পূজারী আসিয়া ঠাকুরকে ওই বিষয়ের সহায়তা করিতে লাগল।
দেবীর রহস্য পূজার সকল আয়োজন সম্পূর্ণ হইতে রাত্রি নয়টা বাজিয়ে গেল। শ্রীমতী মাতা ঠাকুরানীকে পূজাকালে উপস্থিত থাকিতে ঠাকুর ইতঃপূর্বে বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন, তিনিও ঐ গৃহে এখন আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঠাকুর পূজায় বসিলেন।
পূজা দ্রব্য সকল সংশোধিত হইয়া পূর্বকৃত্য সম্পাদিত হইল। ঠাকুর এইবার আলিম্পনভূষিত পীঠে শ্রীশ্রী মাকে উপবেশনর জন্য ইঙ্গিত করিলেন। পূজা দর্শন করিতে করিতে শ্রীমতী মাতা ঠাকুরানীর ইতঃপূর্বে অর্ধবাহ্য দশা প্রাপ্তা হইয়াছিলেন। সুতরাং কী করিতেছেন, তাহা সম্যক না বুঝিয়া মন্ত্রমুগ্ধার ন্যায় তিনি এখন পূর্বমুখে উপবিষ্ট ঠাকুরের দক্ষিণ ভাগে উত্তরাস্যা হইয়া উপবিষ্টা হইলেন।
সম্মুখস্থ কলসের মন্ত্রপূত বারি দ্বারা ঠাকুর বারংবার শ্রীশ্রীমাকে যথাবিধানে অভিষিক্তা করিলেন। অনন্তর মন্ত্র শ্রবণ করাইয়া তিনি এখন প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারণ করিলেন। অনন্তর মন্ত্র শ্রবণ করাই ইয়া তিনি এখন প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারণ করিলেন।
‘হে সর্বশক্তির অধীশ্বরই মাতঃ ত্রিপুরাসুন্দরি, সিদ্ধিদার উন্মুক্ত কর, ইহার (শ্রীশ্রী মা) শরীর মনকে পবিত্র করিয়া ইহাতে আবির্ভূতা হইয়া সর্বকল্যাণ সাধন কর!”
অতঃপর শ্রীশ্রী মার অঙ্গে মন্ত্রসকলের যথাবিধানে ন্যাস পূর্বক ঠাকুর সাক্ষাৎ দেবীজ্ঞানে তাঁহাকে ষোড়শোপচারে পূজা করিলেন এবং ভোগ নিবেদন করিয়া নিবেদিত বস্তু সকলের কিংদংশ সহস্তে তাঁহার মুখে প্রদান করিলেন। বাহ্যজ্ঞান তিরোহিতা হইয়া শ্রীশ্রী মা সমাধিস্থা হইলেন! ঠাকুরও অর্ধবাহ্য দশায় মন্ত্রচারণ করিতে করিতে সম্পূর্ণ সমাধি মগ্ন হইলেন। সমাধিস্থ পূজক সমাধিস্থা দেবীর সহিত আত্মস্বরূপে পূর্ণ ভাবে মিলিত ও একীভূত হইলেন।
কতক্ষণ কাটিয়া গেল নিশার দ্বিতীয় প্রহর বহুক্ষণ অতীত হইল। আত্মারাম ঠাকুরের এইবার বাহ্যসংজ্ঞার কিছু কিছু লক্ষণ দেখা গেল। পূর্বের ন্যায় অর্ধবাহ্য দশা প্রাপ্ত হইয়া তিনি এখন দেবীকে আত্মনিবেদন করিলেন। অনন্তর আপনার সহিত সাধনার ফল এবং জপের মালা প্রভৃতি সর্বস্ব শ্রীশ্রী দেবীর পাদপদ্মে চিরকালের নিমিত্ত বিসর্জন পূর্বক মন্ত্রোচ্চারণ করিতে করিতে তাঁহাকে প্রণাম করিলেন।
হে সর্বমঙ্গলের মঙ্গলস্বরূপে, হে সর্বকর্ম নিষ্পন্নকারিণি, হে শরণদায়িনি ত্রিনয়নি শিব গেহিনি গৌরী, হে নারায়ণী, তোমাকে প্রণাম, তোমাকে প্রণাম করি।
পূজা শেষ হইল মূর্তিমতী বিদ্যরূপিণী মানবীর দেহাবলম্বনে ঈশ্বরীয় উপাসনা পূর্বক ঠাকুরের সাধনার পরিসমাপ্তি হইল— তাঁহার দেব মানবত্ব সর্বতোভাবে সম্পূর্ণতা লাভ করিল।’
জ্যৈষ্ঠ অমাবস্যা তিথি বাঙালি জীবনে এইজন্য এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনার সূচনা হয়েছিল দেবী কালিকার সাধনায়। শেষ হয় ষোড়শীর পাদপদ্মে সাধনার ফল সমর্পণে। দেবী কালিকার বর্ণ কৃষ্ণ। সাধনার সূচনায় অন্ধকার পথকে পেরিয়ে সাধককে অগ্রসর হতে হয়। ষোড়শীর বর্ণ প্রভাত সূর্যকিরণের মতো। সাধনার সিদ্ধিতে সাধক উজ্জ্বল আলোক কিরণের রাজ্যেই প্রবেশ করেন। ষোড়শী দশমহাবিদ্যার তৃতীয় রূপ। যিনি কালী তিনিই ষোড়শী। শুধু নামভেদ এবং রূপভেদ।
নিজের আধ্যাত্মিক সাধনার ফল সমর্পণের জন্য ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বেছে নিয়েছিলেন অমানিশাকে।
দেবী কালিকাকে বলা হয় বিশেষ করে ফলহারিণী কালীপুজোর প্রসঙ্গে, তিনি ফলহারিণী। কারণ আমাদের জীবনের সমস্ত কাজ বা সংস্কার ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে দেবীর। দুর্গমতে দুঃখহরা দেবীর কাছেই রয়েছে আমাদের বারবার জন্ম-মৃত্যু আসা যাওয়া চক্র থেকে মুক্তিলাভের চাবি।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ফলহারিণী কালীপুজোর দিনে তাঁর আধ্যাত্মিক তপস্যার সমস্ত ফল তাঁর স্ত্রীর চরণে সমর্পণ করেছিলেন।
আজও এই দিনটি স্মরণে রামকৃষ্ণ মঠ ও আশ্রমে পুজোপাঠ হয়।
বাংলার বাইরে অবশ্য এই অমাবস্যা তিথি নানা নামে পরিচিত। উত্তর ভারতে এর নাম বাঢ় অমাবস্যা। অর্থাৎ বট অমাবস্যা। অনেকে আবার একে বট সাবিত্রী ব্রতও বলে থাকেন। বটবৃক্ষের পুজো করা হয় এই তিথিতে শুভ ফলের কামনা করে।
প্রাচীন ভারতে বৃক্ষ উপাসনা হত। এছাড়া যক্ষ প্রভৃতি উপদেবতারা বৃক্ষবাসী হতেন। বৃক্ষবাসিনী একজন মায়ের উপাসনা করা হত হরপ্পা সভ্যতায়। মা কালী আদিতে ছিল বলাকা মাতৃকা। এখনও বটগাছ আমাদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। প্রায়ই মা কালীর সঙ্গে বটগাছের যোগ বৃক্ষ পুজো এখনও প্রচলিত। নবদ্বীপ অধিষ্ঠিত পোড়ামা বৃক্ষমাতৃকা। বাংলা জুড়ে অসংখ্য বটতলায় আজও মাতৃকা উপাসনা হয়।
সাধকদের মতে দেবী কালিকা স্বয়ং ব্রহ্মশক্তি। মহাকাল শিব মায়ের পদতলে বিরাজ করেন। সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের কর্ত্রী তিনিই।
মহাকালী একাধারে ভয়ঙ্করী অন্যদিকে অপার করুণাময়ী। মায়ের নানা রূপ। কোথাও তিনি নিত্যকালী কোথাও তিনি মহাকালী, ভদ্রকালী, শ্যামাকালী কোথাও আবার রক্ষাকালী, সিদ্ধেশ্বরী কালী, শ্মশান কালী বা রটন্তী কালী। তিনিই আবার এই ফলহারিণী কালী।
এই ফলহারিণী দেবী কালিকাই কর্মফল হরণ করেন এবং মুক্তি প্রদান করেন। ভক্তদের সমস্ত বিপদ, দৈন্য, ব্যাধি এবং সমস্ত অশুভ শক্তি বিনাশ করে তিনি ঐশ্বর্য, আরোগ্য, বল, পুষ্টি ও গৌরব প্রদান করেন।
তুমি সন্ধ্যা, তুমি গায়ত্রী
তুমি জগদ্ধাত্রী গো মা
অকূলের ত্রাণকর্তী
সদা শিবের মনোহরা।।

Latest article