ইতিহাসের ছোঁয়া
ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান (Ferdinand Magellan)। নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই— অবাকও হচ্ছেন তাই তো; মনে পড়ে গেল বুঝি সেই প্রাচীন যুগের ভ্রমণবৃত্তান্ত! মিঃ ম্যাগেলান হলেন ষোড়শ শতকের জনৈক পর্তুগিজ নাবিক, অনুসন্ধানকারী ও পরিব্রাজক; তিনি এবং তাঁর দলবল প্রশান্ত মহাসাগরের বুক চিরে ‘ম্যাগেলান প্রণালী’ রচনা করে সর্বপ্রথম ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশের মধ্যে জলপথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। তাঁরই নামানুসারে ‘ম্যাগেলানের মেঘ’ বা ‘ক্লাউডস অব ম্যাগেলান’। এ যেন স্মৃতিপটে স্বচক্ষে ওই আকাশের বুকে বিচরণ! ইতিহাসের ধূসর পাতা থেকে সোজা রোমাঞ্চকর বিজ্ঞানের দুনিয়ায় অবতরণ।
বিজ্ঞানের সূচনা
প্রতিদিনের মতো গত ৭ সেপ্টেম্বর আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা নাসা সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে নতুন করে জানার জন্য একটি চিত্তাকর্ষক বৈশিষ্ট্যযুক্ত ছবি প্রকাশ করেছেন। ছবিটি তুলেছেন উন্নত দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে মহাকাশ-চিত্রগ্রাহক ক্রিশ উইলকস। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পরিভাষায় ওটাই নাকি ‘ম্যাগেলানের মেঘ’ বা ‘ক্লাউডস অব ম্যাগেলান’। বিজ্ঞানীদের ধারণা এটি আসলে আমাদের গ্রহ পৃথিবীর ছায়াপথ ‘দ্য মিল্কি ওয়ে’র উপগ্রহ-ছায়াপথ।
রহস্যের পটভূমি
পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে, ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজের এক উচ্চবংশীয় দম্পতির ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন ফার্নান্দো দে ম্যাগেলাস ওরফে ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান (Ferdinand Magellan)। ছেলেবেলাটা ওঁর একপ্রকার পর্তুগালের রানির বালকভৃত্য হয়ে রাজপ্রাসাদেই কেটেছে; যুবক হতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি ও মরোক্কোতে কর্মরত। সেখান থেকেই স্পেনের রাজার অধীন রাজা ম্যানুয়েলের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশ্ব পরিক্রমার পথ রচনা। ব্যস দলবল-সহ ১০ অগাস্ট, ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের বিখ্যাত সেভিল শহর থেকে সমুদ্রের পথ ধরে যাত্রা শুরু করলেন; লক্ষ্য পৃথিবী পরিক্রমণ। এই যাত্রাকালে পৃথিবীর দক্ষিণপ্রান্ত ঘোরার সময় ম্যাগেলান ও তাঁর সঙ্গীদের হাতে ছিল অফুরন্ত সময়, সেই সময়ে ওঁরা দক্ষিণের আকাশে আবিষ্কার করেন বিস্ময়কর মেঘমণ্ডল। ইতিহাসে এটিই ‘ম্যাগেলানের মেঘ’ বা ‘ক্লাউডস অব ম্যাগেলান’ নামে পরিচিত। প্রাক-ইতিহাসের কথায় পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের ওই মেঘ সম্পর্কে নাকি অনেক আগেই, ৯৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্যের জ্যোতির্বিদ আল-সুফি জানান দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর পরিভাষায় এর নাম ছিল আল-বকর; পরবর্তীতে ১৫০৩-’৪ খ্রিস্টাব্দে সম্ভাব্য আমেরিগো ভেসপুচি এর উল্লেখ করে গিয়েছিলেন এবং ম্যাগেলান তা ১৫১৯ ক্রিস্টাব্দে আবিষ্কার করেন।
মেঘের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক প্রকাশ
২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ অগাস্ট সকালবেলায় অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের উইন্টন শহরের নিকটে দক্ষিণ-পূর্ব আকাশে এইরকম দুটি ছোট-বড় মেঘমণ্ডল দেখা গিয়েছিল। মহাকাশ-চিত্রগ্রাহক ক্রিশ স্কার ওই দৃশ্যটিকে ‘ম্যাগেলানের প্রভাতী গগনপট’ বা ‘ম্যাগেলানিক মর্নিং স্কাইস্কেপ’ বলে বর্ণনা করেছেন।
আরও পড়ুন- নতুন সংসদ ভবন এবং কয়েকটা সংশয় চিহ্ন
মেঘের রূপরেখা
২০০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ছবিটিতে নাসার বিজ্ঞানীরা দুটি মেঘমণ্ডলকে চিহ্নিত করেছেন; একটি ‘ছোট ম্যাগেলানের মেঘ’ বা স্মল ম্যাগেলানিক ক্লাউড (এসএমসি) ও অন্যটি ‘বৃহৎ ম্যাগেলানের মেঘ’ বা লার্জ ম্যাগেলানিক ক্লাউড (এলএমসি)। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের হিসেব অনুযায়ী ‘এসএমসি’ ২.১ লক্ষ ও ‘এলএমসি’ ১.৮ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। সম্প্রতি ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ অগাস্ট প্রকাশিত ছবিটিতে ‘এলএমসি’ বা ‘বৃহৎ ম্যাগেলানের মেঘ’ দৃশ্যমান।
মেঘের আন্তঃনাক্ষত্রিক অবস্থান
ম্যাগেলানের (Ferdinand Magellan) এই গগনবিদারী অনুসন্ধানের পর যে কোনও মহাকাশ-গবেষকের পক্ষে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে এইপ্রকার নির্দিষ্ট মেঘজটলাকে শনাক্ত করাটা খুবই সহজ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে বৃহৎ ম্যাগেলানের মেঘটি দক্ষিণ আকাশের ডোরাডো তারামণ্ডলের মধ্যে ১.৬ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এবং এই মেঘটি পনেরো হাজার আলোকবর্ষ দূরত্বব্যাপী বিস্তৃত।
নিসর্গবিদদের বিশ্লেষণ
দক্ষিণ গোলার্ধে দৃশ্যমান এই ম্যাগেলানের মেঘ আসলে অনিয়মিত খর্ব ছায়াপথ, যা পৃথিবীর ছায়াপথ ‘দ্য মিল্কি ওয়ে’র চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। বিজ্ঞানীরা তাই এদের মিল্কি ওয়ের উপগ্রহ ছায়াপথ বলে থাকেন। এরা পৃথিবীর স্থানীয় ছায়াপথেরই সদস্য বিশেষ। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে স্যাগিটারিয়াস নামে খর্ব উপবৃত্তাকার ছায়াপথের আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত বৃহৎ ম্যাগেলানের মেঘটিই ছিল মিল্কি ওয়ের সবচেয়ে কাছের বহির্ভূত উপগ্রহ ছায়াপথ। এটি আশি হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।
বৃহৎ ম্যাগেলানের মেঘের আকর্ষণ
জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে বৃহৎ ম্যাগেলানের মেঘ নানা ধরনের মহাজাগতিক সম্ভাবনার আঁতুড়ঘর। আদতে এটি একটি অনিয়মিত খর্ব ছায়াপথ হলেও এই জটলার মধ্যে রয়েছে আকর্ষণীয় সব গ্লোবাকৃতির ও মুক্ত মহাজাগতিক পিণ্ড, অসংখ্য নিষ্ক্রিয় এবং গ্রহাণু নীহারিকা। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ‘এনজিসি২০৭০ টারান্টুলা’ নামে গর্ভিণী নীহারিকার অবস্থান। ১৯৮০-র দশকে দূরবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহারের আগে বৃহৎ ম্যাগেলানের মেঘের মধ্যে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা বর্তমানে বিজ্ঞানীমহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ওই মেঘের মধ্যে ‘সুপারনোভা ১৯৮৭এ’ নামে একটি মহাজাগতিক ঝঞ্ঝা দেখা দেয়, যেটি কেপলারের পর সবচেয়ে কাছের এবং বিকট ছিল। নিসর্গবিদদের ধারণা ওই অঞ্চলে নতুন তারার জন্ম হতে পারে।
জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক আলোড়ন
বর্তমানে বিজ্ঞানীদের মতে এই বিশেষ ঘটনাটি ব্রহ্মাণ্ডকে নতুন করে চিনতে ও জানতে সাহায্য করবে। কয়েক দশক মিলিয়ন সংখ্যক নক্ষত্র-বিশিষ্ট খর্ব ছায়াপথ পৃথিবীর ছায়াপথ ‘দ্য মিল্কি ওয়ে’র চারদিক ঘিরে রয়েছে; যদিও ওই নক্ষত্রের সংখ্যা দ্য মিল্কি ওয়ের অন্তঃস্থিত নক্ষত্রের সংখ্যার তুলনায় কিছুই নয়। তবে এই ছায়াপথের সবচেয়ে কাছের সুপারনোভার উৎসস্থল হল বৃহৎ ম্যাগেলানের মেঘ নামে ওই উপগ্রহ ছায়াপথটি। তারই কেন্দ্রস্থলে রয়েছে ‘৩০ ডোরাডাস’ নামে একটি অঞ্চল যা টারান্টুলা নীহারিকা নামেও পরিচিত। জ্যোতির্বিদদের ধারণা, প্রায় এক হাজার আলোকবর্ষ দূরত্বব্যাপী বিস্তৃত এই নীহারিকাটির মধ্যে নতুন তারার জন্ম হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
ভবিষ্যতের প্রাপ্তি
ফার্নান্দো দে ম্যাগেলাস তাঁর নতুনের খোঁজের উচ্চাশা নিয়ে যে পৃথিবী পরিক্রমা শুরু করেছিলেন ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে, দুর্ভাগ্য তিনি সেই যাত্রা শেষ করতে পারেননি। ফিলিপাইনের জেবু প্রদেশে ১৫২১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ এপ্রিল তিনি ভ্রমণরত অবস্থাতেই খুন হয়ে যান। তবে ইতিমধ্যে তিনি বহু নদী, দ্বীপ ও দেশ এবং নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। উল্লেখযোগ্য, তারই অবসরে খুঁজে পাওয়া ‘ক্লাউডস অব ম্যাগেলান’, যা ভবিষ্যতে আমাদের আকাশতটে নতুন নতুন তারার জন্ম দেবে; হয়তো তৈরি হবে কোনও নতুন তারামণ্ডল কিংবা নতুন কোনও সৌরজগৎ!