বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের যে প্রচলিত উৎসগুলোর সঙ্গে আমরা ছোটবেলা থেকেই পরিচিত, সেগুলোর প্রায় সবই যে নিঃশেষিত হওয়ার পথে, এ-আমাদের জানা নিশ্চয়ই। কয়লা হোক বা পেট্রোলিয়াম— মজুত ভাণ্ডার প্রায় শেষ হতে চলেছে, আর সে-কারণেই অনেক কাল ধরেই মানুষ ঝুঁকছে বিকল্প পথের দিকে, যার একটা সহজ উদাহরণ আমাদের জানা— সেটা হল সৌরশক্তি।
এই ধরনের শক্তির উৎসগুলোর আর একটি নাম প্রচলিত আছে; এগুলো হল পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি (Renewable energy source), মানে এদেরকে নতুনভাবে ব্যবহার করা চলে, বারবার। আর কে না জানে, সূর্যের শক্তি আশু ফুরোবার সম্ভাবনা নেই বলে সৌরশক্তি দীর্ঘকাল আমরা ব্যবহার করে যেতে পারব, নিঃশেষ হওয়ার চিন্তা নেই। এরই মতো আর একটা শক্তি-উৎস হল বায়ুশক্তি। এটার জন্য দরকার হয় বাতাসের গতির। তবে এইসব শক্তি-উৎসের একটা প্রধান সমস্যা, এগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে পাওয়ার উপায় নেই। রাতের বেলা সূর্য অনুপস্থিত, আর বাতাসের গতি না থাকলে বায়ুশক্তির উৎপাদন বন্ধ। তাহলে সেরকম কোনও উপায় কি আছে, যেখানে দিন-রাতের সব সময়েই একটানা মিলবে শক্তি, যেমন বিদ্যুৎ?
এতদিন ধরে অনেক বিজ্ঞানীই এই প্রশ্নের উত্তরটাকেই ‘হ্যাঁ’ বলবার জন্য বিস্তর চেষ্টা (বা রিসার্চ) চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সদ্য তাঁদের সামনে সেরকমই দৃষ্টান্তমূলক এক ঘটনা হাজির হয়েছে, যেটা দেখে সকলে আবার নতুন করে আশায় বুক বাঁধছেন।
মহাকর্ষ বল দিয়ে ব্যাটারি (Gravity battery)!
ইউরোপের স্কটল্যান্ডের একটি কোম্পানি, নাম ‘গ্র্যাভিটিসিটি’। নাম দেখেই আশা করি আন্দাজ করা যাচ্ছে যে এরা মূলত কাজ করে মহাকর্ষ বল আর তড়িৎ-সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি নিয়ে। তা এরাই এবার তৈরি করল এমন এক বিদ্যুৎ তৈরির কল, যেটা তৈরিতে কাজে লাগানো হয়েছিল মহাকর্ষ টানকে। হ্যাঁ, সত্যিই পৃথিবীর মহাকর্ষ টানকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা গিয়েছে বিদ্যুৎ!
এডিনবরার কাছে একটি বন্দর এলাকায় দুটো প্রকাণ্ড উঁচু স্টিলের টাওয়ারের (প্রতিটার উচ্চতা পনেরো মিটার, মানে প্রায় পাঁচতলা বাড়ির সমান উঁচু) ওপরে যন্ত্রের সাহায্যে তুলে নেওয়া হয় দুটো পঁচিশ টনের (এক টন মানে হাজার কিলো, সেই হিসেবে এক-একটা পঁচিশ হাজার কিলোর) ভারী বস্তু। তারপর ওই বস্তুদুটোকে যখন ওপর থেকে নিচের দিকে ফেলে দেওয়া হয়, ওগুলোর মধ্যে সঞ্চিত থাকা স্থিতিশক্তি রূপান্তরিত হয় বিদ্যুৎ শক্তিতে। আমরা এটা সকলেই জানি যে কোনও বস্তুকে ওপরের দিকে তোলা হলে ওর মধ্যে স্থিতিশক্তি সঞ্চিত হয়, যেটা নির্ভর করে কতটা উচ্চতায় তোলা হচ্ছে সেটা আর ওই বস্তুর ভরের ওপর।
তবে ওই সময় ব্যাটারিতে যে বিদ্যুৎ তৈরি হয়েছিল, তার বিভব বা ভোল্টেজ অনেক বেশি (প্রায় আড়াইশো কিলোওয়াট) হলেও সেটা স্থায়ী হয়েছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। পরে এই সময়সীমাকেই বাড়ানোর চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন ওই বিজ্ঞানীরা।
আরও পড়ুন-নজরদারির জন্য বিল: প্রতিবাদ সুখেন্দুশেখরের
এই ব্যাটারির সুবিধে
অন্য সব বিকল্প শক্তি-উৎসই কাজ করে দিন বা রাতের একটা নির্দিষ্ট সময়ে, এবং সেইসব যন্ত্রের আয়ুও যত দিন যায় কমতে থাকে, মানে কমে যেতে থাকে ওগুলোর কর্মদক্ষতা। সেদিক থেকে দেখলে গ্র্যাভিটি ব্যাটারির (Gravity battery) এই সমস্যা নেই। মহাকর্ষ টান যতদিন বজায় রয়েছে, ততদিন কর্মক্ষম থাকবে এই ব্যাটারি। আর এই ব্যাটারি সম্পূর্ণ দূষণহীন, এতে পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। যখন অন্য বিকল্প শক্তি উপস্থিত, তখন জাস্ট একটু কষ্ট করে কয়েকটা ভারী-ভারী ব্লককে তুলে নিতে হবে ওপরে। এবার যখন এলাকা পুরো অন্ধকার হয়ে যাবে, তখন ওই বস্তুগুলোকে ওপর থেকে ফেলতে হবে, আর ওই ফেলার ফলেই তৈরি হবে বিদ্যুৎ।
আগামী দিনে এই কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা আরও একটি পরিকল্পনা করছেন। ওঁরা এবার ভারী বস্তুকে ওপরের দিকে না তুলে, নিয়ে যাবেন মাটির নিচে। আর এ জন্য ওঁরা বিবেচনা করছেন বিভিন্ন দেশে থাকা (বিশেষ করে চেক রিপাবলিক এলাকার) বেশ কয়েকটি পরিত্যক্ত কয়লাখনিকে ব্যবহার করা চলে কি না। আগামী বছরের মধ্যেই এই প্রোজেক্টগুলো চালু হয়ে যাওয়ার কথা। তখন আর ওইরকম উঁচু উঁচু টাওয়ার বানানোর চাপ থাকবে না।
আগামী দিনে পৃথিবীর চেহারা কেমন দাঁড়াবে আমরা কেউই জানি না, তবে গ্র্যাভিটি ব্যাটারির (Gravity battery) মতো আরও বেশ কয়েকটা উপায় যে বিকল্প জ্বালানি-উৎস হিসেবে আমাদের কাছে হাজির হবে, এটা আমরা এখন থেকেই বলে দিতে পারি। আর সেরকম ঘটলে সত্যিই আমরা নিশ্চিন্ত হব।