শীতের মরশুম। ছড়িয়েছে ঠান্ডা। কুয়াশা। কোথাও বেশি, কোথাও কম। খুব দূরে নয়, বছর শেষে কাছেপিঠে ঘুরে আসতে চান অনেকেই। কিন্তু কোথায় যাবেন, ঠিক করতে পারেন না। শাল-সেগুনের অরণ্য পছন্দের তালিকায় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন গুড়গুড়িপাল।
জায়গাটা মেদিনীপুর শহরের খুব কাছেই। মেদিনীপুর থেকে গুড়গুড়িপাল ইকো পার্কের দূরত্ব ১২ কিলোমিটারের মতো। মেদিনীপুর বন বিভাগের মধ্যে অবস্থিত। রাঙামাটির লোকালয় পেরিয়ে এক গা ছমছমে জঙ্গল। যেখনে ইচ্ছে করলেই হারিয়ে যাওয়া যায়। চেনা লালমাটির রাস্তা বিস্ময়করভাবে হয়ে যায় অচেনা। অরণ্য-পাগল পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। শাল গাছের ঘন আচ্ছাদন এই বন উদ্যানটিকে ঘিরে রয়েছে।
আশপাশের শহরগুলির সঙ্গে সড়কপথে ভালভাবেই সংযুক্ত। মেদিনীপুর থেকে ক্যাব বা বাসে গুড়গুড়িপাল ইকো পার্ক (Gurguripal Eco Park) যাওয়া যায়। কংসাবতীকে বাঁদিকে রেখে রাস্তা চলে গেছে ঝাড়গ্রাম শহরের দিকে। এরই মাঝে গুড়গুড়িপালের নিবিড় বনাঞ্চল। বাসরাস্তা ধরে উন্মুক্ত শ্যামলিমায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে হয়। সবুজ-সৌন্দর্য থেকে কোনওভাবেই চোখ ফেরানো যায় না। ছয় ঋতুর প্রতিটি মুহূর্ত পর্যটকদের মুগ্ধ করবেই। এই অঞ্চলের রেল স্টেশনগুলোর নাম ভারি সুন্দর। শালবনী, গোদাপিয়াশাল। মেদিনীপুর বাস টার্মিনাসে দাঁড়ালে দূরপাল্লার বাসের গায়ে লেখা কত অচেনা, অজানা নাম। সেগুলোও ভারি সুন্দর।
গুড়গুড়িপাল হাইস্কুল থেকে ডানদিকে ঘুরে গুড়গুড়িপালের জঙ্গলের (Gurguripal Eco Park) মধ্যে ঢুকে, ওয়াচ টাওয়ারের থমথমে নিস্তব্ধতা বেশ কিছুক্ষণ ধরে অনুভব করলে মন প্রশান্তিতে ভরে যায়। জনকোলাহল নেই, শুধু শোনা যায় পাখির কিচিরমিচির। যেন পাঠশালায় নামতা পড়া চলছে। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সের রেইন ফরেস্টের মতো না হলেও, দক্ষিণবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার শালজঙ্গলের ঘনত্ব ও গভীরতাও কম নয়।
ছোট্ট জনপদ গুড়গুড়িপাল। স্থানীয় আদিবাসীরা খুব সহজ সরল। সেইসঙ্গে আন্তরিক। শাল পাতা তুলে এনে থালা তৈরি, কড়ানি ছাতু কুঁড়োতে যাওয়া, মহুল ফল সংগ্রহ করার মতো কাজের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে রাখেন। কেউ কেউ শহরে যান কাজের জন্য। স্থানীয় মহিলাদের গোষ্ঠী অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে। বিঘা চারেক জমিতে নানারকম ঔষধি ফসল, যেমন ক্যামোমাইল, অশ্বগন্ধা, রোজেলা ইত্যাদি চাষাবাদ করেন। নিজেরাই প্যাকেটজাত করেন। সেগুলো বিক্রি হয় ভিন রাজ্যে। এঁদের হাত ধরেই গড়ে উঠেছে একটি গ্রামীণ পর্যটন উদ্যোগ। সুন্দর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাপনা।
রয়েছে কাছাকাছি আরও কয়েকটি ঘোরাঘুরির জায়গা। ৪-৫ ঘণ্টার গ্রামীণ ট্যুর হয় টোটোয়। নাম না-জানা গ্রামের রাস্তা, গভীর জঙ্গল, সবুজ শস্যক্ষেত্র, আদিবাসীদের অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা, অদূরেই প্রবাহমান কংসাবতী নদী। এছাড়াও একটা গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে দেখে নেওয়া যায় লালগড়ের জঙ্গল, রাজবাড়ি, রামগড় রাজবাড়ি, কর্ণগড় মহামায়া মন্দির, গড়বেতার গনগনি, ক্ষুদিরামের জন্মস্থান মহাবনী ইত্যাদি জায়গা।
শহরের বাইরে যেমন বনাঞ্চল, তেমনই শহরের বিভিন্ন প্রান্তে সাংস্কৃতিক মঞ্চগুলো এলাকার সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষের হৃদস্পন্দনকে ধরে রেখেছে। এখানে সারা বছর ধরে চলে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার মহা সমারোহ।
সন্ধেবেলায় মাঝেসাজে ধামসা মাদল নিয়ে ঝুমুর গানের চর্চার আসর বসে। সারাদিন বেড়ানোর পর দাওয়ায় বসে শুনতে দারুণ লাগে। সুরে সুরে জাগায় গভীর নেশা। চাইলে পেতে পারেন গরম গরম ভাজা মুড়ি, পেঁয়াজ পকোড়া। শীতকালে বনফায়ারের আসর বসানো যায়। সঙ্গে পাতাপোড়া চিকেন। সন্ধেটা জমে যাবে একদম। ইচ্ছে থাকলে টকটকে লাল মুরগির মাংস আর চালের রুটির ব্যবস্থাও হয়ে যেতে পারে। তাই শীতের দিনে ঘুরে আসতে পারেন গুড়গুড়িপাল। জঙ্গলের বুক চিরে লাল মাটির রাস্তা, শাল গাছের ছায়া, জোনাকির আলো, ঝিঁঝি পোকার শব্দ, শিয়ালের ডাক, হাতির সাম্রাজ্যের গা ছমছমে অনুভূতি, দু’-তিনদিন আয়েশ করে কাটিয়ে দেওয়া যায়।
আরও পড়ুন- গভীর অন্ধকূপে শ্বাসরুদ্ধ গণতন্ত্র
কীভাবে যাবেন?
যাওয়া যায় ট্রেনে। হাওড়া থেকে ট্রেনে মেদিনীপুরের দূরত্ব প্রায় ১২৮ কিলোমিটার। হাওড়া স্টেশন থেকে মেদিনীপুর পৌঁছনোর জন্য এক্সপ্রেস ট্রেনের সুবিধা নেওয়া যায়। মেদিনীপুর পৌঁছতে সময় লাগে ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। এই ট্রেনগুলির মধ্যে কয়েকটি হল রূপসীবাংলা এক্সপ্রেস (১২৮৮৩), হাওড়া-পুরুলিয়া এক্সপ্রেস (১২৮২৭), আরণ্যক এক্সপ্রেস (১২৮৮৫), কবিগুরু এক্সপ্রেস (১২৯৫০), সমরসতা এক্সপ্রেস (১২১৫২) ইত্যাদি। এছাড়াও আছে লোকাল ট্রেন। কলকাতা থেকে পশ্চিম মেদিনীপুরের সড়কপথে দূরত্ব প্রায় ১৩২ কিলোমিটার। কলকাতা থেকে ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক হয়ে বাস বা গাড়িতে ৩ ঘণ্টা সময় লাগে পশ্চিম মেদিনীপুরে পৌঁছতে।
কোথায় থাকবেন?
গুড়গুড়িপালে থাকার জায়গা খুব বেশি নেই। থাকতে হবে মেদিনীপুর শহরে। আছে ছোট-বড় হোটেল এবং গেস্ট হাউস। ভাড়া নাগালের মধ্যে। থাকার পাশাপাশি খাওয়ার কোনও অসুবিধা হবে না।