প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে ফাতেহা দোয়াজ দাহামের দিনে জন্মগ্রহণ করেন হজরত মহম্মদ(সাঃ)। এবং এটি তাঁর প্রয়াণের দিনও। এই জন্য দিনটিকে নবী দিবস হিসেবেও ডাকা হয়। আরবিতে ‘ফাতেহা’ শব্দের মানে হল মোনাজাত, দোয়া, প্রার্থনা৷ ‘দোয়াজ দাহাম’ শব্দবন্ধের অর্থ বারো৷ অর্থাৎ ‘ফাতেহা দোয়াজ দাহাম’-এর অর্থ একত্রে বারোর প্রার্থনা৷ আরবি মাস ‘রবিউল আউয়াল’-র ১২ তারিখ নবী হজরত মহম্মদ(সাঃ) (Hazrat Muhammad) জন্মগ্রহণ করেন৷ তিনি যে বছর মা আমিনার গর্ভে আসেন সেই বছর মক্কার শুষ্ক মরুভূমি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে৷ ওই বছর গাছে গাছে প্রচুর ফুল ও ফল ধরে৷ কোরেশ সম্প্রদায় সেই কারণে ওই বছরকে আনন্দ, খুশির বছর হিসাবে পালন করে থাকেন।
একটি মত অনুযায়ী, ৫৭১ খ্রিস্টাব্দে হজরত জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় মত অনুযায়ী, তিনি ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। এমন কথা পাওয়া যায়, তিনি ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মা আমিনার গর্ভে আসেন এবং ৫৭১ খ্রিস্টাব্দে ভূমিষ্ঠ হন। তাঁর মৃত্যু হয় ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে।
কোরানে ইসলামের নবী সম্পর্কে খুব অল্প কিছু জীবনী-সংক্রান্ত তথ্য আছে। দ্বিতীয়, তৃতীয় অধ্যায় ছাড়াও ৩৩ ও ৪৮-তম অধ্যায়ের কয়েকটি আয়াত থেকে তাঁর সম্পর্কে অল্প কিছু জানা যায়। কোরআন থেকে তাঁর জীবনের বেশি কিছু জানা সম্ভব হয় না।
হজরত (Hazrat Muhammad) যখন মায়ের গর্ভে তখন তাঁর পিতা আবদুল্লাহ্-র মৃত্যু হয়। জন্মানোর পর মা আমিনা স্বপ্ন অনুযায়ী তাঁর পুত্রের নাম রাখেন ‘আহমদ’। হজরতের পিতামহ আবদুল মুত্তালিব তাঁর নাম রাখেন ‘মহম্মদ’— যার অর্থ প্রশংসিত। ধাত্রী হালিমার কাছে তিনি বড় হন। অল্প বয়সে হজরত মাঠে পশু চরাতে যেতেন। এক সময় মাঠে পশু চরাবার সময়ে দু’জন ফেরেশতা তাঁর বক্ষ বিদারণ করে ন্যায়ের জ্যোতি পূর্ণ করে দেন, বের করে দেওয়া হয় অশুভ ও পাপের উপাদান। মাত্র ছ’বছর বয়সে তিনি মাকে হারান। পিতামহ মারা যান যখন হজরতের বয়স মাত্র আট বছর। তার পর পিতৃব্য আবু তালিব তাঁকে লালনপালন করেন। তাঁর বয়স যখন বারো বছর তখন আবু তালিব তাঁকে নিয়ে বাণিজ্যর উদ্দেশে সিরিয়ায় গমন করেন। কুড়ি বছর বয়সে হজরত নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন।
মক্কায় খাদিজা নামক এক অভিজাত, বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতী নারী হজরতের সততা, কাজের প্রতি নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি লক্ষ্য করে তাঁকে তাঁর সঙ্গে ব্যবসা করার আহ্বান জানান। খাদিজা বিবির প্রস্তাবে রাজি হয়ে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বাণিজ্যে যাত্রা করেন। সেখানে পৌঁছে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবসার মাল প্রচুর লাভে বিক্রি করেন এবং সেখান থেকে বিভিন্ন প্রকারের পণ্যদ্রব্য ক্রয় করে মক্কায় ফিরে আসেন এবং ওই সকল পণ্যদ্রব্য খাদিজা বিবির হাতে তুলে দেন। খাদিজা বিবি সেই সকল পণ্য বিক্রি করে প্রচুর লাভবান হন। এর কিছুদিন পর খাদিজা বিবির সঙ্গে হজরতের বিবাহ সম্পন্ন হয়, তাঁদের বয়সের ব্যবধান ছিল যথেষ্ট। বিয়ের সময় হজরতের বয়স পঁচিশ বছর এবং খাদিজা বিবির বয়স চল্লিশ বছর হলেও তাঁদের এই বিবাহবন্ধন সুখের হয়েছিল। হজরত মহম্মদ(সাঃ) ও খাদিজা বিবির দুই পুত্র (মতান্তরে তিন) ও চার কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। পুত্ররা শৈশবেই মারা যান। চার কন্যা হলেন— ফাতিমা, জয়নব, রুকাইয়া ও ও উম্মে কুলসুম। খাদিজা বিবি পঁয়ষট্টি বছর বয়সে প্রয়াত হন। তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত হজরত আর কোনও বিবাহ করেননি।
হজরত মহম্মদ(সাঃ) বাল্যকাল থেকেই গভীর চিন্তাশীল ছিলেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরব গোত্রসমূহের মারামারি, কাটাকাটি, রাহাজানি, মদ্যপান, জুয়াখেলা, অবিচার, ব্যভিচার ইত্যাদি অনাচার দেখে এসবের সমাধান নিয়ে তিনি চিন্তা শুরু করেন। বাড়ি ছেড়ে মক্কার অদূরে জাবালে হেরা গুহায় তিনি ধ্যান ও প্রার্থনায় সময় কাটান। মাঝেমধ্যে তিনি বাড়ি ফিরতেন। এ-সময়ে তিনি একটি স্বর্গীয় আলোক এবং অশ্রুতপূর্ব শব্দতরঙ্গ শুনতে পান। একদা আল্লাহর দূত জিব্রাঈল আসেন তাঁর কাছে এবং আল্লাহর বাণী তাঁর উপর অবতীর্ণ হয়। একে বলে ওহি। তখন তাঁর বয়স ছিল চল্লিশ বছর।
এইভাবে দীর্ঘকাল ধরে তাঁর কাছে ওহি আসে, সেইসব ওহির সামগ্রিক রূপ হল পবিত্র কোরআন। এর পর তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারের কাজে মন দেন। তাঁর প্রধান অবলম্বন ছিল কোরআন বা আল্লাহ-র প্রত্যাদেশ। কোরআনে কী রয়েছে?
ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা কোরআনের একটি জরুরি দিক। এই গ্রন্থে সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব এবং ভাল ও মন্দের বিরোধ, মানুষের কর্তব্য বিষয়ে নির্দেশ রয়েছে। রয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা ও আদর্শের মৌলিক বিষয়। কোরআনে আছে জ্ঞান ও উপদেশের নানা বিষয়।
আরও পড়ুন- পুজো-অর্থনীতিতে কুঠার হানার ছক রুখে দিতে সবাই উৎসবে শামিল হোক
পৃথিবীতে মানুষের কল্যাণের জন্য আল্লাহ অনেক নবী ও রসুল পাঠিয়েছেন, তাঁদের অনেকের কথা কোরআনে আছে। প্রথম মানব ও নবী হজরত আদমের বর্ণনা, মানব সৃষ্টি বিষয়ে আল্লাহ্ ও ফেরেশতাদের মধ্যে কথোপকথন, শয়তান কর্তৃক আল্লাহর নির্দেশ অমান্য ইত্যাদিও আছে এই গ্রন্থে। হজরত নুহ থেকে পর্যায়ক্রমে হজরত মহম্মদ(সাঃ) পর্যন্ত নবী-রসুলদের কথা বিবৃত হয়েছে।
কোরআন বিশ্বে অন্যতম সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ। মুসলমানরা প্রার্থনায় কোরআনের আয়াত পাঠ করে থাকেন। কোরআনের বিষয়বৈচিত্র অনন্য। এর মধ্যে চারটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য : ১. স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক, ২. স্রষ্টার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, ৩. মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, ৪. মানুষের সঙ্গে অন্যান্য সৃষ্টির সম্পর্ক। এছাড়া রয়েছে : ক. মানবের পার্থিব অবস্থা ও তার জীবন-যাপন পদ্ধতির সংশোধন ও উন্নতি বিধান; খ. মানবাত্মার উন্নতি ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে উপদেশাবলি ও বিধানাবলি প্রদান এবং দৃষ্টান্তসমূহের উল্লেখ; গ. মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন মঙ্গল ও সৌভাগ্য সম্পর্কিত বিধি-নিষেধ; ঘ. আন্তরিক দৃঢ়তা, উন্নত মনোবল এবং সাহসিকতা অর্জনের লক্ষ্যে পূর্বের নবী-রসুলদের জীবনী বর্ণনা; ঙ. সামাজিক জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় রীতি-নীতি, আদব-কায়দা ও কর্তব্যসমূহের বর্ণনা; চ. সৎ ও ন্যায় কার্যাবলি সম্পাদনের প্রতি উৎসাহ প্রদান এবং অসৎ ও অন্যায় কার্যাবলি থেকে বিরত থাকার উপদেশ প্রদান এবং ছ. বিশ্ব প্রকৃতির সৃষ্টিরহস্য বিষয়ে চিন্তা ও গবেষণার জন্য জ্ঞানচর্চার প্রতি আহ্বান। কোরআন মানুষের মধ্যে সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব ও নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। অন্যান্য ধর্ম সম্বন্ধেও কোরআন উদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে এবং ঘোষণা করেছে যে, পৃথিবীর কোনও জাতিই আল্লাহ্র দয়া বা রহমত থেকে বঞ্চিত নয়; আল্লাহ্ প্রত্যেক জাতির জন্য নবী ও রসুল প্রেরণ করেছেন।
হজরত মহম্মদ(সাঃ) সহানুভূতি, ন্যায়বিচার এবং নৈতিকতার উপর জোর দিয়ে একেশ্বরবাদ এবং ঈশ্বরের ঐক্যের প্রচার করেছিলেন। তাঁর বার্তা ও উপদেশ অনুসারীদের আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু তিনি মক্কার নেতাদের প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। এই বিরোধিতা ক্রমে অত্যাচারে রূপ নেয়। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে, মহম্মদ মদিনায় হিজরত করেন, যেখানে তিনি প্রথম ইসলামি সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিভিন্ন জনজাতিদের ঐক্যবদ্ধ করেন, একটি সংবিধান প্রতিষ্ঠা করেন এবং ন্যায়বিচার ও সমতার ভিত্তিতে একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
হজরত মহম্মদ(সাঃ) ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ পেতে থাকেন, যা পরে কোরআনে সংকলিত হয়। তিনি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন : বিশ্বাস, প্রার্থনা, দাতব্য, উপবাস এবং তীর্থযাত্রা।
হজরত মহম্মদ(সাঃ) ব্যতিক্রমী নেতৃত্ব, সহানুভূতি এবং নম্রতা প্রদর্শন করেছেন। তিনি যুদ্ধ এবং ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি সমেত অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। সেই লক্ষ্য ছিল সাম্যের লড়াই।
হজরত মহম্মদ ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ১২ রবিউল আউল প্রয়াত হন। রেখে যান অসংখ্য অনুরাগী ও অনুসারী। মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, তিনি শেষ ও শ্রেষ্ঠ বার্তাবাহক। ফতেহা দোয়াজ দাহাম তাঁর দেখানো পথকে স্মরণ করিয়ে দেয়।