আমেরিকার যে কোনও সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলে লক্ষ্য করা যাবে প্রধানতম চর্চা নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইমপোর্ট ট্যারিফ রেট কতটা বাড়াবেন? অন্য দেশ থেকে আমেরিকায় পণ্য রফতানি করতে হলে ওই চড়া ট্যাক্স দিতে হবে। চিনকে সবথেকে বেশি টার্গেট করেছেন তিনি। কেন? কারণ আমেরিকার অভ্যন্তরীণ ক্ষুদ্র মাঝারি বা বৃহৎ সব শিল্প সংস্থার উৎপাদন ও বিক্রি যাতে বাড়ে। ইতালির অন্যতম বৃহৎ ব্যাঙ্ক ইউনিক্রেডিট স্থির করেছে তারা জার্মানির বৃহত্তম আর্থিক সংস্থা কমার্জব্যাঙ্ককে কিনে নেবে। জার্মান সরকার সেটা ঠেকাতে মরিয়া। জার্মানির নাগরিকরাও ক্ষুব্ধ। কারণ এটা রাষ্ট্রীয় সম্মানের ব্যাপার। অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্ট সর্বসম্মতিক্রমে আইন এনেছে যে, ১৬ বছরের কম বয়সিদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। গুগল, মেটা, এক্স ইত্যাদি সংস্থা প্রবল চিন্তিত। কারণ তাদের ব্যবসা প্রবলভাবে ধাক্কা খাবে। ওই বয়সটাই অ্যাসপিরেশনাল বয়স। স্বপ্ন দেখার বয়স। তাই ওই বয়স হাতছাড়া করা চলবে না। এইসব সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থা অস্ট্রেলিয়ান সরকারের কাছে সময় চেয়েছে। বলেছে, আমরা এই বয়সের ব্যাপারটা কীভাবে ম্যানেজ করা যায় সেই টেকনোলজি আনছি, সময় দিন। অস্ট্রেলিয়া রাজি নয়। আফ্রিকার সুদানের একটি উদ্বাস্তু ক্যাম্প রয়েছে এল ফাশহর নামক জনপদে। সেই উদ্বাস্তু ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া গৃহযুদ্ধে গৃহহীন ৫ লক্ষ মানুষের জন্য এই সপ্তাহ কিছুটা খুশির খবর এনেছে। কারণ এই ৫ লক্ষ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে প্রায় অনাহারে কাটাচ্ছে। যুদ্ধের কারণে রাষ্ট্রসঙ্ঘকে খাবার সাপ্লাই পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি। অবশেষে সেই সাপ্লাই আসছে এই সপ্তাহে। বিগত ৬ মাস ধরে লাগাতার পশ্চিমি দেশগুলি এই নিয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘে আলোচনা করেছে। চাপ দিয়েছে।
অন্যদিকে ভারতের অবস্থা দেখুন!
ভারতকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে এখনও পর্যন্ত কতটা অপরিণতমনস্ক এবং নির্বোধ করে রেখে দেওয়া হচ্ছে। ভারত পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ বলে গর্ব করছে। অথচ, এখনও বিশ্বকে কোনও ভোগ্যপণ্যের এক নম্বর ব্র্যান্ড উপহার দিতে পারেনি ভারত তথা ভারতের কর্পোরেট মহল। আজও ১৪০ কোটি দেশের স্বপ্ন পকেটে একটি অ্যাপল ফোন থাকা। ভারত আজও একটি মোবাইল ব্র্যান্ড বিশ্বকে দিতে পারেনি। কোনও টেলিভিশন, কোনও প্যাড, কোনও লেদার প্রোডাক্ট, কোনও শীতের পোশাক, কোনও গরমের পোশাক কিছুই নেই। অর্থাৎ আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, বেজিং, স্কটল্যান্ড, মেলবোর্ন, প্যারিস, ব্রাজিলের নাগরিকরা ভারতের কোনও একটি ব্র্যান্ড ব্যবহার করার জন্য উদগ্রীব এবং সেই ব্র্যান্ড বিশ্বকে শাসন করছে, এরকম উদাহরণ নেই।
তাহলে ভারত তো ক্রেতার দেশ, ১৪০ কোটির বাজার। ভারতকে সবাই শুধু বিক্রি করে চলেছে নিজেদের প্রোডাক্ট আর ব্র্যান্ড। শ্রমশক্তি বেশি, কিন্তু মজুরি কম। অতএব আরও সুবিধা। এদের থেকে কাজ করিয়ে নাও প্রসেস থেকে সফটওয়্যার যে কোনও সংস্থায় অফশোর এমপ্লয়ি হিসেবে।
আরও পড়ুন- রাজ্যসভার তৃণমূল প্রার্থী ঋতব্রত, পদের যোগ্য জানালেন অভিষেক
ভারতের বৃহত্তম কর্পোরেট সংস্থাগুলির দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা দেখা যায় না। বিদেশি সংস্থার মতোই দেশি সংস্থা হয়েও তারা ভারতীয় জনতাকে স্রেফ ক্রেতাই ভাবে। তাই যখন তখন টেলিকমের ট্যারিফ বাড়ায়। সুযোগ খোঁজে জনতার ট্যাক্সের টাকায় সরকার তাদের কর্পোরেট ট্যাক্স কখন মকুব করবে। জমি আদায় করা রাজ্য সরকারকে শিল্পায়নের টোপ দিয়ে কর্পোরেট কোম্পানির নবতম উদ্যোগ হল সুযোগ পেলেই রিয়াল এস্টেটে ঢুকে পড়া। সস্তায় জমি নিয়ে সেখানে স্যাটেলাইট টাউনশিপ কিংবা হাউজিং কমপ্লেক্স নির্মাণ করা।
আমেরিকার জিডিপি ২৮ লক্ষ কোটি ডলার। চিনের জিডিপি ১৮ লক্ষ কোটি ডলার। ভারতের জিডিপি সাড়ে ৩ লক্ষ কোটি ডলার। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর গালভরা সংলাপ এবং তাঁর শরীরী ভঙ্গি দেখলে বোঝা যায় যে, ভারত এদের থেকে কত পিছিয়ে আছে। মসজিদ, মন্দির, গোমাংস, ইডি, সিবিআই— এসব নিয়েই বেশ আছে এদেশের মোদি সরকার! ভারতের রফতানি তলানিতে পৌঁছেছে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ঘাটতি চরম আকার নিয়েছে। কারণ, যে ভারত ছিল অতীত গৌরবকালে বিক্রেতা, আজ সেই ভারত নিছক ক্রেতা। রফতানির দেশ আজ আমদানির দেশ। দাতার দেশ আজ গ্রহীতার দেশ। আধুনিক চিন্তা, শিল্প, বাণিজ্য, গৌরব, সবদিকেই ভারতকে পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এর সঙ্গে চলছে সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে নষ্টামি। ভণ্ডামি।
প্রতিটি দেশেই সংখ্যালঘু শ্রেণির মানুষের বসবাস আছে। সংখ্যালঘুত্ব নানারকম হতে পারে : ধর্মীয়, ভাষাগত, জাতিগত (এথনিক অথবা রেসিয়াল)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে কালো মানুষ এবং ল্যাটিনো। উইঘুর সম্প্রদায় রয়েছে চিনে। পাকিস্তানে আছে শিয়া সম্প্রদায়। পাকিস্তান ও বাংলাদেশে হিন্দু আছে। শ্রীলঙ্কায় রয়েছে তামিল ও মুসলমান। অস্ট্রেলিয়ায় আদিবাসীরা রয়েছে। ইজরায়েলে আছে আরব জনগণ। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে ইহুদি এবং রোমা লোকেজন রয়েছে। জাতীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার জন্য ইউরোপের কাউন্সিল ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন, ১৯৯৮ গ্রহণ করেছে। এর উদ্দেশ্য জাতীয় সংখ্যালঘুদের সংস্কৃতি এবং পরিচয়ের সংরক্ষণ ও বিকাশ। মূল আইনগুলির মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আইন, ১৯৬৪ এবং অস্ট্রেলিয়ায় আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার জন্য একগুচ্ছ আইন। দূরদৃষ্টির অধিকারী ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর এই দেশের সংখ্যালঘু শ্রেণিগুলির অধিকারকে ভারতের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত মৌলিক অধিকারেই উন্নীত করেছিলেন।
ভারতীয়রা এবং ভারত সরকার একসঙ্গে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের হিন্দুদের অধিকারের বিষয়ে আবেগপ্রবণ এবং তা নিয়ে সোচ্চারও। ভারতীয় বংশোদ্ভব ছাত্ররা কোনও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়রানির শিকার কিংবা খুন হলে আমরা উদ্বিগ্ন হই। বিদেশে হিন্দু মন্দির বা শিখ গুরুদ্বার ধ্বংসের খবর পেলে আমরা ক্ষোভে ফেটে পড়ি। কিন্তু যখন অন্য কোনও দেশ বা মানবাধিকার সংস্থা এদেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণ নিয়ে ভারতের দিকে প্রশ্ন উত্থাপন করে তখন আমাদের বিদেশ মন্ত্রক তাদের সতর্ক করে দিয়ে বলে যে, ‘আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে আসবেন না।’ অতএব ভণ্ডামিটা স্পষ্ট।