হায় আইএসআই, কলকাতা! তোমার নাকি দিন গিয়েছে

১৯৩১-এর আজকের দিনে পরিসংখ্যান গবেষণাতে বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়েছিল। এখন চলছে তাকে ছেঁটে ফেলার বন্দোবস্ত। সৌজন্যে মোদি সরকার। সেই নোংরামির বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটির গৌরব ও গুরুত্ব মনে করিয়ে দিলেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের (ISI) জন্য একটি নতুন আইন প্রণয়ন। আইনে আইএসআই পরিচালন ব্যবস্থা-সহ বিভিন্ন বিষয়ে খোলনলচে বদলে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আরও নিয়ন্ত্রণ দেশের অন্যতম সেরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর চাপানোই এর অন্যতম উদ্দেশ্য। কারণ, এখন আইএসআই পরিচালনা করে ৩৪ সদস্যের এক কাউন্সিল। সংস্থার একজন প্রেসিডেন্টও আছেন। কাউন্সিলের কিছু সদস্য এবং প্রেসিডেন্ট ভোটের মাধ্যমে আসেন। অধ্যাপক এবং কর্মীদের পাশাপাশি আইএসআই সদস্যরাও ভোট দেন। কেন্দ্রীয় সরকার মনোনীত হয়েও কাউন্সিলে কয়েকজন আসেন। নতুন আইনে সংস্থা পরিচালনার জন্য যে বোর্ড অব গভর্ন্যান্স গঠন করার কথা বলা হয়েছে, তাতে চেয়ারপার্সন-সহ সকলেই হবেন কেন্দ্রীয় সরকারের মনোনীত।

ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ফি আদায়-সহ বিভিন্ন খাতে সংস্থার আয়বৃদ্ধির মাধ্যমে আর্থিক স্বয়ম্ভরতাই প্রস্তাবিত আইনটির লক্ষ্য। মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক অনুদানে চলা আইএসআইতে গণিত, রাশিবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের যেসব কোর্স বহুদিন ধরে চলছে, সেখানে ছাত্রছাত্রীদের কোনও টিউশন ফি দিতে হয় না। বরং তাঁরা মাসিক স্টাইপেন্ড পান। নতুন আইনে আইআইটি-আইআইএমগুলির মতো এখানেও পড়ুয়াদের মোটা টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। এতে গরিব পরিবারের অনেক মেধাবী তরুণ-তরুণী শিক্ষার সুযোগ হারাবেন।

কলকাতায় আইএসআইয়ের (ISI) সদর দফতর ছাড়া দেশের কয়েকটি জায়গায় যেসব সেন্টার আছে, সেগুলিকে অনেকটাই স্বশাসন দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আইআইটি-আইআইএমের ধাঁচে সেন্টারগুলি চালানো যাবে। এখন কলকাতা সদর দফতর থেকে আইএসআইয়ের দিল্লি, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু ও তেজপুরের সেন্টারগুলি নিয়ন্ত্রিত হয়। সদর দফতর আগামীদিনে কলকাতায় থাকবে কি না সেই ব্যাপারে প্রস্তাবিত আইনটিতে সরাসরি কিছু বলা হয়নি। তবে যেভাবে সেন্টারগুলিকে স্বশাসন দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তাতে কলকাতার সদর দফতর থাকলেও তার গুরুত্ব অনেক কমে যাবে।

উৎসবের মরশুমে সবাই যখন ব্যস্ত থাকবেন ঠিক তখনই নতুন আইনের ব্যাপারে মতামত চাওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট। কলকাতার মর্যাদা খর্ব করার জন্য, নেহরু যুগের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য এবং বাংলা ও বাঙালি বিদ্বেষী অবস্থান থেকেই এহেন পদক্ষেপ।
এই দুঃখদীর্ণ বলয়ে একবার ফিরে দেখা যাক সেইসব বৃত্তান্ত, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের (আইএসআই) গোড়ার কথা, গড়ার কথা।

আরও পড়ুন-এসআইআর ও যুবভারতীর ঘটনা নিয়ে সরব অভিষেক, খারিজ হল বিজেপির গল্প

কেমব্রিজের ট্রাইপস ছাত্র প্রশান্তচন্দ্রের দেশে ফেরার জাহাজ যুদ্ধের জন্য ছাড়তে দেরি হলে সেই অবকাশে কিংস কলেজের গ্রন্থাগারে কীভাবে পরিসংখ্যানবিদ্যার বই আসে তাঁর হাতে, কীভাবে পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রবাহকে এ-দেশে নিয়ে এলেন তরুণ মহলানবিশ, তা নিয়ে চর্চা হয়েছে বিস্তর। তবু, প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যার তরুণ অধ্যাপক কী ভাবে এ দেশে তৈরি করলেন পরিসংখ্যানবিদ্যার এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, তা এক বিস্ময় বইকি। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই)-এর মতো এক শিক্ষা এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা, বা ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিস (এনএসএসও) বা সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস (সিএসও)-এর মতো পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রশাসনিক এবং ব্যবহারিক প্রতিষ্ঠান তৈরি, একটা প্রজন্মের পরিসংখ্যানবিদ, গণিতবিদ-সহ শিক্ষক-গবেষকদের সযত্নে লালন করাই কেবলমাত্র মহলানবিশের উত্তরাধিকার নয়— রাষ্ট্র আর সমাজকল্যাণে পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রয়োগই ছিল তাঁর মূল মন্ত্র। ১৯৫০’এর পুণে সায়েন্স কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে ‘হোয়াই স্ট্যাটিস্টিক্স’ শীর্ষক তাঁর ভাষণেও সেই এক সুরের অনুরণন। কিন্তু, সেজন্য তো উপযুক্ত পরিকল্পনার প্রয়োজন; চাই ঠিকভাবে পরিকল্পিত ও দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদিত সমীক্ষা— স্যাম্পল সার্ভে।

জীবনব্যাপী অসংখ্য সমীক্ষা পরিচালনা করেছেন মহলানবিশ— কৃষি, অর্থনীতি, শিল্প, পাট উৎপাদন, বাংলার দুর্ভিক্ষের ক্ষয়ক্ষতি, এমন বহুবিধ বিষয়ে। এনএসএসও-র সমীক্ষাগুলি যে সদ্য-স্বাধীন দেশের রূপরেখা বুঝতে, প্রয়োজন অনুধাবনে, এবং সার্বিক বিকাশে চাবিকাঠি হয়ে উঠেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
নিষ্ঠা এবং উদ্ভাবনীশক্তি ছিল মহলানবিশের এই সমীক্ষাগুলির জিয়নকাঠি। সমীক্ষা এবং তথ্যকে ত্রুটিহীন করতে মহলানবিশের সাধনা রূপকথাসম। সমীক্ষার তথ্যের ভুল পরিমাপের জন্য তিনি তৈরি করেন রাশিবিজ্ঞানের নতুন তত্ত্ব। এনএসএসও-র তথ্য সংগ্রহে ক্রস এগজ়ামিনেশন বা প্রতি-পরীক্ষার জন্য স্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক কর্মী রাখার ব্যবস্থা করেন তিনি। পক্ষপাতহীন তথ্য সংগ্রহের এই সংস্কৃতি নিঃসন্দেহে মহলানবিশ জমানার এক বড় উত্তরাধিকার। আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে তথ্যের প্রতি এই নিষ্ঠার কথা বিশ্বাস করাই মুশকিল।
দেশগঠনে পরিসংখ্যানবিদ্যা, সমীক্ষা, তথ্যসংগ্রহ, তথ্যের বিশ্লেষণ-ভিত্তিক ফলাফলের প্রয়োগ নজর কেড়েছিল বিশ্বেরও। আইএসআই-এ এসে ভারতের প্রজ্ঞা থেকে জ্ঞান আহরণ করতে চেয়েছেন ঝৌ এনলাই, হো চি মিন। এবং ভারতে রাশিবিজ্ঞানের সৃষ্টিশীল সংস্কৃতির যে বলিষ্ঠ বনিয়াদ তৈরি করে গিয়েছেন মহলানবিশ, তাতে ভর করেই দেশ পাড়ি দিয়েছে পরবর্তী অর্ধ শতাব্দী।

আজ প্রথাগত তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও এসে গিয়েছে প্রযুক্তির অনিবার্য প্রয়োগ। যেমন, ভারতের জনশুমারি হতে চলেছে ‘ডিজিটাল’। তথ্য ও তার বিশ্লেষণের চরিত্রের এই পরিবর্তন কালে মহলানবিশের ভঙ্গিতে মানবকল্যাণে তার প্রয়োগ সহজ নয় নিশ্চয়ই। এবং তথ্য সংগ্রহে মহলানবিশের নৈর্ব্যক্তিক নিষ্ঠা যে প্রশ্নাতীত বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করেছিল, তাঁর মৃত্যুর পাঁচ দশক পরে তা ধরে রাখাও কঠিন নিশ্চয়ই।
‘যোজনা কমিশন’-এর ‘নীতি আয়োগ’ হওয়া, বা এনএসএসও এবং সিএসও জুড়ে গিয়ে ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস হয়ে যাওয়াটাই মোটেই যথেষ্ট নয় তার জন্য।

পরিসংখ্যানবিদ্যাকে ভাষা জুগিয়েছেন মহলানবিশ, অন্তত ভারতের প্রেক্ষিতে। দেশ ও সমাজের এক প্রকৃত ক্রান্তিকালে পরিসংখ্যানবিদ্যাকে তিনি দেখেছেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের সোপানের এক প্রধান প্রযুক্তি হিসেবে। সঙ্গে অবশ্যই ছিল সদ্য-স্বাধীন দেশের মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রত্যয়, এবং অনুকূল রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। এক অসাধারণ বিজ্ঞানীর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সেই ব্যতিক্রমী সময়কালের মেলবন্ধনই তৈরি করেছিল মহলানবিশের স্থায়ী উত্তরাধিকার, আইএসআই।
কিন্তু মূর্খের জমানায় তাতেও কোপ পড়ল। প্রকৃত শিক্ষিত মননহীন ভারতে এমনটাই অনিবার্য বোধহয়।

Latest article